অনুধাবন ( ২৮তম পর্ব )

ওয়াদুদ, বাড়িতে আছোস? একটু বাইরে আয়। তোর লগে কথা আছে।
– কি রে রতন, এতো রাইতে? সারাদিন কই আছিলি? ডেরায় কেউ কইতে পারলোনা তুই কই। নাজমার মা ও তো জানেনা বলে তোর খবর।
মিছা কথা কস ক্যান? তুই জানস না আমি কই আছিলাম? কেউ তোরে কিছু কয় নাই? তুই কি আকাশে থাকস?
– ক্ষ্যাপস ক্যান? কে যেন কইসিলো তোরে থানায় নিয়া গেসে। বিশ্বাস হয় নাই। এখন ক থানায় নিলে অহন তুই এইখানে ক্যামনে?

সেই জবাব আমি তোরে এখন দিমু না। ঘটনার সব প্ল্যান তোর হওয়ার পরেও তোর গায়ে ফুলের টোকা লাগলো না আর আমি জেলখাটা আসামী হইয়া গেলাম। আমারে ক এই ঘটনা ক্যামনে হইসে? তালুকদারের হাত আছিল নিশ্চয়ই, তাইনা?
– তুই তো বুইঝায় ফেলছিস কার হাত কোথায় আছিল। তাইলে আর আমারে জিগায়া কি কাম, ক? আমার কাছেও ঐ এক উত্তরই আছে তোর জন্য।
আইচ্ছা বুঝলাম। তাইলে আজকা থেইকা আমার ব্যাপার আমিই বুঝুম। তোর লগে আর আমি নাই। – সেইটা তোর বিবেচনা। আমি সবসময় তোর ভালো চাইসি। তুই তোর ভাইয়ের থেইকা যেন জমি বুইঝা পাস সেইরকমই কিছু ইচ্ছা আমার আছে।

এই কথোপকথনেরই খানিক আগেও রতন ভেবেছিল সব তার ভাইয়ের কারসাজি, যেহেতু ওয়াদুদ তার ভাইয়ের ডানহাত সে রতনের সাথে সম্পর্ক ওভাবেই রাখতে দিয়েছিল ওয়াদুদকে যাতে ওদের গোপন প্ল্যান জেনে যেতে পারে। কি ভাবে তালুকদারের কাছ থেকে সম্পত্তি উদ্ধার করা যায় তারই নতুন পরিকল্পনা করতেই তাই রাতের আঁধারে সদ্য জেল ফেরত রতন ছুটে আসে ওয়াদুদের ঘরে। দরজায় টোকা দেওয়ার আগ মূহুর্তে শুনতে পায় ভেতরে কারা যেন কথা বলছে। এক মূহুর্ত থেমে বোঝার চেষ্টা করে কাদের গলা ভেতরে? যেহেতু ডেরায় আসা সবাইকে রতন চেনে তাই ভেবেছিল বুঝতে পারবে কে ভেতরে। কিন্তু শুধু ওয়াদুদের গলার স্বরই বুঝতে পারে। ভেতরের কথোপকথনের সারাংশটুকু ছিল তালুকদারের বাড়ির ভেতর ও বাহিরে ঘটানো বিপদটুকুতে কিভাবে সন্তর্পনে নিজেকে সরিয়ে রেখে রতন আর আসলামকে জড়ানো হয়েছে সে বিষয়ক। ওয়াদুদের নিজের কন্ঠে বলা, ‘রতন তো একটা বলদ, ওগো তিন ভাইয়ের মধ্যে সব বুদ্ধি একা তালুকদার মাথায় নিয়া রাখসে মনে লয়।’ এই একটা বাক্যই রতনের এতক্ষণ যাবত মনের ভেতরের জমিয়ে রাখা সব সন্দেহ দূর করে দেয়। একটু কি অনুশোচনা হয় নিজের ভুল চিন্তা ভাবনার জন্য।
রতনের ঘুরে দাঁড়াবার পরক্ষণেই ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতে দেরী করেনা ওয়াদুদ। রতন কোন কথা শুনে ফেলেনি তো? রতনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেটা ভোর সকালেই ওয়াদুদ শুনেছে। পুলিশের রেইড হতেই পারে এটা বুঝেই ওয়াদুদ লোকদের সাজিয়েছে ওভাবে। নিজের ভাই বা মেয়েজামাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনলেও ওয়াদুদকে কখনোই আনতোনা এটা সে গত কয়েকমাসে বেশ হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছে। তাই গুদামে আগুন দেয়ার পরিকল্পনাটুকু খুব সাবধানে করতে হয়েছে। সব লোক ঠিক করা বা কথা বলা সব রতনকে দিয়ে করিয়েছে আর সে শুধু দূর থেকে তদারকি করেছে। পুলিশের তদন্তে তাই রতন আর আসলাম সহসা ধরা খেয়ে গেলেও ওয়াদুদের নাম আর আসার সুযোগ পায়না। ওয়াদুদের পরের পদক্ষেপ ঠিক করা আছে আড়তের ঘরে লোক পাঠিয়ে কিছু দলিল সরিয়ে আনা যাতে করে সে তালুকদারের বিপক্ষে মামলা লড়তে পারে। আগুন লাগার রাতে তালুকদারের আড়তের পেছনের অফিস থেকে দুটো ফাইল যদিও আনতে পেরেছে কিন্তু তাড়াহুড়োয় ভুল দলিল নিয়ে এসেছে।

সময় আসলে আবারো কিভাবে কিভাবে যেন তালুকদারের পক্ষেই চলে যাচ্ছে। ছেলেটাকে ডাক্তার বৈদ্য করে সুস্থ করে আনলো। ছেলের ভেঙে যাওয়া সংসার জোড়া দিয়ে ফেললো। ছেলের বৌ এখন রীতিমত ব্যবসার দেখাশোনায় অংশীদার। নাজমাকে ও যে কোথায় সরিয়ে দিল কেউ বলতে পারছেনা সেভাবে। রাতে শুয়ে শুয়ে আর কি কি উপায়ে তালুকদারের ক্ষতি করা যায় ভাবতেই হুট করে অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা মাথায় চলে আসে। আজিজ মিয়াদের বাড়ির কাছাকাছি এক গৃহস্থের মেয়ের সর্বনাশ করেছিল তালুকদার। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে আর খুব বেশী কথা হয়নি গ্রামে বা ঐ পরিবারের কেউ কোন ঝামেলার খবরও পাওয়া যায়নি, সাথে এই ব্যাপারে মোটা অংকের টাকা বখশিশ পেয়ে পুরো ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ওয়াদুদ। খুঁজে বের করতে হবে সেই মেয়েকে সাথে নাজমা কে। নাজমার মা কে দিয়ে মেয়ে গুমের একটা কেস ও সাজানো যায়।
নিজের জীবনের এমন অন্ধকার সময়ের দুটো আলোর পথের দিশা পেয়ে ওয়াদুদের মন যারপরনাই আনন্দিত হয়ে উঠলো। কাল সারাদিন একটু এদিক ওদিক ঘুরে চারদিকের ভাব বুঝে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দেবে এরকম ভাবনাই করে রাখলো সে রাতের মত।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কাল পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় যেয়ে গড়াবে তা বুঝতে পারলে বোধকরি লোকে তখনকার সিদ্ধান্ত তখনই নিতে দ্বিধা করতোনা কখনোই।
‘রতন একটা বলদ, সব বুদ্ধি পাইসে তালুকদার’ এই একটা লাইন বাড়ি ফেরার পুরো পথ রতনের মাথায় বনবন করে ঘুরতে লাগলো। কি মানুষের সাথে হাত মিলিয়েছিল এটা ভেবে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে যাচ্ছিল বুঝি ক্ষণে ক্ষণে। পুরো পাড়ার লোকে জেনে গেছে তাকে থানায় নেয়া হয়েছে, কি লজ্জা কি লজ্জা। পুরোটা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা রতন।
ভোরের আলো উঁকি না দিতেই ঘরের দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসে রতন। গন্তব্য তালুকদার বাড়ি। এতোদিন তাও জুয়ার ঠেকে ঠেক দিয়ে রেখেছে জমি বেঁচে টাকা দিয়ে দেবে বলে। আজকের পর ওরাই টাকার জন্য বাড়ির দখল নিতে আসলে ওর আর কিছু করার থাকবেনা। বৌ বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় যেয়ে দাঁড়াতে হবে। আর এই অবস্থা থেকে একমাত্র তাকে বাঁচাতে পারে তালুকদারই।

ফজরের ওয়াক্ত শেষে কিছুক্ষণ ঘুমানো তালুকদারের নিত্যদিনের স্বভাব। সকালে বাড়ির সবাই মিলে অনেকদিন পর নাস্তা খাবেন এই আনন্দে আর ঘুম এলোনা সেভাবে। গতকাল যে যার গন্তব্য থেকে বাড়ি ফিরতে এতো উল্টাপাল্টা সময় হয়েছে যে চাইলেও একসাথে খেতে বসা হয়নি কারো। তার ওপর তালুকদার কথা সাজিয়ে রেখেছেন আজ ছেলেকে বলবেন এখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে বসার কথা। সব মিলিয়ে নিজের ভেতরে নিজেই খুব উচ্ছ্বসিত। সদর দরজার মুখে কারো কথা কাটাকাটি শুনে নিজেই দোর খুলে এগিয়ে যান, কে এলো এই সাত সকালে?
দরজার মুখে উদ্ভ্রান্ত রতনকে দেখে প্রথমেই তালুকদারের মনে হলো আবার না জানি কি কূটচাল নিয়ে হাজির হয়েছে? তাকে বেশী ভাবার সুযোগ না দিয়েই রতন তার পায়ের ওপর পরে গেলো।
– আমার ভুল হইয়া গেসে ভাইজান। আমারে মাফ করেন। আমি আর কোনদিন আপনের পিছে লাগুমনা। আমারে আপনে বাঁচান।
দরজার সামনে নাটক বন্ধ কর রতন। ঘরে আয়।
কিছুক্ষণ সময় দেয়ার পর রতন আস্তে আস্তে একটু শান্ত হয়ে আসে।
– ভাইজান আপনে তো জানেন আমার নিজের বইলা ঐ বসত ভিটা ছাড়া আর কোন জমি নাই। জুয়ার ঠেকে অনেক টাকা ঋণ হইসে ঐ টা শোধ দিতে না পারলে আমার বাড়ি দখল নিব তারা। আপনে কন আমি এখন কি করুম?
আমার পেছনে লাগার সময় এই কথা মনে আছিলো না? তখন তো খুব ওয়াদুদরে বন্ধু বানাইছত, এখন ঠেকায় পড়ছিস আর ভাইরে দরকার?
– ভাইজান আপনে ছাড়া আমার আর কোন উপায় নাই। আপনে আমার ঋণ শোধ দিয়া দেন আমি আপনের যেই কাম কইবেন কইরা সেই ঋণ শোধ দিমু।
তোরে ক্যান বিশ্বাস করতে হইবো? তুই আমার ভাই দেইখা?
– আমি তাইলে কি করুম আপনেই কইয়া দেন। আমি কাইল সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই।
শুন রতন তুই আইসা কইলি তোর এতো টেকা ঋণ আমি শোধ কইরা দিমু, আর আমি শোধ দিয়া দিলাম। আমার কি টেকার গাছ আছে? তারপরও যখন ভাইয়ের কাছে আইছস আমি তোরে ফিরায়া দিমুনা। তয় আমার শর্ত আছে।
– কি শর্ত কন। আমি সব শর্তে রাজি।
না শুইনা ফাল পারস ক্যান? কথা শুইনা তারপর সিদ্ধান্ত দিবি। ওয়াদুদের লগে আমার পুরানা একটা হিসাব আছে। আমি ওর নামে কেইস দিয়া ওরে জেলে ঢুকামু। যা প্রমাণ সাক্ষী সাবুদ লাগে যোগাড় হইবো। কিন্তু তুই হবি তুরুপের তাস, কারণ তুই তার অনেক গোপন খবর জানস। কি, রাজী? এই বিষয়ক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবো তোর ঋণ শোধ হওয়া। ভাইবা চিন্তা জবাব দিবি।
এখন গোসল দিয়া আয়, আমগো লগে নাস্তা খাবি। কাইল থেইকা আড়তে যেন তোরে কামে দেখি।

রক্তের বন্ধন বুঝি চাইলেও অগ্রাহ্য করা যায়না। আর তাই ভাই বলে এসে রতন পায়ে পরার পর তালুকদার পারলেন না নিজেকে কঠিন খোলসে ধরে রাখতে। ভাইয়ের ভবিষ্যতটুকু ঠিকই নিশ্চিত করার প্রত্যক্ষ আশ্বাস না দিলেও পরোক্ষভাবে তো বুঝিয়ে দিলেন আমি আছি তোর পাশে। সম্পর্কগুলো বুঝি এমনই। বোঝাবুঝির ভুলে কখনো তাতে চির ধরলেও একজনও যদি ভালবেসে এগিয়ে আসে বাকীরাও হাত বাড়ায় তা টিকিয়ে রাখতে। পৃথিবীটা বুঝি এ কারণেই এখনো বাসযোগ্য রয়েছে।

-ডা.জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *