অনুধাবন ( ১৩ তম পর্ব )

ছেলে দুটোর কথার ভাঁজ ভালো লাগেনি মোটেও আজিজ মিয়ার। আর তাই যত তাড়াতাড়ি ওদের কাজ করে দেয়া যায় ততই মঙ্গল ভেবে সকাল সকালই আজ আজিজ মিয়া আড়তে চলে আসে। তালুকদার সাহেব যখন বলেছেন উনি থাকবেন তাহলে অন্য কোন চিন্তা না করলেও চলে, উনি ঠিক ঠিক সামলে নেবেন। কিন্তু সে কি সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো প্রায় তবু না তালুকদার সাহেব আড়তে এলেন না ওনার ভাস্তেরা। অন্যদিন এ সময়ের মধ্যে আজিজ মিয়া দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি চলে যান। আজ কোন সিদ্ধান্ত ছাড়া কি করবেন বুঝতে না পেরে খালি পেটেই আড়তে বসে রইলেন। দুপুর প্রায় শেষ হয়ে এলে অনেক ভেবেচিন্তে লোক পাঠালেন তালুকদার বাড়ি কি করবেন জানতে? লোক এসে জানালো তালুকদার সাহেব নাকি হাসপাতালে গেছে ছেলেকে দেখতে। আজ আড়তে আসবে কি না তার কোন ঠিক নাই। এমন কোন খবরের জন্য প্রস্তুতি না থাকায় পুরোপুরি অন্যমনস্ক হয়ে কাগজপত্র গুছিয়ে বাড়ির দিকেই রওয়ানা দিল আজিজ মিয়া। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। বছরের শেষ ভাগ তাই দিন ছোট হয়ে আসছে। গ্রামে এসময় হাল্কা কুয়াশা পড়া শুরু হয়। শীতের কোন কাপড় আনেন নি তাই তাড়াতাড়ি সাইকেলের প্যাডেলে পা ঘুরালেন। খিদেটাও লেগেছে দারুন। সেই সাত সকালে কি না কি খেয়ে বেরিয়েছেন। দুপুরে ভাত না খেলে কেমন আইঢাই লাগে। মনে হয় যেন সারাদিন কিছুই খাওয়া হলোনা।

পথে যেতে যেতে আজিজ মিয়া ভাবছিল, এতোদিন ধরে এই আড়তে কাজ করার মধ্যে আজকেই প্রথম তালুকদার সাহেব কোন কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। অন্য কোন ঝামেলা হয়নিতো? রাসেল বেশী অসুস্থ না তো? উনি সাধারণত হাসপাতালের লোক পাঠিয়ে ছেলের খোঁজ রাখেন।একবার আজিজ মিয়াকে কথায় কথায় বলেছিলেন, ছেলেমেয়েদের লোকজনের সামনে আদর বা মায়া দেখানো ওনার পছন্দ না। আদিখ্যেতা লাগে নাকি। কিন্তু আজিজ মিয়া খুব ভালো করে জানেন তালুকদারের জীবন থাকতে তার ছেলেমেয়েদের ক্ষতি কেউ করলে সে তাকে বাঁচতে দেবেনা। ওড়া কথায় শুনেছেন রাসেলের এই অবস্থার পেছনে নাকি ওয়াদুদের খানিক হাত আছে। ওড়া কথায় কান দেয়া আজিজের নিজেরও পছন্দ না, তাই সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু ব্যাপার যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তবে ওয়াদুদের খবর আছে। কারণ তালুকদার সাহেব নিজেই রাসেলকে ওয়াদুদের সাথে থেকে ব্যবসার কাজ শিখতে বলেছিলেন। এই দুনিয়ায় বুঝি কাউকেই বিশ্বাস করার জো নেই। সুযোগ পেলেই লোকে এক হাত দেখে নেয়। কই আজিজ মিয়ার তো কোনদিন মনে হয়নি তালুকদার সাহেবের সাথে দুই নাম্বারী করার কথা। বরং নিজের বৌ ঝি নিয়ে শান্তিময় দিন পার করতে পারলেই তার কাছে স্বস্তির লাগে। শুধু একটাই ভয় কোনদিন যদি তালুকদার সাহেব রোশনীকে দেখতে চায়। বা কোনভাবে জেনে যায় রোশনীর আসল পিতৃপরিচয়।এতোদিন ধরে নিজের বুকে করে মানুষ করা মেয়ের কোন ক্ষতি হলে কি নিয়ে বাঁচবেন উনি?

……………….

সেইদিনের কয়েক ঘন্টা আগের সকাল বেলার কথা।

তালুকদারের বড় ভাইয়ের দুই পুত্র লোকমান আর হাকিমের আজ তালুকদারের আড়তে যাওয়ার কথা। ছোট চাচা রতনের কথা যদি সঠিক হয় তবে আজকেই তারা জমির দখল আর দলিল সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে বসবে বাড়ির সবার সাথে এরকমই প্ল্যান। সকাল সকাল নাস্তা খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয় দুই ভাই। নিজেদের মাঝে আপন মনে কথা বলে হাঁটতে হাঁটতে খেয়ালই করেনা তাদের পেছনে আসা কয়েকজন অপরিচিত মুখকে। খাল পেরিয়ে মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই একটু সুনসান জায়গাটা। মন্দিরটি নিয়ে কিছু কথা চালু আছে এখনো তাই লোকে এই পথে খুব দরকার না হলে হাঁটে কম। এতো সকাল দেখে লোকের আনাগোনাও বুঝি আরো কম। তার ওপর সকালে বেশ কুয়াশা পড়েছে আজ। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুভাই ধুপধাপ মাটিতে পরে যায়। কোনরকম মারধোর যেন না দেওয়া হয় সেরকমই নির্দেশ ছিল। আসলে নাকে সামান্য একটু চেতনা নাশকের ছোঁয়া অমনোযোগী হওয়ার সুবাদে অল্প সময়েই কাজ করে দুই ভাইয়ের জন্যই। দলের শক্ত সামর্থ দুজন সাথে আনা ভটভটিতে অনায়াসেই ঢুকিয়ে ফেলে শরীর দুটো।

ঠিক কয়ঘন্টা অজ্ঞান ছিল তা বোধহয় দু ভাইয়ের কেউই জানেনা। জ্ঞান ফিরতেই বুঝতে পারলো তাদেরকে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে একটা ছোট্ট মাটির ঘরে। হাকিমেরই আগে জ্ঞান ফিরে। একটু সরে গিয়ে লোকমানকে ধাক্কা দিতেই লোকমানও হু বলে জানায় তার জ্ঞান ফিরেছে। কে বা কারা তাদের ধরে আনতে পারে কিছুই বুঝতে না পেরে কারো আগমনের অপেক্ষায় চুপ করে দু ভাই দেয়াল ঘেসে পরে রইলো। বেশীক্ষণ সময় লাগেনি অন্যলোকের গলার আওয়াজ পেতে। গলার স্বর গুলো পরিচিত নয়। দরজা খুলে যে ঢোকে তার পুরো মুখে কাপড়ে ঢাকা। শীত বিকালের মরা রোদ কেমন একটা ভীতিকর আলো তৈরী করেছে পুরো ঘরে। এ বেলা শক্ত করে দুভাইয়ের চোখ বেঁধে দেয়া হলো। হাত পা তো আগেই বাঁধা কাজেই চাইলেও নড়ার উপায় নেই। আর আবারো দুজন শক্তপোক্ত লোকে তাদের জোর করে ঠেলে ভটভটিতে ঢুকিয়ে দিল। কে এই লোকজন কি তাদের উদ্দেশ্য কিছুই না বুঝে যখন দুভাই বেঁচে থাকার হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন দলের মধ্যের একজন কথা বলে উঠে।

জাগসে নাকি বলদ দুইটা?

বুঝতাসিনা ওস্তাদ। এইখানেই ফালায়া দিমু?

না খাড়া আরেকটু সামনে গিয়া লই। খালপাড়ে ফালাইলেই হইবো। আমার কি অবাক লাগে জানসরে বাদলা, নিজের লোকগোরেও মাইনষে সম্পদের লাইগা ছাড় দেয় না। মানুষ কত পিচাশ হইয়া গেসে।

কার কথা কন ওস্তাদ?

কার কথা আর? এই বলদা দুইটার ছোট চাচা লাগে নাকি রতনে। হের অর্ডার আজকা এই দুইজন গ্রামে থাকতে পারবোনা। বুঝ ঠেলা। যাউকগা, আমগো এতো কথায় কি কাম? টেকা দিসে কাম করসি। বাকীটা চাচা ভাইস্তা বুঝবো। বাঁকটা ঘুরলেই খালপাড়। ভটভটি সাইড কইরা আস্তে ফালায়ে দিতে ক দুই ভাইরে। মুখটাও বাইন্ধা দিতে কইস, নইলে চিল্লায়া লোক জড়ো করতে পারে।

………………….

সন্ধ্যা প্রায় নেমে এলো বলে। আজিজ মিয়া দ্রুতই প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন। মোড়ের মুখে মন্দির পেরোলেই খাল আর তার পরপরই তার নিজ বাড়ির সীমানা। সেই ছোটবেলার মন্দিরে কি না কি থাকার ভয় এই বড়বেলায় এসেও কেন যেন সেভাবে যায়নি। তাদের ছোটবেলায় এই মন্দিরে নাকি নরবলি দেয়া হতো। অনেকেই নাকি রাত বিরেতে বা ভর সন্ধ্যায় কি না কি দেখেছে। এই পথটা শর্টকাট দেখেই এসেছেন নয়তো সময় থাকলে সাধারণত ঘুরপথেই তিনি বাড়ি যান। খালপাড় পেরোতেই কি কারো গোঙানির আওয়াজ শুনলেন? ভয়ে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে পড়তে আরো দ্রুত প্যাডেল ঘোরাতে লাগলেন বাড়ির পথে। খাল পাড়ের পুরোটা পথই গোঙানির আওয়াজে মনে হলো কারো কোন বিপদ হলোনা তো? কিন্তু মনের ভয়ে একা না দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে ঘরের কামলা হাসু আর পাশের বাড়ির মতিন মিয়া সহ দেখতে চললেন খাল পাড়ে কিসের শব্দ শুনেছেন।

টর্চের আলোয় নীচের দিকে উঁকি দিয়ে পড়ে থাকা মানুষ দুটোকে দেখে বাকী দুজন ও আল্লাহ হাকিম আর লোকমান ভাই দেখি পইরা আছে বলে চিৎকার দিয়ে দৌঁড় দিলেও আজিজ মিয়ার হঠাৎ করে একরাশ আতংক মনে চেপে ধরলো। তার শুধু মনে হলো দৌঁড়ে পালান এখান থেকে। কিন্তু উনি নিজেই যে বাকী দুজনকে এনেছেন দেখতে কিসের শব্দ। আজিজ মিয়ার বড় ইচ্ছে করছিলো একছুটে এখান থেকে পালিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে। কে করলো এই ঘটনা? তালুকদার সাহেব? এই দুজন যে আজ আড়তে যাওয়ার কথা তা আর কে কে জানে? আল্লাহ যে কেন তার ওপরেই এতো বড় গজব এনে হাজির করলেন? কোন কারণে যে আজ এই শর্টকাট ধরে আসতে গেলেন এজন্য নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে ছেলেদুটোকে সাহায্য করতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন খালের নীচু ঢালের দিকে।

তালুকদারদের বসতভিটায় দুভাইকে নিয়ে পৌঁছাতে আরো বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো। সারাদিনভর অভুক্ত শরীর আর মনের ভেতর জমে ওঠা উৎকন্ঠার চাপে আজিজ মিয়ার মনে হচ্ছিলো যে কোন মূহুর্তে উনিই মাথা ঘুরে পরে যাবেন। বাড়ির ভেতরে এতো হইচই কারো কাছে কিছু বলতেও পারছেন না আবার বাড়ি ছেড়ে যেতেও পারছেন না। কি যে এক উভয় সংকটে পরলেন।

হঠাৎ করেই একটা পরিচিত গলার শব্দে পুরো বাড়ির হৈচৈ নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
‘কি হইসে হাকিম, লোকমানের? জ্ঞান কি ফিরসে ঠিকমতো? নইলে ভটভটি আন ওগোরে শহরে ডাক্তারের কাছে নিতে হইবো।’

এতক্ষনের হাউকাউ করা জটলা যেন মূহুর্তেই হাল্কা হয়ে গেল তালুকদারের উচ্চকিত কন্ঠে। দুই ভাইকে সাথে সাথেই ভটভটিতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালের দিকে।

অন্তত নিজের ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পরতে পারবেন এই আনন্দে আজিজ মিয়া প্রায় কেঁদে ফেলেন অবস্থা ততক্ষণে। হঠাৎ ঘাড়ে তালুকদারের হাত পরতেই একই সাথে ভয়, খুশী শংকা মিলেমিশে বুঝি তাকে পুরোপুরিই কাবু করে ফেললো। সেই হাতের স্পর্শ কি কিছু ইশারায় বলতে চাইলো আজিজ মিয়াকে? মানে না বুঝতে পারার চিন্তায় ক্লান্ত আজিজ আরো বুঝি জড়সড় হয়ে গেলেন।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *