একটি নাকফুলের গল্প ( ৫ম এবং শেষ পর্ব )

আমার সংসার শুরুর ষোলমাস পর, গোসল সেরে ভেজা চুল শুকোনোর এক মধ্যদুপুর আমার জীবনে প্রথমবারের মত নিয়ে আসে একটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ।তখন মাত্র গোসল সেরে, ভাত খেয়ে, উঠোনের ছিপছিপে ডালিম গাছটার ডালে বসা একমনে গল্পকরা পাখিদুটোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আমি। জীবনটা প্রতিদিন একটু একটু করে সুন্দর, ভীষণ রকমের সুন্দর হয়ে উঠছিল তখন আমার কাছে।এই ষোলমাস ধরে প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ আমি অন্যরকম একটা জীবন খুঁজে নিচ্ছিলাম অথবা খুঁজে পাচ্ছিলাম। প্রতিদিন আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলাম আমার জীবনটাকে। সবার দৃষ্টিতে ছাপোষা বলে খ্যাত একটা জীবনে বেশ সাবলীল হয়ে উঠছিলাম আমি। শিমুল চাকুরীতে নিজের অবস্থানটা পাকাপোক্ত করে ধাপে ধাপে উপরে উঠার স্বপ্ন দেখছিল। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে শিমুল বাড়ি আসে আবার শনিবার খুব সকালে শহরে চলে যায়। আমি মা আর বাবার সাথে সাথে থেকে আমার সংসারখানা খুব ভালমতো গুছিয়ে নেয়া শিখে যাচ্ছি প্রতিদিন একটু একটু করে। আমার একটা চাকুরীও হয়ে যায় গ্রামের স্কুলে। বাবা, মা আর আমি মিলে বাড়ির পাশের ছোট্ট খোলা জায়গাটাতে একটা হাঁস মুরগীর ফার্ম করার পরিকল্পনা করি। মায়ের সাথে সাথে বাগান করতে আমার বেশ লাগে। দাদির পাশে বসে উনার কাছ থেকে পুরনো দিনের গল্প শুনতাম, রাতুল আর রাসুর পড়ালেখার তদারকি করতাম। ঘরভরা আপন আপন মুখগুলো আন্তরিকতার আলো মেখে আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল আমার জীবনে দিনে দিনে। আমি সকাল সন্ধ্যার প্রার্থনায় বসে এই আপনমুখগুলোর মুখের হাসি অমলিন রাখার জন্য আবেদন করতাম সৃষ্টিকর্তার কাছে।

রান্নাও কিছুটা শিখে ফেলেছি আমি ততদিনে। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাটির চুলোয় ধোঁয়া তুলে নিজের হাতে শিমুলের জন্য রান্না করি। কখনো কুচোচিংড়ী দিয়ে উঠোনের মাচা থেকে তুলে আনা পুঁইয়ের কচিডাঁটা, কখনও নিজ হাতে সবজি বাগান থেকে আলু তুলে এনে তা দিয়ে শোল মাছের ঝোল। রাঁধতে গিয়ে কখনো আমার তেল বেশি হয়, কখনো নুন বেশি হয়, কখনো ঝাল বেশি হয় আবার কখনোবা হলুদ বেশি হয়। মা আমাকে হাতে ধরে শেখাবার পরও আমার অতিআগ্রহ বা নতুন রাঁধুনিসুলভ উত্তেজনাতে কিছুনা কিছু ভুল হতোই আর রাতে শিমুল খেতে বসে তৃপ্তি নিয়ে সেসব খাবার খুব আরাম করে খেত। আমার শোবার ঘরের জানালার ধার ঘেঁষে একটা বেলির ঝাড় দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে ঝাঁকড়া হয়ে উঠছিল। রাত হলেই দিনভর লুকিয়ে থাকা দুষ্ট কলিগুলো গাভর্তি মাতাল করা গন্ধ নিয়ে নিজেকে মেলে দিত। মাঝরাতে আমি আর শিমুল দুজন মিলে বেলির গন্ধ গায়ে মেখে নতুন করে দুজন দুজনের প্রেমে পড়তাম। রাতের কুচকুচে কালো অন্ধকারে সাদা ফুলগুলো শুধু গন্ধ নয়, শুভ্র একটা অলৌকিক আলোও ছড়িয়ে দিতে থাকত সারা উঠোন জুড়ে!!

সেদিনও ঝাঁকড়া বেলির ঝাড়টার গাভর্তি করে গুঁটি বসন্তের মত হাজারে হাজারে কলি এসেছিল। গোসলটা সেরে দুপুরের খাওয়াটা মাত্র শেষ করে উঠছিলাম আমি। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে তখনো পানি পড়ছিল। আমি বারান্দায় কাপড় মেলার দড়িতে ভেজা গামছাটা মেলে দিতে গিয়ে দরজার কাছটায় বসে ভরদুপুরে কা কা করে ডাকতে থাকা কাক দুটোকে হাত নেড়ে তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। দুটো লোক হড়হড় করে ঘরে ঢুকে পড়ছিল কথাবার্তা না বলেই। আমি এগিয়ে যেতেই লোকদুটো বলে উঠল, “চাচাজান কই”?
বাবাকে ডাকতে ঘরের ভিতরের পা বাড়াতে বাড়াতে ওদের দুজনের বিড়বিড় করে বলা কথাটা তীরের মত আমার কান ভেদ করে মাথায় গিয়ে বিঁধল।
“আহারে এত সুন্দর মিষ্টি মেয়েটার কপালে এই ছিল”! লোকদুটো সেদিন নির্মম এক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ নিয়ে এসেছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার সংবাদটা বাড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিল ভরদুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে। দুটো বাসের মাঝে প্রতিযোগিতায় ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহতদের মাঝে শিমুল ছিল। শিমুল ছিল তৎক্ষণাৎ নিহতদের মধ্যে একজন। আমার সদ্য হওয়া চাকুরীটার জয়েনিং এর তারিখ ছিল দুইদিন পর, সেদিন রাতে হয়তোবা সে আসার কথা ছিল আমাকে অবাক করার জন্য। তবে সেই দুপুরে সে সত্যি আমাকে অবাক করেই ছেড়েছিল। একইসাথে আমি স্তব্ধও হয়েছিলাম। ঠিক কতক্ষণ পর আমার স্তব্ধতা কেটেছিল মনে নাই। শুধু মনে আছে, সেদিন আমার শুকিয়ে আসা চুলে আবারো পানি ঢালা হয়েছিল। স্তব্ধতা কেটে গেলে আমি দেখতে পেলাম, মা আর রাসু গলা ফাটিয়ে আহাজারি করছে, দাদি খনখনে ভাঙা গলায় আমার নাম ধরে ক্রমাগত ডাকছে। দাদির দাঁতহীন কুঁচকানো চামড়াভর্তি মায়াবী মুখখানা আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে! অদৃশ্য কারো হাত মনে হচ্ছিলো আমার গলা চেপে ধরে বসে ছিল। আমাদের ছোট্ট গুছানো ঘরের কামরাগুলোতে চেনা অচেনা অনেকগুলো ঝাপসা মুখ অস্পষ্ট স্বরে কথা বলছিল। সেদিনের দুপুরটা থম ধরে ছিল। মধ্যদুপুরের সূর্যটাও আমার মতোই মনেহয় স্তব্ধতায় বুঁদ হয়েছিল। অসংখ্য মানুষের পায়ের নিচে পরে আমার ছোট্ট ফুলের বাগানটি তছনছ হয়ে গিয়েছিল। শোবার ঘরের বারান্দার পাশে গায়ে হাজার হাজার গুঁটি বসন্তের মত কলি নিয়ে বেলির ঝোপটা তখনো নিশ্চিন্তে রাতের অপেক্ষায় ছিল। শিমুলতো চলেই গেল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই চলে গিয়েছিল, শুধু আমি তাকে বিদায় দিতে পারিনি মন থেকে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রামের বউরা, মুরুব্বিরা কি কি সব রীতিনীতির কথা বলে আমাকে বৈধব্যে বরণ করে নেবার কথা বললে, দাদি খনখনে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল কেউ যাতে আমার সাথে এসব নিয়ে কোন কথা না বলে। বাবা, মা, রাসু, রাতুল সবাই আমার গা ঘেঁষে আমাকে ছুঁয়ে বসেছিল। মা আহাজারি করতে করতে বলেছিল, “ আমরা সবাই আছিরে মা। তোর জন্য আমরা সবাই আছি”। সত্যি সবাই ছিল আমার জন্য। সবাই আমাকে ভীষণ রকমের ভালবেসেছিল কোন কারণ ছাড়াই। আমার বাবা মা, মামা মামি, সৎ ভাই বোনরা – সবাই সেদিন থেকে আলাদা আলাদা করে আমার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল। আমার ভাল থাকাটা যেন সবার ভাল থাকার জন্য খুব বেশি জরুরী হয়ে পড়েছিল সেদিন থেকে।সবার চোখের একটা বিষাদগ্রস্ত ভালবাসা আমার কাছে ধীরে ধীরে অসহ্য লাগতে শুরু করে। কাউকে কিছু বলার বা কারো কিছু শোনার চেয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়াটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।

শিমুলকে আমি ভালবেসে ছিলাম, তাঁর সাথে আমি জীবন শুরু করেছিলাম। কিন্তু এমন জীবনের গ্যারান্টি কি আমি নিজেই নির্ধারণ করতে পারি যে, আমার ভালবাসার মানুষটি কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবেনা!! শুরু থেকে শেষ অবধি কি একজন মানুষ আরেকজন মানুষের হাত ধরে রাখতে পারে! যে চলে গেছে তাকে ভেবে কি আমাকেও মরে যেতে হবে! আমার মনের ভিতরে সেই মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া অফুরন্ত স্মৃতি, ভালবাসা, কথোপকথন যদি জীবনীশক্তি হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে কেন সমাজের আর পরিবারের শত শত রীতিনীতি আর বিষাদভরা ভালবাসা বা দরদ দিয়ে আমাকে মেরে ফেলা হবে! আমি মানতে পারছিলামনা। আমি ধীরে ধীরে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম। মানিয়ে চলা আর মেনে চলার জন্য প্রতিদিন আমার জীবনটাকে নিংড়ে নিংড়ে সবটুকু রস বের করে ফেলা হচ্ছিল। আমার ভালবাসার বাগানটা ধীরে ধীরে অযত্নে আর অবহেলায় আগাছাতে ভরে যাচ্ছিল। আমার স্বপ্ন আর স্বপ্নের সংসারভরা ভালবাসার মানুষগুলো হাসতে, কথা বলতে ভুলে যাচ্ছিল! দাদি উনার নাতির শোকে প্রায় মৃত্যুশয্যায় তখন, বাবার দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে থাকে সবসময়, আর মা তো মা। মায়ের দিকে তাকাতেই ভীষণ ভয় হত আমার! শিমুলের ছোট ভাইবোন দুটোকে শক্ত করে মানুষ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম আমি তখন।

আমার বয়স তখন পঁচিশ ছাড়িয়ে ছাব্বিশের ঘরে। “জীবনটা কারো জন্যই থেমে থাকেনা, কেউ চলে গেলে জীবনটাকে থামিয়ে রাখা যাবেনা, শ্বাসরোধ করে নিজেকে মেরে ফেলা যাবেনা কারণ সবার জীবনে মৃত্যু আলাদাভাবে আসে তাই যতক্ষণ বেঁচে আছি নিজেকে কাজে লাগাতে হবে” আমি প্রতিদিন সকালে স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতে বাবা আর মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। রাসু আর রাতুলকে পড়াশুনা করার জন্য, গুছিয়ে জীবনটাকে দেখার জন্য উৎসাহ দিতাম। ঝিমিয়ে আসা আমার সংসারটাকে যতটুকু পারি সজীব করার জন্য যুদ্ধে নেমেছিলাম আমি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আমি একজন মেয়ে! আমি একজন ছাব্বিশ বছরের সন্তানহীন যুবতী বিধবা! আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম, একজন মেয়ের বিশেষ করে একজন যুবতী বিধবা মেয়ের নিজের স্বপ্ন, নিজস্ব আত্মসন্মানের চেয়েও পরিবারের আর সমাজের আত্মসন্মানকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। একদিন শুনি, মা আর বাবা আমাকে আবার বিয়ে দিতে চায়!! আমি সেদিন এত বেশি অবাক হই যে কাঁদতেই ভুলে যাই! দাদি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত মুঠোয় নিয়ে জানায় তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে আমার বিয়ে দেখে যেতে চান! রাসু আর রাতুলও আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চায়, আমার বিয়ে করাটাই জরুরী! আমি মামা মামি আর বাবা মাকে কঠিন কঠিন সব শব্দ দিয়ে আমার জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেও এই মানুষগুলোর এমন বিষাদভরা ভালবাসায় সত্যি একসময় অতিষ্ঠ হয়ে পরি। দীর্ঘদিন ধরে প্রানপ্রন চেষ্টা করেও আমি কাউকেই বুঝাতে সক্ষম হইনি যে কোন কোন মানুষের জীবনে কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যা তাঁর আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে! এমন কিছু মূল্যবান স্মৃতি, মহা মূল্যবান এমন কিছু অনুভূতি যা শুধু একজীবনেই জড়িয়ে থাকে, অন্যজীবনে তাঁর কোন স্থান নাই!! কিন্তু কেউ আমাকে বুঝতে চায়নি। কারণ আমি মানুষ নই, আমি একজন মেয়ে মানুষ!! একজন বিধবা যুবতী মেয়েমানুষ! সেসময় আমার মনে হয়েছিল, সতীদাহ আসলেই তেমন কোন দোষের কিছু ছিলনা!! অন্তত আমার জন্য ভালোই হত! অন্তত একজীবনের অমূল্য কিছু সুখস্মৃতি নিয়ে অন্যকারো জীবনে প্রবেশ করার সুযোগ থাকত না! আমি একসন্ধ্যায় কাউকে কিছু না বলে আমার সংসার, আমার সংসারের প্রিয়সব মুখ আর অসংখ্য কলি নিয়ে রাতের অপেক্ষায় থাকা বেলির ঝোপটা পিছনে ফেলে চলে আসি। শুধু নিজেকে নিয়েই আমি চলে আসি নিজের মত করে থাকার জন্য। আমার সারাটা বুক জুড়ে বসে থাকে আমার নিজস্বতা, আমার আত্নবিস্বাস আর আমার নাক জুড়ে বসে থাকে আমার ভালবাসা আর অফুরন্ত জীবনীশক্তি নিয়ে একটা নাকফুল। একটা সাত পাথরের নাকফুল।

-তাসলিমা শাম্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *