আত্নার আত্নীয়

আফা, এইডা কেমুন ইনসাফ ছাড়া ভাড়া দিলেন? টিভি সেন্টার থেইকা বাড্ডার ভাড়া দিলেন পনরো টেকা? এমন বাদলার দিনে ভাড়া বাড়ায়ে দ্যান।

– এই দূরত্বের ভাড়াতো পনেরো টাকাই দেই অন্যদিন।আপনি আজকে বেশী চাইছেন কেন?

অন্যদিন আর আজকা এক হইলো? পুরাটা রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজা আসছি।

– অন্যদিনতো গরমে পুড়ে তামা তামা হয়ে যান তার থেকে ভালো না? আরাম করে ঠান্ডায় ঠান্ডায় রিকশা চালালেন।

এতো কান্না পাচ্ছিলো, রিকশাওয়ালার পেছন ফিরে গজগজ করে বলতে থাকা বাজে কথাগুলো শুনে। আমার নিজেরো তো ইচ্ছে ছিল আরো পাঁচটা টাকা বাড়িয়ে দেই। কিন্তু কিভাবে বলি আমার ব্যাগে আর একটা ফুটো পয়সাও নেই। অন্যদিন আরো খানিকটা হেঁটে এসে রিকশা নেই যাতে পনেরো টাকা দিয়েই বাসায় ফেরা যায়। আজ হঠাৎ এতো জোরে বৃষ্টি নামলো রিকশা না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। বৃষ্টিভেজা মেয়ে শরীর দেখার জন্য কতজন যে রাস্তায় হা করে তাকিয়ে থাকে সে আমার মতো খেটে খাওয়া মেয়ে মাত্রই খুব ভালো জানে।

ছয়তলার সিড়ি ডিঙিয়ে বাসা পর্যন্ত যেতে এতো ক্লান্তি লাগছিলো আজ। চাকুরী, হাসপাতাল, বাসা এই চক্রে আটকে আছি গত কয়েক সপ্তাহ। মায়ের হঠাৎ করা স্ট্রোকটা আমাদের তিনজনের জীবনটাকে আরো জটিল করে দিয়েছে। বলা চলে রীতিমত গর্তে ফেলে দিয়েছে। বাবার একার রোজগারে খুব আহামরি ভালো না থাকলেও চলে যাচ্ছিলো আমাদের চারজনের সংসার। দুই বছর আগে হঠাৎ বাসের ধাক্কায় বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারের চাকাটাও সজোরে ধাক্কা খেয়ে থেমে যেতে নেয়। বাবার অফিস সহকারীরা নিতান্ত দয়াপরবশ হওয়াতে বাবার অফিসে জুনিয়র সেকশনে আমার চাকুরী হয়ে যায় শুধু অনার্সের সার্টিফিকেটটুকু দিয়েই। গত দুই বছর ধরেই মাস্টার্সে ভর্তির ভাবনা করলেও সময় আর অর্থের অসম বন্টন আমার সুযোগটাকে প্রতিবারই অন্ধকারে ঢেকে রাখে।

মা নিজ হাতে বাসা সামলে নিচ্ছিলেন সাথে টুকটাক সেলাই করতেন। আমার চাকুরী আর টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার ও কোনরকমে চলে যাচ্ছিল। চাচারা বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় পাছে আবার সম্পত্তির ভাগ চেয়ে বসি। ছোট ভাইটা এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। ও নিজেও একটা টিউশনি করে নিজের হাতখরচ চালাচ্ছে বলে রক্ষা। কিন্তু গত দেড়মাস ধরে মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে যা কিছু জমানো ছিল সবই খরচ হয়ে গেছে। কিভাবে যে সামনের দিনগুলো যাবে আমি সত্যি জানিনা।

আমাদের অবস্থার কথা শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক বিল কমিয়ে দিলেও চিকিৎসার খরচ দিনদিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবাই বলেছিল ঢাকা মেডিকেলে রাখলে খরচ কম পরবে। কিন্তু আমার বাসা থেকে ঢাকা মেডিকেল যেতেই দিন পার হয়ে যায়। তাই কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে কাছের একটা ক্লিনিকে রেখেছি। আমার বয়সী এক ডাক্তার কাপল আছে অরিন আর শোয়েব নামে যারা মায়ের খুব খেয়াল রেখেছে ভর্তির পর থেকেই। মাঝে মাঝে হাসপাতালে থাকার সময় টুকটাক গল্প হয় দুজনের সাথেই। অফিসে একটা লোনের আবেদন করেছি। কাল সেটা না পেলে সামনের সপ্তাহ থেকে না খেয়েই বুঝি থাকতে হবে। মায়ের চিকিৎসা চালানোতো দূর অস্ত।

জীবনের এই যাঁতাকলে নিত্য পিষ্ঠ হতে থাকা আমি বা আমার পরিবার যেন সুখ নামক শব্দটাকেই ভুলে গেছি পুরোপুরি। একটা স্বাভাবিক জীবনই যেখানে চালানো দায় সুখ শব্দ বুঝি সেথা বিলাসীতার নামান্তর। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেব নিকেশ যে কিভাবে বিধাতা করেন তা বোঝা বড় দায়। কেউ না চাইতেই সব পেয়ে যায়, আর কেউ চেয়েও একটা স্বাভাবিক জীবন ও হয়তো কাটিয়ে যেতে পারেনা।

………………

আজ সারাদিন খুব রোগীর চাপ ছিল। আমি একটা গার্মেন্টসের মেডিকেল সেন্টারে জিপি হিসাবে কাজ করি তিনদিন। আশেপাশের কিছু রোগীও দেখে দিতে হয় মাঝে মাঝে। আর দুদিন একটা ক্লিনিকে নাইট ডিউটি করি। আমার স্বামী শোয়েব ও একই দিনে নাইট করে তাতে একে অপরের কাজে সাহায্য করা সহজ হয়। আজকের শেষ রোগী আসলো অদ্ভুত গেটাপে, এই গরমেও স্যুট কোট পরে।

কি নাম?

– ম্যাডাম শাহাদাত।

কি সমস্যা বলেন?

– ম্যাডাম, আপনে কি ম্যারেট?

মানে? আমি কি সেটা জেনে কি করবেন? আপনার সমস্যা কি বলেন?

– আমার সমস্যা ম্যাডাম ধরেন গলা ব্যথা আর ঘুসঘুসা কাশি। ম্যাডাম বলেন না আপনে ম্যারেট কি না?

ম্যারেট মানে যে ম্যারিড সেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। কেন, আপনি কি বিয়ের ঘটক নাকি নিজের জন্যই পাত্রী খুঁজছেন?

– না ম্যাডাম আমার বিবি বাচ্চা আছে। তবে একটু আধটু ঘটকালী করি।তাই জানতে চাচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা খুব ভালো পাত্র আছে। আমার নিজের মেয়েটা বড় হইলে অবশ্যই তার সাথে বিবাহ দিতাম। একটাই সমস্যা পাত্র এতিম। কিন্তু আমার দেখা সেরা পাত্র উনি। বিশ্বাস করেন।

শাহাদাত সাহেব আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আমি তো ঘটক পাখি আপা না। আমি আপনার চিকিৎসাটুকু দেই। আপনি বরং অন্য কোথাও এমন গুনবান পাত্রের আলোচনা করবেন।

– ম্যাডাম আপনে তো অনেক পদের মানুষ চিনেন। একটা বায়োডাটা রাইখা যাই। যদি কাউরে পান। আপনেরা ডাক্তার মানুষ। নানা কিসিমের মানুষের সাথে দেখা হয়।

কোনরকমে চিকিৎসা দিয়ে আপদ বিদেয় করলাম। শোয়েব আমাকে নিতে এসেছে অনেকক্ষন। আর এই লোক ঘটকালীর গল্প নিয়ে বসেছে।

আমি আর শোয়েব ইয়ারমেট। আমাদের পছন্দ দু বাসায় মেনেও নিয়েছে সহজে। দুই পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকায় ক্যারিয়ারের শুরুতেই আমরা তেমন একটা বিপাকে পড়িনি। দুজনেই এফসিপিএস পার্ট ওয়ান করেছি। আমি এখনো ট্রেনিংয়ে না ঢুকলেও শোয়েব ট্রেনিংয়ে ঢুকে গেছে। সপ্তাহে ক্লিনিকে দুটো নাইট করে। বাবা মায়ের কাছে হাত পেতে নিজের হাতখরচ নিতে লজ্জা লাগে তাই আমি এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বিয়ের পর পর আমাদের ফ্লাটসহ পুরো বাসা শোয়েবের বাবা মা গুছিয়ে দিয়েছে। আমার বাসাও যতটা সম্ভব সাপোর্ট দেয় দুজনকেই।

ক্লিনিকে আজ নাইট ডিউটি আছে তাই তাড়াহুড়া করে বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম দুজনেই।

আমার তলার রোগীরা সব মোটামুটি স্ট্যাবল আছে আজ। শুধু পাঁচ নম্বরের স্ট্রোকের রোগীটা ছাড়া। ওনার মেয়ে রীতু আমাদের বয়সীই। প্রায় রাতে মায়ের কাছে থাকে। সে সুবাদেই টুকটাক কথা হতো। মেয়েটা একাই প্রায় তিনজনের সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার বয়সী একটা মেয়ে এতো অল্প বয়সে জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি লড়ছে ভাবতেই অবাক লাগে। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয় ওকে যতবার দেখি বা ওর কথা ভাবি।

রাতের রাউন্ডে সহজ রোগীগুলো আগে দেখে সবশেষে গেলাম রীতুর মা কে ফলোআপ দিতে। রুমে ঢুকে দেখি রীতু তার মায়ের হাত ধরে বসে আছে।

কি খবর রীতু, কেমন আছেন? আপনার মা কে একটু ফলো আপ দিতে এলাম।

– ফলো আপ দিতে হবেনা ডক্টর। মা মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে। আমাকে একেবারে মুক্তি দিয়ে।

এতো নিস্পৃহ গলার স্বর বুঝি আমি আমার এতোদিনের ডাক্তারী জীবনে কখনো শুনিনি। নিত্যদিন মৃত্যুর সাথে বসবাস হলেও এখনো যে কোন মৃত্যু মেনে নিতে কেন যে এতো কষ্ট হয় জানিনা। শুধু বললাম, ডাকেন নি কেন কাউকে?

– মা দেয়নি। আর আপনাদের ডাকলেই বুঝি বাঁচাতে পারতেন? ভালোই হয়েছে মরে গেছেন। মায়ের কষ্ট আমি আর নিতে পারছিলাম না। আপনারা অনেক করলেন অরিন। ডেডবডি কিভাব নিতে পারবো যদি জানাতেন।

আমি নিজে তখনো ধাতস্থ হইনি পুরোপুরি। শুধু মৃত্যু নিশ্চিত করেছি রোগীর। রিসেপশনে জানিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে রওয়ানা দিলাম। রুম থেকে বের হবার মুখে কি মনে করে ঘুরে দাঁড়ালাম আবার, ‘রীতু আপনার আত্মীয় কাউকে খবর দেন যে কিনা আপনার সাথে বডি রিসিভ করে নিয়ে যাবে।’

– আমার ছোট ভাইটা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কোন আত্মীয় নেই ডক্টর। আমাকেই বলুন কি করতে হবে?

আমি শোয়েব দুজনে যথাসম্ভব সাহায্য করে রীতুকে ওর মায়ের বডি নিয়ে যেতে সাহায্য করলাম। রীতু আমার রোগীর আত্মীয় বৈ আর কিছুই না। কিন্তু আমার বয়সী একজন মানুষের এতো কষ্ট কেন যেন আমি নিতে পারছিলাম না। খুব ইচ্ছে করছিলো মেয়েটা কে জড়িয়ে ধরে একটু সান্ত্বনা দেই।

…………

মা মরে গিয়ে মতান্তরে বুঝি আমাকে আর্থিক টানাপোড়েন থেকে বাঁচিয়ে গেলেন। মায়ের চিকিৎসার জন্য যে টাকাটা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিতে চেয়েছিলাম সেটা এপ্রুভ হয়েছে। কবর দেওয়ার সব খরচ মিটিয়ে বেশ কিছু টাকা রয়ে গেছে হাতে। কিছু নামকাওয়াস্তে আত্মীয় পরিজন এসে হা হুতাশ করে আমাদের দু ভাইবোনের বিরক্তি উৎপাদন করে গেলো মাঝে কয়েকদিন।

দিন বোধহয় কোন না কোন ভাবে পেরিয়েই যায়। কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে আবার কাজে জয়েন করলাম। এবার জমানো টাকাটা দিয়ে মাস্টার্সের ফর্ম ফিলাপ করে ফেললাম। যা থাকে কপালে। চেষ্টাতো করি। রিভু, আমার ছোট ভাইটা মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাকে দারুনভাবে আঁকড়ে ধরেছে। ওর পরীক্ষা মাস দুয়েক পরে। দুভাইবোন একসাথে রান্না করে খেয়ে পড়তে বসি। আর রাত গভীর হলে লাগোয়া ছাদে বসে হাত ধরাধরি করে খানিকটা কাঁদি। কি অদ্ভুত, এই এতো বড় পৃথিবীতে আমাদের দুজনের আমরা ছাড়া যে আর কেউ নেই।

…………..

কয়েক মাস পেরিয়েছে এর মাঝে। কেন যেন রীতুর নামটা মাথা থেকে কখনোই পুরোপুরি মুছে যায়নি। ট্রেনিং পোস্টে জয়েন করবো। এই সপ্তাহেই আমার এই জিপি জবটার শেষ সপ্তাহ। নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। অপ্রয়োজনীয় কাগজগুলো চেক করে ফেলতে ফেলতেই শাহাদাত সাহেবের দেয়া পাত্রের বায়োডাটা হাতে উঠে এলো। আচ্ছা এই লোকটার সাথে রীতুর কি কোন সম্পর্ক জুড়ে দেয়া যায়না? দুজনেই তো আত্মীয় পরিজনবিহীন। ওর মায়ের খোঁজ নেয়ার স্বার্থে রীতু ফোন দেয়াতে ওর নাম্বারটা আমার মোবাইলের ফোনবুকেই ছিল। ফোন দিলাম বায়োডাটায় লেখা এহসান নামক পাত্রের ফোন নম্বরে।

…………….

জীবনের এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেছে কাউকে না ভেবে। বলা যায় জীবন সংগ্রামে আকন্ঠ ডুবে থাকা এই আমি অন্য কাউকে নিয়ে কখনো ভাবার বা অন্য কারো সাথে জীবন জড়ানোর স্বপ্নটুকু দেখারও ফুরসত পাইনি।

এহসান আমার জীবনে এলো অরিনের বদৌলতে, বসন্ত বাতাসের ছোঁয়ার মতো। বিধাতা বুঝি কিছু মানুষের মনে অন্যের জন্য অন্যরকম ভালোবাসা তৈরী করে দেয়। নয়তো অরিন তো শুধুই আমার মায়ের চিকিৎসক ছাড়া আর কিছু ছিল না; ও কেন আমার জীবনকে গুছিয়ে দেয়ার জন্য এতোটা উদ্যোগ নেবে?

আজ আমার আর এহসানের বিয়ে। এহসানকে রিভুরও খুব পছন্দ। তিনজনেরই আপন কেউ নেই বলে হয়তোবা। পুরো আয়োজন করছে অরিন আর শোয়েব দুজনে মিলে। আয়োজন বলতে অল্প কিছু মানুষ মিলে কাজী অফিসে বিয়ে তারপর একসাথে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া।

অরিনই আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছিলো। হঠাৎ আমার কি যে হলো, ওর অনুমতি ছাড়াই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নাভেজা গলায় শুধু বলতে পারলাম, ‘আমি ভাবতাম সুখ আসলে সোনার হরিণের মতো। যাকে আমার মতো মানুষেরা কখনোই খুঁজে পায়না। তুমি আমার জীবনে সেই সোনার হরিণটুকু এনে দিয়েছো, বিধাতা তোমার পুরোটা জীবন তার মঙ্গলময় ছোঁয়ায় আগলে রাখুক। তুমি আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ না হয়েও আমার এক জীবনের আত্মার আত্মীয় হয়ে গেলে।’

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *