উত্তরাধিকার (৪র্থ পর্ব)

রিয়াদের কথা শুনে দুজনে বিষ্ময়ে হতবাক। সে অন্যায় করে ফেলেছে। সুপয়া নিজের ছেলেকে আপাদমস্তক চিনে। সে নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলেছে। ছেলের উপর তার অগাধ আস্থা।ছেলে খুব একটা ভুল করে না। তাই ছেলেকে প্রশ্ন করে,

– কি করেছিস, বাবা?
– আমি নুরুকে খবর দিয়ে আনিয়েছি। কিন্তু তার আগে তোমার অনুমতি নিই নি। মা, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
রিয়াদ মায়ের পা ধরে বসে পড়ে। সুপয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– পাগল ছেলে, পা ছাড়। এটা অন্যায় নয়, এটা ভুল। তুমি যদি মনে কর ঠিক হয়েছে, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে তার সাথে সাবধানে কথা বলতে হবে। রিশা কি জানে, আজ নুরু আসবে?
– হ্যা মা, আপুর সাথে আমি সব আলোচনা করেছি। আপু অনুমতি দিয়েছে বলেই তাকে খবর দিয়েছি। তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি।
– শয়তানটা কিন্তু শিয়ালের মতো ধূর্ত। বুঝতে পারলে তার টিকির নাগালও পাবি না। আচ্ছা বাবা, অন্য রাস্তায় এগোলে কেমন হতো?
– কিভাবে মা?
– রিয়ার অফিসের মাধ্যমে।
– না মা, সে পুলিশকে যমের মতো ভয় পায়। তাদের এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবে। সে লোভী হবে না।

এতোক্ষণ রিয়া মা ছেলের কথা শুনছিল। এবার রিয়া বলল,
– মা, তোমার ছেলের চিন্তাটা মনে হয় ঠিক আছে। আগে শয়তানটাকে লোভের জালে আটকাতে হবে। তাছাড়া তুমি চিন্তা করছ কেন? আমরা সবাই আছি না। এখন তো রিয়াদ একা নয়, আপা আছে, আছেন দুলাভাই।
– হ্যা মা, তোমরা আছ। কিন্তু আমি শয়তানটাকে ভয় পাই।
এবার রিয়াদ বলে,
-মা, আমিও তাকে কিছুটা ভয় দেখাতে চাই।
– কখন আসবে জোচ্চোরটা।
– আসবে কি মা, সে তো আমাদের ড্রয়ংরুমে বসে আছে।
এবার সুপয়া আঁতকে উঠে।
– বলিস কি?
– মা, তোমরা কেউ নিচে নামবে না। আমি একটু হালকা মেকাপ করে নিচে নামব।
মা বলে উঠে,
– পুলিশের সাথে সংসার করতে গিয়ে চোর ছেচ্চোরের স্বভাব শিখে ফেলেছিস নাকি?
রিয়া কপট অভিমান দেখিয়ে বলে,
– মা, তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ?
– ওমা, আমি আবার কখন অপমান করলাম। তুমি ছেলেটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিও।
রিয়াদ রিয়াকে নিয়ে মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

রিয়াদ নিজের ঘরে ঢুকে রিয়ার মেকাপ বক্স বের করে। রিয়াকে বলে,
– তুমি আমাকে রাশভারী লোক সাজিয়ে দাও। একটু বয়স্ক বানিয়ে দাও।
রিয়া সময় নিয়ে রিয়াদের চেহারায় রঙ মাখতে শুরু করে।

রিয়াদ অত্যন্ত সুপুরুষ। ৫’৮” লম্বা। তার চেহারার রয়েছে ব্যক্তিত্বের ছাপ। একটু কারুকাজ তাকে রাশভারী করতে সময় লাগে না। সাদা পাজামা পাঞ্জাবী সাথে চোখে চশমা। তাকে উদীয়মান রাজনীতিবিদ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। তার অবস্থা দেখে রিয়া হেসে খুন। বলে,
– সামনের ইলেকশনে তুমি নমিনেশন নিয়ে মন্ত্রী না হলেও এমপি হতে পারবে।
– যার বউ পুলিশের বড় কর্তা হবে দুদিন পর, তার নেতা হওয়া স্বাভাবিক।
– ও সব চিন্তা মাথায় নিলে তোমাকে ঢুকিয়ে দেব।
– আমি তো ঢুকেই আছি পুলিশের কাস্টডিতে।
– এখনো তো ডাণ্ডার বাড়ি খাও নি।
– দাও না দুয়েকটা দেখি কেমন লাগে।
– আচ্ছা দেব সময় হলে।
– না এখন দাও।
বলেই রিয়াকে টেনে নেয়। রিয়া চট করে বলে,
– মা এলো।
– আসুক, আমি তো আমার বউকে আদর করছি।
– চলো মাকে দেখিয়ে আন।
– চলো, মাকে একটু ভড়কে দিয়ে আসি।
দুজনে মায়ের ঘরের দিকে যায়।

সুপয়া দরজার দিকে পেছন ফিরে কি যেন করছিল। রিয়ার ডাকে ফিরে তাকায়। বৌমার সাথে অপরিচিত একজনকে দেখে আঁতকে উঠেন তিনি।
– কে মা? কাকে নিয়ে এলে?
– ভালো করে তাকান।
রিয়াদ পায়ে পায়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।
– মা, তুমিই যখন প্রথম দেখায় চিনতে পার নি, তাহলে চিন্তা নেই।
রিয়াদ ঝুঁকে মায়ের কপালে চুমো খায়।
– মা, বাবার স্বপ্ন পূরণে আজ প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছি, তুমি আমাকে দোয়া কর। আমি যেন বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।
– আমার দোয়া সব সময় তোমার সঙ্গে আছে।
রিয়াদ রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– সুদীপ্ত ঘুম থেকে উঠলে একটু সামলে নিও।
– ছেলে তো বাপের ন্যাওটা।
– মার কাছে নেয়ে যেও।
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি শয়তানটাকে অল্প কথায় বিদায় করে দিও।
– আরে তাকে তো আগে রাজকীয় নাস্তা খাওয়াব। তারপর কথা বলব।
– তোমার লক্ষণ কিন্তু ভালো না।
এরপর রিয়াদ নুরাকে একরাশ মানসিক চাপ চাপিয়ে বিদায় করে।

সেদিন বিকেলে তার বাসায় পারিবারিক মিটিং এর নামে মিলনমেলা বসে। দুপুরের দিকে রিশা দুই সন্তান সহ হাজব্যান্ডকে নিয়ে হাজির হয়। সুপয়ার আজ ঈদের দিন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী যেন চাঁদের হাট। রিয়াদের বিশাল বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি। রিশা মন্ত্রণালয়ে আছে। যে কোন সময় তার ডিসি পোস্টিং হয়ে যাবে। রিশার স্বামী শোভন মাত্র মাঠ থেকে উঠে এসেছে। ঢাকার পাশের এক জেলায় অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রায় দুই বছর ডিসি ছিলেন। সুপয়ার ব্যস্ততার অন্ত নেই। তিনি সব কিছু নিজে দেখা শোনা করছেন। কাজের লোকদের উপর নির্ভর করতে পারছেন না। রিয়াদের ছেলের বয়স মাত্র দুবছর। রিশার ছেলে বড়, তার বয়স সাত বছর। রিশা ছোট মেয়ে রিয়াদের ছেলের সমবয়সী। তিনজন মিলে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। সব কিছু সামলাতে হয় সুপয়াকে।

দুপুরের খাবারের পর বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে মিটিংয়ে বসে সবাই। পারিবারিক মিটিং এর সভাপতি বরাবরই সুপয়া। তার সিদ্ধান্তকে সবাই সম্মান করে। রিয়াদ প্রস্তাব তোলে,
– বাবার স্বপ্ন পূরণের সময় এসেছে এবার। আমরা মাঠে নামব।
রিশা বরাবরই কম কথা বলে। গুরুগম্ভীর আচরণে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখে। চাকরি ক্ষেত্রে তার সততা প্রশ্নাতিত। সে বলে,
– তুমি কিভাবে এগোতে চাও?
– আপু, আগে আমাদের পৈত্রিক জমি বুঝে নেব। তারপর একসাথে এক একরের মতো জায়গা কিনতে হবে।
– এতোটুকু জায়গা একসাথে পাওয়া সহজ নয়।
– আমি জানি সেটা, তবে নুরার পক্ষে একসাথে এক একর জায়গা বের করা সম্ভব।
– সে কি করবে?
– না, সে করবে না।
– তুমি আজ নুরাকে কি বলেছ?
– বিশেষ কিছু বলি নি, শুধু আমাদের দাগগুলোর নাম্বার বলেছি। এ দাগগুলোর জমি আমি কিনতে চাই বলেছি।
– তুমি তো মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছ।
– হ্যা আপু, অনেকটা তাই। তবে এটা বলেছি যত টাকা লাগে কিনব। এটাই চুড়ান্ত টোপ।

রিশার স্বামী চুপ করে শুনছিল সব। এতোক্ষণে মুখ খোলে।
– আমার মনে হয় রিয়াদ ভুল করে নি। নুরা জানে না তোমাদের জমি তোমরা নিষ্কন্টক করে ফেলেছ। মামলার হাজিরায় স্বাক্ষ্য দিতে এসেছে নুরা বহুবার। তাকে একজন ধূর্ত শিয়াল ছাড়া কিছু মনে হয় নি। সে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছে। আমি তাকে একবার সুযোগ দিয়েছি কিন্তু আত্মীয়তার পরিচয় দেবার সুযোগ দিই নি।
রিশা মুখ খোলে,
– শোভন, তুমি বলো আমাদের কোন পদক্ষেপ নিতে হবে কিনা?
– আমার মনে হয় wait and see নীতি অবলম্বন করাই উত্তম। তবে তোমাদের গ্রামের সোর্সগুলোকে সজাগ করে দাও।

তাদের আলোচনার মাঝে সুপয়া চুপ করে বসে আছে। তিনি জানেন তারা আলোচনা শেষে তার মতামত জানতে চাইবে। তিনি এক সময় বলে উঠেন,
– আমি কিছু দিন বাড়িতে কাটিয়ে আসি?
রিয়াদ প্রবলভাবে মাথা নাড়ে।
– না মা, তুমি এখন বাড়ি যাবে না। ইবলিশটা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে পারে। তার চেয়ে রিয়া তার সোর্স কাজে লাগাক।
রিয়া বলে, রিয়াদ ঠিক বলেছে আমরা এ সময় দূরে থাকি সব কিছু থেকে। দেখি এক সপ্তাহ পর নুরা কি রেজাল্ট নিয়ে আসে।
রিশা মাকে প্রশ্ন করে,
– মা, তুমি কিছু বলবে?
– না, তোমরা যা ঠিক কর তাই কর। শোভন যেভাবে বলে তাই কর।
– এটা কি হলো মা? আমি আর রিয়াদ কিছু না? শোভন আর রিয়া তোমার সব।
– পাগল মেয়ে, তোরাই তো সব।
এক সপ্তাহের অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাই বোন খুঁনসুটিতে মেতে উঠে। মা নিরবে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে। ওরা এখনও ছোটটিই রয়ে গেল।

চলবে———

-বাউল সাজু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *