আসগর আলীর একদিন

আসগর আলীর বয়স সত্তুরের কাছাকাছি৷ এলাকার কল মিস্ত্রী হিসেবে তার ডাক পড়ে বিভিন্ন ফ্লাটে বা বাসায়৷ ত্বড়িৎ সেটা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ একাত্তরে তিনি ঝকঝকা তরুণ ছিলেন৷ মুক্তি যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেননি৷ ভীতু টাইপের মানুষ ছিলেন৷ লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা আর আধপেট খালিপেটে ঘুমিয়ে গেছে ন’টা মাস৷ পাকিস্তান হয়ে  বাংলাদেশ৷ ছেচল্লিশ বছর পার করে এখন নিজেই এক পা কবরে দিয়ে বসে আছেন৷ শীতে অবধারিত কাশি গরমে পেট গরম এখন তার নিত্য সঙ্গী৷ সেই সময়কার পাক বাহিনী আর বিহারীদের অত্যাচারের এক সাক্ষী হয়ে টিকে আছেন আসগর আলী৷ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার সময়েও তিনি ঢাকা ছিলেন৷ তার ভয় ছিল আবার না একটা যুদ্ধ শুরু হয়৷ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হবার রাতেও তিনি ঢাকা ছিলেন৷ সারারাত ঘুমাতে পারেন নি৷ জেগে ছিলেন৷ মনে ভয় আবার যদি আরেকটা….

নব্বুই এর স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলনও তিনি অবলোকন করেছেন৷ নূর হোসেন গেলো,গেলো ডাক্তার মিলন৷ স্বৈরাচার হঠলেও গত সাতাশ বছরে এ দেশে কম উত্থান পতন হয় নি৷ রক্তাক্ত বাংলার রক্তের রং এখনও দৃশ্যমান৷ ম্যারাথন হরতাল দেখেছেন, দেখেছেন পেট্রোল বোমায় জ্বলতে থাকা মানুষ, কোর্টে সিরিজ বোমা হামলা,শেখের বেটির উপরে গ্রেনেডচার্জ ৷ হরতালে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে মারার দৃশ্য দেখেছেন পেপারে৷ দেখেছেন বাসে ধর্ষণ, সেনানিবাসের অনতিদূরে তনুর লাশের ছবি৷

তার কড় পড়া শক্ত হাতে তিনি পানির লাইনের প্যাঁচই ঠিক করেছেন শুধু৷ আগে ওয়াসায় চাকুরী করতেন৷ রিটায়ার্ড হবার পরও পানির লাইনের থ্রেট প্যাঁচ দেওয়া তার থেমে থাকেনি৷ উত্তাল দেশের কোথাও যেনো একটা থ্রেটের প্যাঁচ কেটে গেছে বলে তার মনে হয়৷ সেটা না ঠিক করে যতই ঘুরাও পাইপ তো ঠিক হবে না৷ জোড়া লাগবে না বলেই তার মনে হয়৷ তিনি পানির পাইপ রেঞ্চ আর তদসংযুক্ত যন্ত্রাংশের বাইরে তার চিন্তা চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে পারেন না৷

বাসর রাতে বউ রে বলেছিলেন বুচ্ছ বউ আমার আর তোমার জীবন হইল ধরগিয়া পানির পাইপ, আর ভালবাসাটা হইলো গিয়া দুই পাইপের কানেকশান৷ ওখন দুইপাশের পাইপের প্যাঁচ যদি ঠিক না থাকে আর জোড়া যদি ঠিকমতোন না লাগে তাইলেই কইলাম সমস্যা৷

নতুন বউ অবাক হয়ে বলছিলো আপনে এইসব কি কন?

আসগর আলী বলেছিলেন বউ এসব উঁচা কথা বুঝবা না৷ তখনই দরোজায় টোকা পড়ল ছোট্ট গলায় কেউ একজন বলল বাজান পেশাব করুম৷ আসগর আলি নতুন বউরে রেখে উঠে আসলেন৷ বউ মুখ ফিরিয়ে বসলেন৷

আসগর আলী বললেন বাবা খাড়াও৷ আমি আসতেছি৷ তিনি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন৷ ছয় বছরের তার একটা ছেলে আছে৷ তার নাম রেখেছেন আসমান৷ যুদ্ধের সময়ে তিনমাসের এক বাচ্চারে পড়ে থাকতে দেখেন৷ পাশে মায়ের লাশ৷ বুক থাইকা পেট পর্যন্ত চিরা৷ রক্ত গড়ায়ে যেয়ে বাচ্চাটার নিচে৷ সেই রক্তের মাঝে টেঁ টেঁ করে বাচ্চাটা কান্না করে৷ সেই পোলার বয়স আজ ছয় বছর! আসগর আলী বিয়ের আগেই একথা বলেছেন আলাপীকে৷ নাসিমা বানু তার স্ত্রী৷ নিতান্ত গরীব ঘরের মেয়ে৷ জাইনা শুইনাই আসছে৷

পানির পাইপ চেক করতে করতে ভাবছেন তিনি৷ ফেলে আসা দিনের কথা৷ দীর্ঘচল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি তার বউ কে একটা কটু কথা বলেননি৷ নাসিমা বানুরে আদর করে ডাকতেন নসি৷ বউ নথ নেড়ে মাথা ঘুরিয়ে হাসতো৷ বলতো কি ঢং! তিনি তার আলাভোলা স্বামীর ঢং পছন্দ করতেন বলেই মনে হয়৷

বিয়ার দেড় বছরের মাথায় নাসিমা বানু সন্তান সম্ভবা হন৷ কিন্তু ছয়মাসের সময় হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় আসগর আলী আর নাসিমা বানু সব হারান৷ ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন আর সম্ভব না৷ নাসিমা বানু সন্তান ধারণ করতে পারবেন না৷

আসমানরেই তারা তাই বড় করে তুলেছিলেন সন্তান হিসেবে৷ আসগর আলীর নসু দুর্ঘটনার পরই চুপচাপ হয়ে যায়৷

একদিন রাতে বলে আপনে আরেকটি বিয়া করেন৷ আমি তো আর আপনেরে বাপ ডাক শোনাইতে পারুম না৷

আসগর আলী নসুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন “না বউ! আসমান তো আছে৷ ওই তোমার নাড়ীছেড়া ধন না হইলেও আমার নাড়ীছেড়া ধন৷ জং ধরা পাইপের থ্রেট দেখছো না৷ ভাইঙাও ছুটান যায় না৷ আমাগো সম্পর্কই সেরকম৷ আর তোমার লগে আমার পাইপের কানেকশানও হইছে জব্বর৷ আল্লাহ যেমন রাখছেন তাতেই খুশী৷ আর কিছু চাই না!”

আসমান কাবিল হইছে৷ আলাদা থাকে৷ সে জানে আসগর আলী তার পালক বাপ৷ আসগর আলী লুকায়নি কিছু আসমানরে৷

নাসিমা বানু যখন মারা যান আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে তখনও সে তার পালক বাপরে নিজের সাথে রাখতে চাইছিল৷ আসগর আ যান নাই৷ বলছিলেন তোর মায়ে এই ঘরে চল্লিশটা বচ্চর আমারলী লগে কাটাইছে৷ এইখানে তার শরীরের গন্ধ আমি পাই বাপধন৷ তারে ছাইড়া যামু না৷ গেলে এইখান থাইকাই তর মায়ের হাত ধইরা বাইর হমু!

অবাক হইছিল আসমান৷ সে ভালবেসে বিয়ে করেছে৷ কিন্তু এমন তো না তাদের বন্ধন৷ ভালবাসার কি অপার শক্তি৷ অবশ্য আসমানের স্ত্রীও কখনও এই ঘিঞ্জি এলাকায় আসেনি৷ আনতে পারেনি আসমান৷ তার এক মেয়ে আছে৷ দাদাজী বলতে অজ্ঞান৷ খুব কমই এসেছে সে দাদার কাছে৷ কৌশলে তার স্ত্রীই আটকে রেখেছে ব্যাপারটা৷ আসমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে৷ বাজানকে সে ভালবাসে৷ অথচ নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারেনি৷ বাজান তার কামাইয়ের একটা পয়সায়ও হাত দেন নাই৷ বলেন বাবা লাগবে না৷ আল্লাহ তোমারে আরও দিক৷ তবে আমি যতদিন বাঁচবো নিজের পয়সায়ই চলবো৷ না পারলে তখন তুমি ব্যবস্থা নিবা৷

তার বাড়ীতে বাজান আর আম্মারে নিয়া গেছিল সে৷ দু’ইদিন থেকেই উনারা এই বাড়িতে চলে আসেন৷ বলেছিলেন বাবারে দম বন্দ দম বন্দ লাগে৷ তুই থাক সুখে৷ আমরা তো আছিই৷

নাসিমা খাতুন আর আসগর আলি নিজেদের বাবুই পাখির বাসায় চলে এসেছিলেন৷ আসমানের বউ এর মুখেও হাসি ফুটেছিলো সেই দু’দিন বাদে৷ অথচ দু’দিন মেঘ আটকে ছিল তার চেহারায়৷

যার ঘরে কাজ করতে এসেছেন তিনি কথা বলায় ঘোর কাটলো আসগর আলীর ৷ কি চাচা আপনের হলো৷

জি বাজান৷ সমুস্যা পাইছি৷

আপনের এই কলডা বদলান লাগবো৷ পানির লাইন ঠিক আছে ৷

তাইলে চাচা আপনেই একটা কল আইনা লাগাইয়া দেন৷ কত লাগবো বলেন৷

আসগর আলী বলনেন বাজান পেলাস্টিকের লাগাইলে একদাম আর ইস্টীলের অন্যদাম৷ পেলাস্টিকের বালাডা পড়বো আপনের ষাইট থাইকা একশ বিশ৷ আর ইস্টীলেরটা আড়াইশ৷

ঘরের কর্তা টাকা দিয়ে দিলেন৷ আসগর আলি সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে আসতে শুনলেন গৃহকর্তার বউ বলছেন এতগুলা টাকা লোকটার হাতে দিয়া দিলা বাজে জিনিস যদি আনে আর টাকা মেরে দেয় তখন ?

গৃহকর্তা বললেন আহা বুড়ো মানুষ৷

মহিলা বললেন তুমি চুপ থা….

আর শোনার মানে হয় না৷ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন তিনি৷

কলটা লাগানো হলে সব ঠিকঠাক আছে কি না সেটা দেখলেন আসগর আলি৷ কর্তাকে এনে দেখালেন৷ গৃহকর্ত্রী নানান ভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন৷

তারপর বললেন মনে হয় তো ঠিক আছে৷ কর্তা মিন মিন করে বললেন চাচা আপনের চার্জ কতো৷

আসগর আলী বললেন আড়াইশো টাকা৷ শুনে মহিলা খ্যাক করে উঠলেন৷ কি বলেন আড়াইশো! উনার স্বামী কিন্তু টাকাটা বের করে ফেলেছিলেন৷ মহিলা বলল আপনাকে আমরা দেড়শ দিবো৷

আসগর আলী হেসে বললেন আপনে যা ভাল মনে করেন আম্মাজি৷

টাকাটা হাতে নিয়ে তিনি তার শার্টের পকেট থেকে রিসিট বের করলেন৷ সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন আব্বাজি কলের রিসিট৷ আপনে মোড়ের দোকানে গেলে পরীক্ষা করতে পারেন দাম ঠিক আছে কি না! বলে তিনি চলে আসলেন৷ শুনতে পেলেন মহিলা বলছে উহুহ! বুড়ার ঠাঁট দেখো৷ জবাবে লোকটা তার স্ত্রীকে মিন মিন করে কিছু বলার চেষ্টা করলো৷ ধমকে থেমে গেলো লোকটা৷

তিনি নামতে নামতে মনে মনে বললেন নসু জীবনেও আমারে এমন কইরা বলে নাই৷

আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী৷ নসু বেঁচে থাকলে …. দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন আসগর আলি৷

আষাঢ় মাসের তের তারিখে তাদের বিবাহ হয়েছিলো৷ পয়লা বচ্ছর নসুরে একটা হলুদ পাইড়া নীল শাড়ি এনে দিয়েছিলেন৷ নসু বলেছিলো ঢওং! রাতে হাত ধরে বসেছিলেন তারা৷ পূর্নিমা ছিল সেদিন৷ আহা! দিন গুলা কেমনে চলে গেলো…

মোড়ের দোকানে আসগর আলী লাঠী টোস্ট ভিজিয়ে চা খাচ্ছিলেন৷ পেছনে চাচাজি ডাক শুনে তাকালেন৷ সেই ভদ্রলোক!

বললেন আমার স্ত্রীর ব্যবহারে আমি দুঃখিত চাচাজী৷ এই নেন একশ টাকা৷

আসগর আলী বললেন বাজান লাগবো না৷ আপনের ইস্ত্রীরে লুকাইয়া টেকা নিবো না আমি৷ রাখেন আপনে৷ আর মনে কিছু নিয়েন না৷ ঘরের বউ রে লুকায়ে কোন কাজ কইরেন না৷ আমার নসুরে লুকায়ে জীবনে কোন কাজ আমি করি নাই!

লোকটা কি বুঝলো কে জানে মাথা নুইয়ে চলে গেলো৷ সকাল থেকেই আজ আসগর আলীর পিঠে ব্যাথা করছে৷ তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কেন? হঠাৎ আসমান রে দেখার প্রবল ইচ্ছা হলো তার৷

আসমান গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিং এ বসেছেন৷ তখন পিয়ন এসে জানালো আসগর নামে এক লোক তার সাথে দেখা করতে চায়৷

আসমান সাথে সাথে মিটিং বন্ধ করে বলল আমরা পরে বসবো৷ আমার আব্বা এসেছেন হঠাৎ করে৷ আপনারা প্লীজ একটু ওয়েট করুন৷

আসমান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন৷

অফিসের দু’জন কর্মকর্তা একজন আরেক জনকে বললেন দেখেছেন স্যার তার বাবারে কি সন্মান করে৷ আমাদের পোলাপাইন গুলাতো এর এককানা কড়িও….

আরেকজন বললেন হ’ রে ভাই৷ আমার মাইয়াডাও বিতলায়ে গেছে!

কনফারেন্স রুম থেকে দৌড়ে রিসিপশানে আসলেন আসমান সাহেব৷ দেখলেন তার বাজান জবুথবু হয়ে বসে আছেন৷ হাতে দুটো প্যাকেট৷ ছেলেকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি৷ অধস্তন যেমন উর্ধস্তন কর্মকর্তাকে দেখে করে!

আসমান সাহেব তার বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন জানি৷ রিসিপশানের মেয়েটা অবাক হয়ে স্যারের কর্মকান্ড দেখছে!

বাজান তোমার জন্যি একটা শার্ট আনছিলাম৷ বলে আসগর আলী আসমানকে শার্টটা বের করে দিলেন৷ আসমান সাহেব অবাক৷ তার বাজানের কি হলো আজ৷

পাঁচ ছশ হবে শার্টটার দাম৷ আসমান সাহেব কাঁপা হাতে শার্টটা নিলেন৷ তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন৷

বললেন বাজান একটু বসেন আমি শার্টটা পইড়া লই৷ শার্টটা পড়ার পর ছেলের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন আসগর আলী৷ আসমান সাহেবের মুখে কথা নেই৷

আরও দুটো প্যাকেট বের করলেন আসগর আলী৷ বললেন বউমা’র জন্য একটা শাড়ী আর আয়েশার জন্য একটা পুতুল আনছি বাজান৷ বউ মার পছন্দ হবে কি না জানিনা!

আসমান সাহেব বললেন আব্বা আপনের হইছে কি৷ এইগুলান আনতে গেছেন ক্যান?

আসগর আলী বললেন বাজান হঠাৎ তুমাগো লাইগা মনটা টান দিলো তাই আসলাম৷ পোলার জন্য কিছু আনলেও যা না আনলেও তা৷ তবু মন চাইলো৷

আসমান বললেন শার্টটা আমার পছন্দ হইছে বাজান৷ খুব পছন্দ৷ আইজকা আপনের আর আম্মার বিবাহ বার্ষিকী৷ আমার মনে আছে৷ মিটিং শেষ হইলেই আমি যাইতাম আপনের লগে দেখা করতে৷

আসগর আলি অবাক হয়ে বললেন তোমার মনে আছে বাজান?

আরে কি বলেন মনে থাকবো না ক্যান! আমি সবসময় এই দিনটায় আপনের কাছে যাই! যাই না! আইজকা আপনে আউলা ঝাউলা ব্যবহার করতেছেন বাজান৷ কি হইছে বাজান?

আসগর আলি বললেন কিছু হয় নাই বাজান৷ তোমারে দেখতে ইচ্ছা হইছিলো খুব… বলেই তিনি চেয়ারে ঢলে পড়লেন৷ আসমান সাহেব আব্বা কি হইছে বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন…..

দেশের নামি হাসপাতালের আই সি ইউ৷ বেডে শুয়ে আছেন আসগর আলী৷ সিভিয়ার হার্ট এটাক৷ মনিটররের সবুজ রেখা গুলো উঠানামা করছে অনিয়মিত ভাবে৷

খুট করে একটা শব্দ হলো৷ আসগর আলী চোখ খুলে দেখলেন সামনে নাসিমাবানু দাঁড়িয়ে আছেন৷ সেই বিয়ের প্রথম রাতের মতো৷ খুকি খুকি লাগছে তাকে৷

তিনি বললেন নসু তুমি এতোদিন পরে৷

আইলাম আপনেরে নিতে৷ আপনেরে ছাড়া একলা লাগে৷

আসগর আলী বললেন জীবনের পাইপের প্যাঁচ তাইলে কাইটা গেছে বউ!

নথ নেড়ে নসু বললেন ঢওং!

আসগর আলি বললেন কতদিন কথাটা শুনিনা বউ৷

নাসিমা বানু বললেন অখন প্রত্যেক দিন শুনবেন৷

আসগর আলী বললেন আসমানরে দুইডা কথা কইতে আসিলাম বউ!

কি কথা?

একাত্তরে শমসের রাজাকার আমার সামনেই তার মায়েরে…আমি খারাপ লোক আছিলাম না বউ বাইচা থাকনের লাইগা…

ঐ ঘটনার পরেই আমি পলাইছিলাম আসমান রে লইয়া! কওয়া হয়নাই ঘটনাটা৷

থাউক৷ সব কথা কইতে নাই৷

আর তোমারে যে তার বউ কথা শুনাই… যার জন্যে আমরা চলে আসলাম৷

কইতে হইবো না৷ সব কথা কইতে নাই৷

নসু আমার সাহসের অভাব আছিলো৷ দেশের যুদ্ধের সময় মুক্তিতে যোগ দেই নাই!

না দিলেন৷ আপনে তো শমসের রাজাকারের ডেরা চিনায়ে দিছিলেন৷

আমি কাপুরুষ ছিলাম বউ৷ হারামীডারে নিজ হাতে..যদি

বাদ দেন না! আপনে এই টুকুন আসমানরে বড়ো করছেন কাবিল বানাইছেন৷ কে কয় যুদ্ধ করেন নাই! তিনমাসের একটা বাইচ্চারে সেই দুর্দিনে বুকে আগলাইয়া রাইখা বড় করছেন৷ আমারে জীবনেও একটা খারাপ কথা কন নাই৷ এইডা যুদ্ধ না!

বউ তারপরেও….

বাদ দেন না৷ নসু বললেন৷ এইবার আমার হাতটা ধইরা উডেন৷ বাইরে ফকফকা চাঁদনী আইজ৷ আমাগো পরথম বিয়ার দিনের মতন৷ চলেন দুইজনে চান্নী দেখবো৷

আশ্চর্য আসগর আলী নাসিমা বানুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন৷ করিডোরে দেখলেন আসমান একটা চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত হয়ে৷

পরম মমতায় আসমানের কপালে চুমু খেলেন আসগর আলী৷ ঠিক যেমন তিনমাস বয়েসী আসমান কে সবুজ ঘাসের লাল রক্তের বৃত্ত থেকে তুলে চুমু খেয়েছিলেন!

আসমান স্বপ্নে দেখলো তার পালক বাবা আর মা করিডোর ধরে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন৷ ধড়মড় করে জেগে উঠে আইসি ইউর সামনে গেলেন তিনি৷ বাইরে থেকে তার বাবার বিছানা টা দেখা যায়৷ গার্ডকে একধাক্কায় সরিয়ে এক দৌড়ে বাবার কাছে চলে গেলেন৷ সব শেষ! গার্ড ডাক্তার ডাকতে গেলো৷ আসমান সাহেব বাজান বলে চিৎকার করে উঠলেন!

বাইরে তখন ফকফকা জোছনা৷ পথের একটা কুকুর মুখ তুলে দু’বার ঘেউ ঘেউ করে উঠলো৷ তার কাছে মনে হয়েছিল হাত ধরাধরি করে সেই জোছনা প্লাবনে দুটো ছায়া হেঁটে যাচ্ছে৷ সুখী মানুষের ছায়া৷

-পলাশ পুরকায়স্থ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *