অনুধাবন (৪র্থ পর্ব )

(তালুকদার সাহেব)

রাসেলদের বাড়িটা মফস্বল শহরের একটু বাইরের দিকে হওয়াতে বেশ বড় জায়গার ওপর করা গেছে। পুরো বাড়িটার মোট চার অংশ। উঠোন মাঝখানে রেখে চারটা ঘর তোলা হয়েছে। প্রতিটা অংশেই রয়েছে তিনটা করে রুম। একটাতে রাসেলের বাবা মা থাকেন, একটাতে রাসেলের পরিবার, একটা রেখেছেন দুই মেয়ে বেড়াতে এলে থাকার জন্য আর একটা ঘরে বাড়ির কাজ করার লোকেদের থাকা সহ রান্না ও খাওয়ার ব্যবস্থা। রাসেলের বাবা তালুকদার সাহেব চেয়েছিলেন এ ঘরের কথা ও ঘরে গিয়ে যেন কান কথা না হয় তাই যার যার আলাদা ঘর রাখতে। কিন্তু তাই বলে দুঃস্বপ্নে ও ভাবেন নি মেয়েদের জন্য রাখা ঘরও ছেলের অপকর্মের দায় হিসেবে অন্যের মেয়ের ঘর হয়ে যাবে।

তালুকদার সাহেব মানে রাসেলের বাবারা ছিলেন তিন ভাই। বাবা কৃষক হলেও নিজের যথেষ্ট ধানী জমি থাকাতে সারা বছর খেয়ে পরে ভালোই দিন কেটে যেত। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেঝো তালুকদার সাহেব স্কুলের গন্ডি পেরোলেও বাকী দুই ভাই স্কুলের উঠোন মাড়াননি। ফলাফল যাবতীয় বাবার দিনের সব সহায় সম্পত্তির কাগুজে হিসাব জানেন শুধু তালুকদার সাহেব। নিজের বুদ্ধি আর বিচক্ষনতা দিয়ে তিনি শুধু নিজের ব্যবসাই বাড়াননি, তার সাথে হস্তগত করেছেন পিতৃসূত্রে প্রদত্ত ভাইদের সম্পদ, জমিজমাও। আপাত দৃষ্টিতে সবাই জানে ভাইয়েরা যার যার সম্পত্তিতে চাষবাস করে খাচ্ছেন। বছর বছর খাজনাটুকুও তারাই দিচ্ছেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে সিংহভাগ জমির কাগজ কলমে মালিক তালুকদার সাহেব। এই সমস্ত তথ্য ওনার বিশ্বস্ত কর্মচারী ওয়াদুদ আর আড়তের ম্যানেজার ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমনকি রাসেলের মা আসমা খাতুন ও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অবশ্য মেয়েমানুষের বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে নাক গলানো তালুকদার সাহেবের পছন্দ না।

‘মেয়েমানুষ সংসার করবে, ঘর সামলাবে, বাচ্চার যত্ন নেবে, সময়ে অসময়ে এক আধবার গয়না শাড়ির আবদার করবে; স্বামীর মন ভালো থাকলে গয়না না মিললেও নিদেনপক্ষে একটা শাড়ি হয়তো মিলবে। পয়সার টানাটানি থাকলে হয়তো এক ডজন কাঁচের চুড়ি নয়তো রঙিন ফিতা। বয়স ফুরাবে টুক করে মরে যাবে। পুরো দুনিয়ার রঙের মেলার খবর জানলেই ওরা ঘরে ঘোট পাকাবে।’ এরকম বিশ্বাস নিয়ে ই তালুকদার সাহেব চলেন। আর তাই নিজের মেয়েদেরও তাই খুব একটা পড়ালেখা করাননি। বেশ ভালো মানের যৌতুক সহকারে বিয়ে, ঈদ পার্বণে ঝুড়ি ভরে উপহার পাঠানো আর ছমাসে ন’মাসে মেয়েকে নাইওর আনাই বাপ হিসাবে ওনার কর্তব্য ভেবেছেন।

অন্যদিকে ছেলেমানুষ বংশের বাতি, অনেক পড়াশোনা না করলেও ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার মতো হিসাব আর বুদ্ধি থাকলেই হবে ভেবে ছেলে রাসেলের পড়াশোনা নিয়েও খুব একটা মাথা তিনি কখনোই ঘামাননি। ছেলে ক্লাসের পর ক্লাস ওপরে উঠছিল, যখন যা লাগবে এনে দিচ্ছিলেন। তাই ঠিক কখন লাগাম ধরতে হবে কেন যেন ঠাঁহর করতে পারেননি সেভাবে। আর তাই কোনরকমে ঠেলেঠুলে বিএ পাস করার পরপরই যখন রাসেল পড়া থামিয়ে দেয় উনি ভাবলেন ওনার ব্যবসা চালাতে এর বেশী বিদ্যা দিগগজ না হলেও চলবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধায় ছেলের উড়ু উড়ু মন। সে এক আধদিন আড়তের গদিতে ঢু মারার ছলে বসলেও সেসব দিনে ক্যাশের টাকায় গরমিল হতো শেষবেলা। থাক, একটাই ছেলে নিয়েছে কিছু টাকা ভেবে প্রথমদিকে তেমন পাত্তা দেননি। বাঁশ কাঁচা থাকতে যেমন পানিতে চুবিয়ে রাখতে হয় তেমনি ছেলেপেলেকে যথেচ্ছ অর্থ স্বাধীনতায় ডুবিয়ে রাখার মানে যে ভালবাসা নয় সেটা বুঝতে পেরেছেন যেদিন ছেলে সিগারেট খেয়ে এসে মুখের ওপর জানায় সে লিমাকে বিয়ে করতে চায়।

খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন তিনি ছেলের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে। রাসেলের মা বোঝান, বিয়ে দিলে যদি ছেলের মতিগতি ফেরে, তার ওপর লিমাদের পরিবার অনেক বিত্তশালী না হলেও সমাজে একটা ভালো অবস্থানে আছে। সেই প্রথম মেয়ে মানুষের সাংসারিক বুদ্ধিতে গলে গিয়ে তিনি ছেলের বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, যেটা লিমার বাবা মোতালেব সাহেব গাইগুই করে নাকচ করে দেন। এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় প্রথমদিকে ক্ষেপে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নেন তিনি। আর তারপর যখন ছেলে মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে আসে তখন তো আর কিছু বলার মতো ভাষাই খুঁজে পাননা। কিন্তু একদিকে মনে মনে খুশী হন লিমার বাবাকে যথার্থ জবাব দেয়া গেছে ভেবে। অন্যদিকে ছেলের বিয়ে বাবদ কোন যৌতুক পাওয়া যায়নি ভেবে মন খানিকটা খারাপ ও হয়। তারপরও যদি ছেলে নতুন বৌয়ের উছিলায় ঘরে আর কাজে মন দেয় সে আশায় ঐ ব্যাপারটা উনি ভুলে গিয়েছিলেন।

প্রথম দিকে যখন জানলেন ছেলে একটু আধটু মদ গাঁজা খায়, তত পাত্তা দেননি। বয়সের দোষ ঠিক হয়ে যাবে ভেবে চুপ করেছিলেন। তারপর করলো বিয়ে। ভাবলেন এবার হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু না কয়েক মাস ঘুরতেই ছেলে আবার যে কি সেই। নাতনীটা হওয়ার পর ভাবলেন এবার নিশ্চয়ই কোন পরিবর্তন হবে। কিছুই তো হয়নি বরং মাঝখান থেকে ঘরে বিয়ে করা বৌ থাকতেও কোথাকার এক গরীব ঘরের মেয়েকে তুলে এনেছে ঘরে।

পৃথিবীতে পরম ভালো বা চরম খারাপ বলে কোন মানুষ বোধহয় নেই। তালুকদার সাহেব ইদানীং প্রায়ই ভাবেন ছেলের এই বখে যাওয়া কি ওনার কোন পাপের ফল? এটা সত্যি উনি ভাইদের জমিজমা নিজের নামে করে রেখেছেন। এমনকি ওনার বর্তমান বসতভিটাও এতো ছড়িয়ে করেছেন যেন অন্য কোন ভাই এসে জায়গা দখল করতে না পারে। যদিও এটা ওনাদের পৈতৃক জায়গা ছিল কিন্তু বর্তমানে এর বাদ খারিজ উনিই করেন কারণ দলিলে ওনার নাম এবং ভোগ দখলও উনিই করছেন। কিন্তু তাই বলে উনি ভাইদের সম্পত্তি বা জমি থেকে কখনো কোন ফসল আনেন না শুধু ওনার ম্যানেজার খেয়াল রাখেন যেন খাজনা দেয়া হয় নিয়মিত। এমনকি শহরে কোন কাজে ভাই বা তার পরিবারের কেউ এলে তিনি যত্নের ত্রুটি করেন না। তাহলে ওনার ভাগ্যে কেন এমন কিছু হতে হবে?

লিমা যখন পড়তে চাইলো, আসমা বেগম বাঁধা দিলেও উনি পড়ার অনুমতি দিয়েছেন। ছেলের মতিগতি ভালো ঠেকেনি ওনার ব্যবসায়ী চোখে। তাই ভেবেছেন ছেলেকে সামনে রেখে পেছনে লিমা যদি হাল ধরে দাঁড়ায় তবে ব্যবসা অন্তত টিকে থাকবে। তার ওপর ইদানীং আরো অনেকে ওনার ব্যবসার দিকে নজর দিচ্ছে। বিশেষ করে বড়ভাইয়ের দুই ছেলে সেদিন এসেছিল আড়তে কথা বলতে। নিজের ভাইদের এটা সেটা বলে বুঝ দিয়ে রাখলেও ভাইয়ের পড়ালেখা জানা ছেলেদের কি বলে বুঝ দিবেন সেটা এখনো বুঝতে পারছেন না। এসময় রাসেলের উপস্থিতি পাশে বড় বেশী দরকার ছিল।

নিজের জীবনের নানা কথা ভাবতে ভাবতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিলেন। মদ্যপ মাতাল হয়ে যার ছেলে গভীর রাতে ঘরে ফেরে সেই ঘরের বাবা কি আর রাতে ঘুমাতে পারে? নিজে না গেলেও আসমা বেগম গিয়েছেন ছেলেকে উঠোন থেকে তুলে রুমে দিয়ে আসতে। ছেলের দু বৌয়ের কেউ এগিয়ে আসেনি জানালা দিয়ে দেখেছেন। ভেবেছিলেন নিজের বৌ কেও বলবেন না যেতে। মায়া বড় সাংঘাতিক জিনিস। তাই নিজে থেকে আসমাকে না করেন নি। নিজের তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড়ের খানিক ধ্বংসের রূপ কি উনি দেখলেন আজ বমি করতে করতে পরে যাওয়া ছেলের শরীরি অবয়বে?

আসমা বেগম বোধহয় ছেলেকে রুমে শুইয়ে তারপর রুমে এলেন। বিছানায় এসে আলতো করে তালুকদার সাহেবের গায়ে হাত রাখতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।

‘আমার ছেলেটা কেন এভাবে বখে গেলো আসমা, বলতে পারো? আমাদের কোথায় ভুল ছিল? আমি তো কখনো ওর কোন কিছুতে বাঁধা দেইনি। ভালবাসা আর মায়ার মূল্য কেন আমাদেরকেই এভাবে পেতে হচ্ছে?’ গভীর রাতে একজন আজন্ম গাম্ভীর্যের মুখোশ পরা বাবার আর্তনাদ যেন ঘরের প্রতিটি কোনে ছড়িয়ে পরলো। নিজের আশু ধ্বংসের প্রারম্ভিক দর্শনে তার শরীর মন যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। একটুখানি সান্ত্বনা পেতেই বুঝি আসমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে নিজের মনের আগল খুলে জীবনে দীর্ঘদিন পরে কেঁদে উঠলেন।

জীবনের হিসেবগুলো যেন কেমন? যতদিন বেঁচে থাকা ততদিনই কারো না কারো কর্মফলের ভার বহন করে যেতে হয় প্রতিটা মানুষকে। হয় নিজের নয়তো নিজের আত্মজার। ব্যর্থতার গ্লানিতে পোড়ার মত কষ্ট বুঝি পৃথিবীর আর কোন কিছুতেই নেই।

চলবে….

-ডা.জান্নাতুল ফেরদৌস

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *