অনুধাবন ( ৩ য় পর্ব )

(নাজমা)

আমাকে খুব ছোট রেখে আমার মা মারা যায়। বয়স বোধহয় তখন আট কি নয়। কি যেন এক কঠিন অসুখ হয়েছিল মায়ের। কিছু খেতে পারতোনা। বমি করে ফেলে দিতো খাবার মুখে দিয়েই। আমার সামান্য বেতনভুক কেরানী বাবার সামর্থ্য ছিল না মায়ের চিকিৎসা করায়। মা অবশ্য বাবাকে বেশী একটা কষ্ট দেয়নি। অল্প দিনের অসুস্থতায় এক ভোরে মারা যায়। কয়দিন আর না খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। নানাবাড়ির লোকেরা খুব হম্বিতম্বি করে কিছুদিন তারপর তারাও চুপ মেরে যায়। কে জানে আবার ওদের ঘাড়ে যদি আমাকে গছিয়ে দেয়া হয়। ওদের কথাবার্তা ছিল বাবার অবহেলায় মা মারা গেছে। আমার বাবা অবশ্য পুরো ব্যাপারেই নিশ্চুপ ছিলেন। যেন পৃথিবীর কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসেনা।

বাবা আর আমার দুজনের জীবন পরের কয়েক বছর কিন্তু ভালোই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ভালো ছিলেন না আমাদের পাড়া প্রতিবেশীরা। একলা পুরুষ কেমনে থাকে, মেয়েরে কে দেখে রাখবে এসব কথার জোয়ারে বাবাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। ফলাফল পাড়ার লোকের চাপে বাবা ঘরে নতুন মা কে নিয়ে এলেন। নতুন মা মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সে গল্পে যাব না।কিন্ত যেটা না বললেই না, তা হচ্ছে ওনার বহুরূপী চেহারা। বাবা বাসায় এলে পারলে আমায় কোলে তুলে রাখেন আর বাসা থেকে বের হলেই আমি হয়ে যাই ওনার কাজের লোক। আর তার সাথে থেকে থেকে বাবার সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনে যাই। যেমন বাবা একটা অপদার্থ, জড়ভরত, অকাজের ডিপো; ওনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এই লোককে বিয়ে করা। অথচ উনি নিজে কিন্তু গ্রামের মেয়ে, তেমন কোন বড় ঘর থেকেও আসেননি।

মফস্বলে বা গ্রাম এলাকায় মেয়ে মানুষ বেশ তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। আর নিজেরা না বুঝলেও পাড়ার লোকে বাড়ি বয়ে এসে বুঝিয়ে বলে যায় মেয়ে বড় হয়েছে।যেন যার বিয়া তার খবর নাই পাড়া পড়শীর ঘুম নাই টাইপ অবস্থা। ক্লাস টেন না উঠতেই চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব, যখন তখন বাড়ির সামনে ছেলেদের আনাগোনা। প্রতিটা ছেলের উপস্থিতি আমার পিঠে মায়ের সৃষ্ট কিছু নতুন নতুন নীল দাগের জন্ম দিত। অথচ আমি তাদের অনেককেই চিনিও না।

বাবার শরীরও দিন দিন ভাঙছিল। কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নেয়ার মতো পয়সা কই? বাবা বুঝেও তাই চুপ করে থাকতেন নিজের ব্যাপারে। আমার সাথে নতুন মায়ের ব্যবহারে কষ্ট পেতেন কিন্তু কাউকেই কিছু না বলে কেমন যেন থম ধরে থাকতেন। যেন এই বিশ্বসংসারে উনি কেবলই নীরব দর্শক। সৃষ্টিকর্তা যেন একটা অন্ধকার কর্দমাক্ত পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখতেই আমায় এমন একটা পরিবেশে জন্ম দিয়েছিলেন। আর তাই আমার পৃথিবী পুরো অন্ধকার করে দিতেই কয়দিনের জ্বরে ভুগে বাবাও মারা যান। পুরো পৃথিবীতে আমার আপনজন বলতে আমার সৎ মা যে কি না আসতে যেতে আমার গায়ে হাত তুলে আরাম পান। বাহ , বেঁচে থাকার কি দারুন আয়োজন। ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। কিন্তু যাব কোথায়? কাউকেই তো চিনিনা। শুধুমাত্র ইন্টার পাশ আমাকে কে চাকুরী দেবে?

বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই মা কে দেখতাম পাশের মোড়ের মুদি দোকানদারের সাথে বেশ খাতির। বাজার সদাই কিভাবে কিভাবে যেন নিয়ে আসতেন প্রায়শই। পৃথিবীটা যাদের জন্য দিন আনি দিন খাই টাইপ তারা খেতে পেলেই খুশী হয়। খাবার কোথা থেকে আসছে তার পেছনের কারণ খুঁজে অযথা সময় নষ্ট করেনা। ভাবনা দিয়ে যে পরের বেলার খাবার জোটানো যায়না। মায়ের টাকার উৎস জানতে পেরেছি তার কিছুদিন পরেই। মুদি দোকানদার তার দোকানের পেছনে রাখা মালের সাথে আনা কিছু ড্রাগ মায়ের কাছে গচ্ছিত রাখতেন কারণ দোকান যখন তখন পুলিশ রেইড দিত।

ইন্টারের রেজাল্টের পর বাবা চেয়েছিলেন অনার্সে ভর্তি করাবেন। কিন্তু তার আগেই পৃথিবীর মঞ্চ থেকে ওনার বিদায় আমার পৃথিবীকে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকূপে ছুঁড়ে দিল। বছর ঘুরলেও পড়াশোনা আর করা হয়নি। আমার এই বেলা খুব অবাক লাগে আমার সৎ মা চাইলেই আমার জীবনটা আরো বাজেভাবে নষ্ট করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে উনি একটা মাদকাসক্ত ছেলে খুঁজে এনে তার গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিলেন। বলা চলে বস্তাভরে বিড়াল পার করলেন। আর আমি সেই বস্তা করে এক আড়তদারের একমাত্র মাদকাসক্ত ছেলের ছোটবৌ হিসেবে এই বাড়িতে থাকার জন্য একটা ঘর পেয়ে গেলাম। রাসেল নামে আমার স্বামীর নাকি অনেক টাকা মুদি দোকানে আর মায়ের কাছে ড্রাগের জন্য জমা হয়ে গেছিল। তাই ঋণ শোধ করা হিসেবে আমাকে বিয়ে করে তিনি ঋণ মুক্ত হলেন। কি চমৎকার হিসেব। আমি যেন জীবন মুক্তির বাটখারা। ওজন কম তাই এমন স্বামী।

আমি এই বাড়ি আসার আগে জানতামনা রাসেল বিবাহিত। আমার সৎ মা হয়তো জানতেন। কিন্তু আমাকে পার করে দেয়ার নিমিত্তে হয়তো এর চেয়ে ভালো কোন উপায় ওনার হাতে ছিল না। আমি কিন্তু ওনার ওপর এদিক দিয়ে ভীষণ খুশী। বেশীর ভাগ এসব ড্রাগ এডিক্ট দেখা যায় রাস্তাঘাটের মানুষ। কিন্তু আমার স্বামীর বাড়িতে তো অন্তত দুবেলা খাওয়া পরার ব্যবস্থা আছে। শুধু একটাই কষ্ট আমার আগমনে এ বাড়ির আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙলো। এতো ফুটফুটে একটা মেয়ে আর বৌ থাকতেও এই লোক নেশার পেছনে কেন ছোটে তাই আমার মাথায় ঢোকেনা।

আমার উপস্থিতির সাথে সাথে লিমা নামের আমার সতীন মেয়ের হাত ধরে গটগট করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আমি মুগ্ধ নয়নে ওনার চলে যাওয়া দেখি। কি দৃঢ়তা ওনার প্রতিটা পদক্ষেপে। নিশ্চয়ই পড়াশোনা জানে নয়তো বাবার বাড়ি অনেক ধনী। অথচ এই আমি পরগাছার চেয়েও খারাপ যার জীবন, না আছে পড়ালেখা, না আছে বাপের ঘর। এ বাড়িতে কোনরকমে ঝুলে থাকলে অন্তত ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারবো, এই ভাবনায় বেঁচে থাকার নিমিত্তে তাই হেঁসেলের দায়িত্ব বুঝে নিতে যাই। প্রথম কয়েকদিন বাড়ির কেউ কথা না বললেও যার যার কাজের আরাম হওয়াতে সবাই একটু আধটু মিশতে শুরু করলো। আর রাসেল যেন আমার মায়ের ঋণ শোধ করেই তার দায়িত্ব শেষ। আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি সেভাবে। অবশ্য মাদকের নেশা যার শরীরে পৃথিবীর বাকী সব তার কাছে বিবর্ণ লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

দুমাস না ঘুরতেই এক বিকেলে উঠোনে লোকের হুটোপাটি শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি লিমা আপা মানে আমার সতীন তার মেয়েকে নিয়ে উঠোনে দাঁড়ানো। ক্লান্ত বিষন্ন অবয়ব বলে দিচ্ছিলো ওনার শরীর ভালো নেই। চলে যাওয়ার দিনের দৃঢ়তার ছিটেফোঁটাও নেই ওনার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে। বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাছে শুনলাম ওনার বাচ্চা হবে আবার, রাসেল গিয়ে ওনাকে জোর করে ধরে এনেছে। নিজের অবস্থান না নড়বড়ে হয়ে যায় এটা প্রথম মাথায় এলেও অন্য একটা খারাপ লাগায় মনটা ভার হয়ে গেলো। আমি খুব চেয়েছিলাম লিমা নামের উনি নিজের পায়ে দাঁড়াক।

মেয়েদের জীবন বোধহয় এমনই। পুরুষের ইচ্ছা স্বাধীন জীবন, আকাশের ঘুড়ির লেজের মতো, যেদিক তারা নাড়াবে নড়বে নয়তো মাটিতে ফেলে রাখলে পরে থাকবে। ওরা আবার মানুষ নাকি?

বিকেল হতেই লিমা আপার ঘরের দিক থেকে জোর কান্নার আওয়াজে ছুটে যাই। দরজার ফাঁক গলে দেখলাম উনি পাগলের মতো তিতলীর চুল টানছে। নিজের জীবনের নিস্ফল আক্রোশ বুঝি মেয়ের ওপর মেটাচ্ছে? ভেবেছিলাম ধরতে যাব, কিন্তু গাল বাড়িয়ে চড় খেয়ে ব্যথা পেতে ইচ্ছে করছিলো না। আবার অন্যদিকে তিতলীর জন্যও মায়া লাগছিল। ভাগ্যিস আমার শ্বাশুড়ি  আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এসেছিলেন। আস্তে করে ঘরের পেছনে সরে যাই আমি। এত কান্ড যে কিছুটা আমার জন্য তা বেশ আঁচ করতে পারি, কারণ তিতলীর চুলগুলো দুপুরবেলা আমিই বেঁধে দিয়েছিলাম। তিতলীর মাঝে কেন যে নিজের ছোটবেলার ছবি দেখি নিজেও জানিনা। আমার তো তাও বাবা ছিল অন্তত কিছুদিন নিজের মতো করে। ওর যে তাও নেই।

চলবে..

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *