অরিত্রি তোমাকে বলছি

অরিত্রি তুমি কি নিয়ে ধরা খেয়েছিলে স্কুলে?? মোবাইল?? আর আমার এক বন্ধু ধরা খেয়েছিল নীল বই সহ!! সেন্ট্রাল গভমেন্টের মন্ডল স্যারের সে কি মার!! তারপরে বেঞ্চের নিচে মাথা দিয়ে রাখা!! তার কিছুদিন পর বন্ধু আমার সিডি নিয়ে আসে স্কুলে!! বইয়ের দিন শেষ এখন থেকে আদান প্রদান হবে সিডির!! আমার সেই বন্ধু এখন একজন বিসিএস ক্যাডার!! মেধা দিয়ে এই ছেলে একদিন সচিব হবে এদেশের আমি তা লিখে দিতে পারি!! সেদিন অবশ্য গার্জিয়ান ডাকা হয় নাই স্কুলে!! গার্জিয়ান ডাকা হয়েছিল আমার!! কলেজে থাকতে এক ছেলেকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম আমরা বন্ধুরা মিলে!! হ্যা বালিকা ঘঠিত ব্যাপার ছিল!! আব্বা আসেন কলেজে!! সব শুনে স্যারকে বললেন নেক্সট টাইম আমাকে আর কলেজে ডাকবেন না, বাঁশ দিয়ে পিটাবেন ছেলে অপরাধ করলে!! আরেকবার আব্বাকে ডাকা হয় কলেজে চুল কাটি নাই বলে!! স্যারকে বলেছিলাম স্যার আমার মানত আছে তাই চুল কাঁটা নিষেধ!! হঠাৎ শুনি আব্বা কলেজের অফিস রুমে!! স্যারের সামনেই আব্বা জিজ্ঞেস করলো কিসের মানত তোর?? জানো অরিত্রি স্যারের সামনে বসে থেকেই আব্বা আমাকে স্যালুনে পাঠায় চুল কাটতে!! প্রতিশোধ নেই নাই ভাবছ?? কলেজের লাইট খুলে নিয়ে বেঁচে দেই!! বন্ধুরা সেই টাকায় পরোটা ভাজি খাই!! টোকাই দিয়ে স্যারের মোবাইল ছিনতাই করাই!!

আরেকবার কি হইছে শুনো পকেটে টাকা শেষ নাস্তা করা লাগবে ফ্রেন্ডের অসুখের কথা বলে ক্লাসে ক্লাসে টাকা উঠিয়ে নাস্তা করি আমরা!! প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কানে যায় সে খবর!! ম্যাডাম ডেকে পাঠায় আমায়!! বললেন এরপর ক্ষুধা লাগলে আমার কাছে আসবা আর যদি ক্লাসে ক্লাসে বাঁদরামি করছো তাইলে খবর আছে!!

অরিত্রি জানো খুব বাজে ছাত্র ছিলাম আমি!! ক্লাস সেভেনে বার্ষিক পরীক্ষায় অংকে দুই পাই বলে আমাকে এইটে উঠতে দিবে না বলে স্কুল বদলিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হই আমি!! জানো এরপর এইটে বার্ষিক পরীক্ষায় আমি অংকে নিরানব্বই পাই!! কখনো অংকে আর ফেইল করি নাই!! রেজাল্ট খারাপের জন্য আত্মহত্যা করতে আমারো একবার ইচ্ছা করেছিল কলেজের রেজাল্টের পর!! আব্বার সে কি গালি!! ঝুলে পড়ার চিন্তায় আম্মার শাড়িটা বের করতেই নাকে আসে গরুর মাংসের গন্ধ!! চোখ মুছতে মুছতে রান্না ঘরে গিয়ে আম্মাকে বলি তরকারিতে আলু দিয়েন!! আলু ছাড়া গরুর মাংসের স্বাদ নাই!! সেদিন আমাকে আত্মহত্যার থেকে রক্ষা করে গরুর মাংস!!

চিন্তা করো সেদিন মারা গেলে আম্মার হাতের রান্না মিস হয়ে যেত!! ভাগ্যিস ঝুলি নাই!! এখনো মাঝে মাঝে ঝুলতে ইচ্ছা করে জানো!! তবে সেই চিন্তায় বাঁধা দেয় ছোট ভাই বোন!! মনেহয় ঝুলতে গেলেই ভাই এসে জাপটে ধরবে পা, বোন আঁকড়ে ধরবে শার্ট!! আব্বা চিল্লান দিয়া বলবে আমার ওষুধ শেষ আর তুই যাস ঝুলতে?? আম্মার লাগবে ময়দা সকালের রুটির জন্য!! এই মানুষগুলার প্রতি কত দায়িত্ব আমার আর আমি কিনা স্বার্থপরের মত ঝুলে পড়বো?? নাহ তা হয় না!! কত কত ভালোবাসার মানুষ চারপাশে আছে জানো অরিত্রি?? ছাদে ফুল ছেঁড়ার জন্য যে বাড়িওয়ালা চাচা তোমাকে বকা দিয়েছিল সেও আজ তোমার মৃত্যুর জন্য চিৎকার করে কেঁদেছে!! যে রিকশাওয়ালা মামা তোমায় নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেত সেও আপামণি আপামণি করে কেঁদেছে আর তুমি কিনা তাদের ভালোবাসাকে এভাবে অপমান করলে??

অরিত্রি আত্মহত্যা কখনই সমাধান না!! আত্মহত্যা করলে করতে হবে প্রীতিলতার মত!! নাহয় সব আত্মহত্যাই অপমানের!! আমার মনে হয় আজ তোমারো ঠিক ফিরতে ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে, বাবার কোলে!! কিন্তু বড্ড ভুল হয়ে গেছে তাই না?? তুমি ওপারে ভালো থাকো আপু!! যদি আবার ফিরে আসো তবে প্রাণ ভরে বেঁচো, বার্ধক্যে মরো!!

আমরা এমন হয়ে যাচ্ছি কেন?? দিনদিন এত স্বার্থপর হচ্ছি কেন?? এক বিল্ডিংয়ে থাকি অথচ কেউ কাউকে চিনি না!! অথচ আমরা ছোট বেলায় গলিতে গলিতে খেলে বেড়াতাম পানি তৃষ্ণা ধরলে কার কার বাসায় চলে যেতাম তাও জানতাম না, কত যে পানির সাথে মিষ্টি বিস্কুট পেতাম!! সাথে মিষ্টি ধমক!! এভাবে রোদে রোদে ঘুইরো না পোলাপান, জ্বর বাধাইবা!! আসো মুখ মুইছা দেই!! আর সেদিনের কথা আমার বিড়ালটা হারিয়ে গেলে চারটা বাসায় যাই খুঁজতে একটাতেও ঘরের দড়জা খুলে নাই বাহির থেকে কথা বলা লাগছে!!! কি যে, কি যে লজ্জা অপমান লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না!! অথচ একটা সময়ে চেনা জানা সকলের বাসায় মানুষ আসা যাওয়া করতো!! শবে বরাতে রাস্তায় রাস্তায় পেপার দিয়ে হালুয়া রুটি নিয়ে পোলাপান এর বাসায় ওর বাসায় বেড়াতো এগুলা এখনকার পোলাপানরে বললে বলবে, এগুলা হাইস্যকর, পুরাই হাইস্যকর!! অথচ এইতো সেদিনের কথা মধ্য রাতে পাশের বাসায় চিৎকার শুনে আব্বা মামা লুঙি কাছা মেরে দা নিয়ে হাজির হয় পাশের বাসায়!! ভাই সাহেব ঘটনা বলেন খালি!! কে ডিস্টার্ব দিছে খালি বলে দেখেন!! ভাই ইন্দুর!! মেয়ের উপর ইন্দুর লাফ দিছে!! আশাহত হয়ে আব্বা মামা ইন্দুরের জান নিয়ে ফিরে আসে বাসায়!! আর এখন কেউ মরে গেলেও আমরা উঁকি দিয়ে দেখি না!!

অরিত্রিরা কিসের মাঝে বড় হচ্ছে একবার ভেবে দেখেছেন?? কেন তারা আত্মহত্যার দিকে যাবে?? কোন ভালোবাসার অভাবে?? শুধু শিক্ষকের দেয়া লজ্জা অপমানের কারনেই?? নাকি আরো কিছু আছে??

কেন এত এত ভালো রেজাল্ট করা লাগবে?? কেন এই সমাজে মানুষের আগে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দরকার?? কেন??

শিক্ষক হলেই সে সম্মানী হবে এটা কোন কথা না!! শিক্ষকতো পরীমলও ছিল, শিক্ষকতো পান্না মাস্টারও!! আবার শিক্ষক ছিলেন আমাদের বিলকিস আপা!! কথায় কথায় স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে তোদের স্যান্ডেলাইস করবো বলতেন!! আবার কোন ছাত্র ছাত্রীর কিছু হলে বুক আগলিয়ে রাখতেন!! শিক্ষক ছিলেন আমাদের ডেইজি আপা!! রাস্তায় দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতেন!! কত বৃষ্টি বাদলের দিন আপার বাসায় আশ্রয় নিয়েছি নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিতেন আপা!! অমরেশ স্যারের মত কঠিন মানুষ আমার জীবনে আমি দেখি নাই!! সেন্ট্রালের এস এস সির ফেয়ারওয়লের দিন স্যারের চোখে পানি দেখে পোলাপান বুঝেছিল স্যার আসলে নারিকেল!!

একটা মানুষের আত্মহত্যা কাউকে দোষী করে যেতে পারে না, অন্তত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তার অপরাধ!! তার আগেই কেন আমরা বিচার করে বসি?? যে শিক্ষককে নিয়ে আজকে কথা হচ্ছে সেই শিক্ষকের সন্তান যদি কেউ আজকে তার বাবাকে মাকে অপমানের জন্য আত্মহত্যা করে বসে তাহলে সেই মৃত্যুর জন্য কে শাস্তি পাবে??

আর এখন চারিদিকে দেখি খালি কোট বানানোর হিড়িক!! কারন কি?? কারন জব ইন্টারভিউতে নাকি কোট টাই লাগে!! আরে বাপের ঘাড়ে খাওয়া জবলেস একটা পোলা কোট টাই বানাবে কিভাবে এইটা ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বাররা কি বুঝেন না?? বন্ধুরে বললাম, বেটা ইন্টারভিউ দিতে যাবি লুঙি স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়া!! গিয়া কবি স্যার চাকুরী দিলে না কোট টাই বানামু!!

দিনদিন মানুষ মেশিন হয়ে যাচ্ছে!! ভালো রেজাল্টের জন্য এত এত দৌঁড় ঝাপ, চাকুরী না পেলে জীবন বৃথা, দ্রবমূল্যের সাথে চৌধুরীর চাওয়া পাওয়া!! মানুষ ঝুলবে নাতো কি করবে??

অরিত্রিরা সমাজের কাছে প্রশ্ন রেখেই ঝুলে!! সেই প্রশ্নের জবাব কি কারো কাছে আছে?? এই সমাজের মানুষরা কেন হারিয়ে যাচ্ছে কেউ কি জানেন??

ফজলে খোদা রায়হান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *