আত্মসম্মানবোধ


“তুমি বলে সব বাচ্চার জন্য ডিম রানছো ?কে বলছে তোমারে আমার কথার বাহিরে কাজ করতে?”
“নাহ ভাবলাম সবাইতো বাচ্চা!”
“দুইদিন হইছে আইসা আমার ভুল ধরতে শুরু কইরা দিসো ? মা-বাপ আদব কায়দা কিছুই কি শিখায় নাই তোমারে?”
“ভুল হলে আমার হয়েছে মা-বাবার খোঁটা কেনো দেন মা?”
“দুই কলম পইড়া নিজেরে কি মনে করো ?কাজের বেটির মাইয়ার জন্যও ডিম রান্ধো!টাকাপয়সা কি বাপের বাড়ি থেকে আসে?”
মুখ নীচু করে রুমে চলে গেলাম ,বুঝেছি আজ রাতে এটা নিয়ে কথা শুনতে হবে ,ছয়মাস হলো বিয়ে হয়েছে, এখনো অনেককিছু বুঝে উঠতেই পারিনি ।ননদের দুই বাচ্চার জন্য ডিম ভুনা করতে বলেছিলো আমি বাসার সব বাচ্চার জন্যই করেছি ,বুয়ার মেয়েটার জন্যও ।
“নীরু তোমাকে বলেছি মায়ের কথার বাহিরে কিছু না করতে ,মা আমাদের বিয়েটা এমনিতেই মেনে নিতে চায়নি”
“চোখের সামনে অন্যায় দেখেও চুপ থাকবো ?তোমার এক বোনের বাচ্চারা দামী আর বাসায় যে থাকে তার বাচ্চা কি বাচ্চা নয় আর ভাইয়ের বাচ্চারা কি বাহিরের কেউ আশিক?বাকি ছিলো শুধু রেজিনার মেয়ে –মেয়েটাও বাচ্চাই”
“আস্তে কথা বলো মা শুনলে আগুন জ্বলবে ,কেনো বুঝোনা সহায় সম্পত্তি আমরা দুই ভাইই পাবো ,ওরা দুদিনের জন্য বেড়াতে আসে ,করুক মায়ের যা ইচ্ছা ! কই ভাবি আর বড়ো আপুতো কিছু বলেনা ,তোমার সমস্যা কি?”
“ছোটবেলা থেকে এভাবে বাচ্চাদের ভিতরে প্রভেদ শিখানো কি ঠিক ?”
“দেখো আমরাও এভাবেই বড়ো হয়েছি কই আমাদেরতো অন্যায় মনে হয়নি ,এসব সাধারণ ব্যাপারে এতো রিএক্ট করার কিছুই নেই নীরা”
“এই বাসায় মেয়েদের জন্য ,জামাইদের জন্য ,ছেলেদের জন্য এক আইন বউদের জন্য আলাদা, কিন্তু কেনো ?”
“অবাক হবার কি আছে!বউদের পরিবার থেকে তাদের জন্য করবে ,ব্যস!”
“তোমাকে আজকাল আমার অচেনা লাগে আশিক”
“সংসার করতে গেলে অনেককিছুই মেনে নিতে হয় আর রুমের বাহিরে ভুলেও আর আমার নাম ধরে ডাকবে না”
“ভুলবো না একবার ডাকার পরে সবাই মিলে আমার চৌদ্ধ গুষ্ঠির নাম মনে করিয়েছিলো ভুলি কি করে?”
“বাদ দাওতো এসব ,সংসার করতে গেলে মেয়েদের অনেককিছুই ছাড় দিতে হয়”
তিন বছর প্রেম করার পর স্বামীকেও আজকাল অচেনাই লাগে।বান্ধবীর প্রেমিকের বন্ধুকে ভালো লাগা থেকেই ভালোবাসা ,আশিক ছিলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর আমি সিটি কলেজের ,মাস্টার্স শেষ হবার আগেই বাবা বিয়ে ঠিক করার পর আমি বাসায় আমার পছন্দ জানালাম ,কেউই রাজি হলোনা ,আশিকের পরিবারও রাজি হলোনা এতো সাধারণ পরিবারে ছেলে বিয়ে করাতে ,চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কথা!ঝড় –ঝাপটা পেরিয়ে বিয়েটা হলেও আমাকে সহজভাবে মেনেই নেয়নি কেউ ।ভুল হলেই শ্বাশুড়িমা বলতে থাকেন—“আমার পোলা কি দেইখা পাগল হইছে!রুপ ধুইয়া কি পানি খামু?গ্রামে মান সম্মান আছে আমাগো ,পোলা দিন দুনিয়ার কিছুই বুঝলো না ,বেকুব পোলা!”
আধুনিক পৃথিবীর অনেককিছুই এ বাসায় নিষেধ কিন্তু অন্তরালে অনেক অনিয়মই হয় ,আমি একদম মেনে নিতে পারিনা ।বিয়ের আগে আশিক বলেছিল ওর সবচেয়ে বড়বোন সিক বলে এই বাসায়ই থাকে কিন্তু আমি এসে জানলাম স্যারের হাত ধরে পালিয়ে যাবার পরে শ্বশুরবাবা তাকে খুঁজে এনে জোর করে ডিভোর্স করিয়ে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়েছিলেন এক সপ্তাহের মাঝেই ,সেই জামাই আগের বিয়ের কথা জানতে পেরে ১৫দিন পরে আর বউকে নেয়নি ,আপুর একটা মেয়ে আছে যাকে কেউই দেখতে পারেনা আর আপুও কিছুটা ভারসাম্যহীন ।ফুলের মতো দেখতে মেয়েটার কি অপরাধ জানিনা তবে সবাই ওকে পছন্দ করেনা ,ধরে নিলাম যার সাথে ভেগেছে তারই সন্তান কিন্তু বাচ্চার কি দোষ এখানে!
“নীরু তুমি নাকি রেজিনার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছ ?”
“জানো মেয়েটা অনেক শার্প ,সকালে বাসায় কাজের চাপ সামলানোর জন্য আরো মানুষ আছে ,মেয়েটা পড়ুক,তুমি খুশী হওনি?”
“চেয়ারম্যানের ছেলের বউ কাজের বেটির বাচ্চারে নিয়ে গেছে স্কুলে ভর্তি করাইতে ,মান সম্মানের কথাও ভাবলে না?আর মেয়েটাকে রাখা হয়েছে মায়ের ফুট-ফরমায়েশের জন্য”
“মায়ের মতো ওকেও কী দাসী বানাবে ?”
“হ্যাঁ দাসীর মেয়ে তাই হবে তোমার সমস্যা কি?এভাবেই চলে এসছে বংশ পরস্পরায়”
“তুমি কি আগে থেকেই এমন ছিলে নাকি এই পরিবেশে এসে বদলে গেছো আমি বুঝতেই পারছিনা আশিক”
“নীরু তোমার শহরের কথা ভুলে যাও ,এখানে যেটা যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে দাও”
“আমি আজ বুঝতে পারছি আমার মধ্যবিত্ত বাবা কেনো এই বিয়েতে একদমই রাজি ছিলেন না,বাবা বুঝেছিলেন এমনটাই হবে”
“শোনো তোমার বাবা বিয়েতে বরযাত্রীদের পর্যন্ত ঠিকমতো আপ্যায়ন করতে পারেননি ,আমরা লজ্জায় পড়েছিলাম”
“৩০০লোকের কথা বলে ৫০০ জন আসলে সে দোষ কি বাবার ?বাবা তার সাধ্য অনুয়ায়ী যা পেরেছেন করেছেন ,তুমিতো জানতেই আমি কেমন পরিবারের তাহলে আজ আক্ষেপ কেনো?”
“মা ঠিকই বলে বেশী পড়াশোনা করা মেয়েরা ভালো বউ হয়না ,মুখে মুখে শুধু তর্ক করে ,আমার ভাবি আর বোনদের দেখো –স্বামীদের সাথে তারা তর্ক করেনা ,শ্বশুরবাড়িতেও ভালই আছে”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম ,বড়ো অচেনা লাগছে সবকিছু ,শ্বশুর পর্যন্ত একদিন বলেছে আমি চাল্লু মেয়ে তাই বড়ো গাছ দেখেই নাকি নৌকা বেঁধেছি ।
“আশিক আমাদের বিত্ত তেমন ছিলোনা চার ভাইবোনের পড়ার খরচ চালাতে গিয়ে বাবা মা হিমশিম খেয়েছে কিন্তু চার সন্তানকে একই চোখে দেখেছে ,দুইটা ডিম ছয়ভাগ করে খেয়েছি আমরা তবুও নিজেদের কখনো দরিদ্র ভাবিনি ,বিয়ের পর তোমাদের অঢেল বিত্ত দেখলেও মনের দিক দিয়ে তোমরা অনেক বেশীই দরিদ্র ,তোমাদের বাসায় অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বললেই তোমরা সেটাকে বেয়াদবী ভাবো”
১০মাসের মাঝেই বাসায় ফিরে এলাম ,ভুল মানুষ করে কিন্তু ভুল বুঝে সেই ভুল আজীবন টেনে চলার নাম বোকামি । বারবার মনে হয়েছে বাস্তবতায় আবেগের কোন দাম নেই, প্রেম আর বাস্তবতা যে আলাদা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি ।জানি অনেকেই বলবে কেনো মানিয়ে চলতে পারিনি? আসলে আরাম ,আয়েশের চেয়ে আমার কাছে আত্মসম্মানবোধ বেশী দামি তাই খুঁটি জোরালো করতে ইচ্ছে হয়নি ।কথা দিয়েছিলাম দুজন আমৃত্যু একসাথে থাকবো ,সময় কতো নির্মম!এক বছরের আগেই আমি ফেরত এলাম ।

ফাহমিদা খানম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *