একটি অমিমাংসিত রহস্য (২ য় পর্ব )

দরজায় আবারও টোকা পড়লো, খুলবে কি খুলবে না খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলো রাজিব। এতো রাত্রে কে এলো? তার পরিচয় তো এখনও কেউ জানেনা, তাহলে? বিদ্যুৎ নেই, হাতড়ে হাতড়ে মোবাইল ফোনটা নিল সাথে, তার অটোমেটিক ছোট্ট পিস্তলটা রাখলো বামহাতে। আবারও শব্দ হলো দরজায় এবার যেনো খানিকটা অসহিষ্ণু ভাব। পুরোনো আমলের দরজা। লম্বা সিটকিনি লাগানো,খুলতে একটু সময় লাগে, ঠিক ঐ মুহূর্তে বাইরে থেকে আওয়াজ এলো ভয় নেই, আমি রানা, দরজা খোল, রাজিব। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন স্বস্তিবোধ হয় তেমনই বোধ হলো রাজিবের। এতো পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ভালো লাগলো তার। দরজা খুলে বলল, ভেতরে আয়, এতো রাতে? এখানে? তুই কোথা থেকে? হাসলো রানা, মোবাইলের আলোয় খুব একটা স্পষ্ট দেখা গেলো না তাকে। রাজিব হাত বাড়িয়ে রানাকে ধরতে গেলে, রানা সরে গেলো খানিকটা, বলল ধরিস না। সম্পূর্ন  ভিজে গেছি, পরলে একটা টাওয়েল দে।
চল ওপাশের রুমে ওখানে টাওয়েল আছে, আমি কাপড় দিচ্ছি ভেজা কাপড়টা পাল্টে নে। এই বাংলোটা চা বাগানের আর সব বাংলোর মতো। প্রতিটা রুমই আলাদা আর বিশাল সাইজের। একরুমের সাথে অন্য রুমের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই অর্থাৎ এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে হলে বারান্দা পার হয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যা থেকে মুসলধারে বৃষ্টি হয়েছে । তার ছাট এসে বারান্দা ভিজিয়ে দিয়েছে। বারান্দাটা অনেকটাই ভিজে গেছে। রাজিব বলল, সাবধানে হাঁটিস, বারান্দাটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। আর সাবধান, বলে হাসলো রানা।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো দুজন, এমন সময় রানাই বল্ল মোবাইলের টর্চ টা বন্ধ করে দে, শুধু শুধু চার্জ শেষ করছিস। লাইট বন্ধ করলে অন্ধকার হয়ে যাবে, বলল রাজিব। সাংবাদিক আর পুলিশের তো অন্ধকার নিয়েই কারবার, এদের তো অন্ধকারে সমস্যা হবার কথা না। বলেই দরাজ গলায় হেসে উঠলো রানা। রানার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো রাজিব। শোন, তোকে একটা জরুরী খবর দেয়ার জন্য এসেছি। তোর এই বাংলো থেকে দু কিলোমিটার দূরত্বে একটা খুন হয়েছে। লোকটাকে খুন করেছে চেয়ারম্যান ও তার লোকেরা। তুই কিভাবে জানলি? আর চেয়ারম্যান যে সাথে ছিল তোকে কে বলল? পাল্টা প্রশ্ন করলো রাজিব। সাংবাদিকদের অনেক কিছু জানতে হয়। উত্তর দিল রানা। আমাকে কথাটা শেষ করতে দে। তোদের এই এলাকার চেয়ারম্যান বিশেষ এক ধরনের সিগারেট খায় যা এই এলাকায় কেন সারা বাংলাদেশে কয়জন খায় হাতে গোনা যাবে। শোন, সেটা ব্যাপার না, এই লোকটার বৈশিষ্ট্য হলো সে যে কোন সিগারেটই সম্পূর্ণ  খায় না, তিন ভাগের একভাগ খেয়ে ফেলে দেয়। লাশের আশেপাশে খেয়াল করলে হয়তো সিগারেটের টুকরো পেয়ে যাবি।
তুই লাশের বুক পকেটে একটা কলম পাবি, ওটা নিয়ে আসিস। এখন যা, আমার খুব ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমুবো। সকালে আমায় ডাকিস না, অনেক ঘুম জমা হয়ে আছে আমার।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলো রাজিব। নিজের রুমে ফিরে বিছানায় শুলেও ঘুম আসে না। রানা আর সে কত স্মৃতি, কত কথা যে ভীড় করে মনে। ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র দু’জন। দুজনেরই সাবজেক্ট ফিজিক্স। একই হলের একই রুমে বসবাস। অথচ দুজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পূর্ণ  ভিন্ন।রানা ছটফটে চঞ্চল সদা হাস্যজ্বল, সে তুলনায় রাজিব শান্ত ও ধীর। ছাত্র অবস্হাতেই রানা কি করে যেনো সাংবাদিকতায় জড়িয়ে গেলো। ২য় বর্ষ থেকেই সে পুরোদস্তুর সাংবাদিক। এছাড়াও গান, আবৃত্তি অর্থাৎ সাংস্কৃতিক জগতে তার সরব পদচারনা। সে তুলনায় স্বল্পভাষী রাজিব তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান এই পড়াশোনা। মাষ্টার্স। ফাইনালে রাজিব পেলো ফার্স্ট ক্লাস আর রানা পেলো কোনো রকমে টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস। তাও বলতে গেলে রানার এই পাশ করার পেছনে রাজিবেরই অবদান। পাশ করার পর রানা পুরোপুরিভাবে সাংবাদিকতাকে তার পেশা হিসেবে নিয়ে নিল। আর রাজিব বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে। তারপর সারদায় একবছর ট্রেনিং, প্রথম পোস্টিং খুলনা। কিভাবে কিভাবে যেনো যোগাযোগটা ফিকে হয়ে গেলো। আজ এতোদিন পর রানাকে পেয়ে ভালোলাগায় মনটা ভরে গেলো রাজিবের।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই।সেন্ট্রির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। সেন্ট্রিকে রুমের ভেতরে ডাকলো রাজিব। কি ব্যাপার সোহেল? এ্যনি নিউজ? জ্বী স্যার, দক্ষিনেশ্বরের মাঠের পাশে ঝোপে একটি ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলো রাজিব, গতকাল রাতে রানা তো এই খুনের কথাই বলেছিল। দ্রুত কাপড় পাল্টে ঘর ছেড়ে বের হলো। যাবার আগে সুরেন্দ্রকে বলে গেলো আজ দুজনের জন্য খাবার তৈরি করতে। বাসায় একজন অতিথি এসেছেন। ঘুমুচ্ছে তাকে ডাকার প্রয়োজন নেই।
দক্ষিনেশ্বরের মাঠে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগলোনা রাজিবের। চেক শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বডিটার পাশে সিগারেটের টুকরোটা চোখে পড়লো রাজিবের। তিনভাগের একভাগ খাওয়া। রানার কথার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। চারদিকে চোখ বুলালো রাজিব, আর সিগারেটের টুকরো চোখে পড়ে কিনা। মোট তিনটে পাওয়া গেলো। একটা একেবারে ভিজে ন্যাতান্যাতা। একটা পাওয়াগেলো ঝোপের পাশে মোটামুটি কম ভেজা। সম্ভবত এটা সবার শেষে খাওয়া। ফেলার পর আর বৃষ্টি হয়নি। তাই তেমন ভিজেনি। এ সব গুলো সিগারেটের টুকরোকে আলাদা আলাদা ভাবে তুলে নিলো রাজিব।হয়তো এভিডেন্স হিসেবে কাজে লাগবে। তখনই কলমটার কথা মনে পড়লো, রানা বলেছে লোকটার বুক পকেটে একটা কলম আছে ওটা পেলে তোর কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
কন্সটেবলকে বলল বডিটা সোজা কর। সোজা করলো করলো কন্সটেবল। লাশের চেহারা দেখে চমকে উঠলো রাজিব। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।

চলবে…

-জাহেদা মিমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *