ক্ষরণ ( ৩য় পর্ব )



৫.
গত মাসে পর পর অনেক গুলো ঘটনা ঘটে গেছে। রুমীর বাবার চাকরি চলে গেছে। মা ফিরে এসেছে। কেস কোর্টে উঠেছে। প্রথম তারিখ দেয়া হয়েছে আগামী সপ্তাহে। সংবাদ মাধ্যমের লোক এসেছে কয়েকবার , তারা তার মুখে ঘটনার বিবরণ রেকর্ড করেছে। প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তা প্রচারিত করা হচ্ছে। রুমী আজ দুপুরে খাবার ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে যে বিষয় টা আবিষ্কার করলো তা রীতিমত আতংকের। ১৫ থেকে ২০ জনের একটা দল যারা সবাই যুবক , বাড়ীর চারপাশে ঘোরা ফেরা করছে। তাদের সবার দৃষ্টি এই বাড়ীর দিকে। রুমী জানালা বন্ধ করে তাকাতেই মা’কে দেখতে পেল। তিনি মেয়ের হাত ধরলেন — “ভয় পাস না, কিচ্ছু করবেনা ওরা। ভয় দেখাতেই আসছে। কিছু করলে ফলাফল আরও খারাপ হবে এটা ওরা জানে।” রুমী তাকিয়ে রইল, মায়ের এই ভূমিকায় সে বিস্মিত। যেদিন মা ফিরে আসে সেদিন বাবার হাঁটুর কাছে বসে ছিলেন চুপচাপ, খুব কাঁদছিলেন। বললেন — ” আমারে মাফ করবেন, আমার বুদ্ধি কম। তাই ভয় পাইছিলাম। খুব অন্যায় হইছে। আমার এতটুক মেয়েটা এত বড় আঘাত একা একা সামলেছে। এত কিছুর মধ্যেও সে মাথা সোজা করে দাঁড়ায়ে আছে, লজ্জায় মরে যাইতেছি। মেয়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নাই আমার ! যে সময়টায় আমারে তার সবচেয়ে বেশী দরকার ছিল, তখনই আমি তারে ফেলে চলে গেছি।” বাবা মায়ের মাথায় হাত রাখলেন। দূর থেকে এই দৃশ্য রুমীর কাছে কোন স্বর্গীয় ক্ষণ মনে হয়েছিল। দুর্বিসহ এই দিনগুলোর মধ্যেও অদ্ভুত এক প্রশান্তির স্পর্শ পেয়েছিল সে।

আজকের প্রেক্ষাপট পুরোই ভিন্ন। তাকে দেখামাত্র কালুমিয়া হাসিমুখে লম্বা একটা সালাম দিল, নিজের থেকেই বাড়ীর ভেতরে খবর দিল। খোরশেদ উপভোগ করল বিষয়টা। দ্রুত রঙ পাল্টানোর বিদ্যাটা এদের বোধহয় মনিবের কাছ থেকে প্রাপ্ত হয়। বাড়ীর সামনের সুইমিংপুল আর মার্বেল পাথর বিছানো লন পার হতে হতে সে ভাবল — একজন এম পির সরকারী বেতন স্কেল কত! এত বছর পুলিশে চাকরী করে এই তথ্য সে জানেনা। বড়ই লজ্জার বিষয় এটা। দরজায় হাত রাখার আগেই খুলে গেল। কাজের একটা মেয়ে বসতে বলে চলে গেল। সে বসতে পারলনা। এমন সোফা তার চৌদ্দগুষ্ঠিতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয়না, মাথার উপরের ঝাড়বাতি দেখতে গিয়া ঘাড়ে খিল ধরে গেল। আহা! মানুষের কত শান্তি ! এমন একটা ঘরে একরাত থাকতে পারলেও জীবন ধন্য। এরা নিশ্চই বেলি ফুলের মত ভাত খায়! আচ্ছা, এরা কি আদৌ ভাত খায়? যে বাদশাহি অবস্থা , খানাপিনা নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের মত না।

” কি ব্যাপার , তুমি এত সকালে? ”

চমকে তাকাল খোরশেদ—– “স্যার আপনার বাড়ী দেখে পুরা স্ট্রোক করার মত অবস্থা আমার! এই বাড়ীর কাজের লোক হয়ে কাটালেও জীবন ধন্য! আপনার বাড়ীর কাজের লোকদের বেতন কত স্যার ? গেট দিয়া আসতে আসতে প্রায় আধা ডজনের সাথে দেখা হইল! ”

হুংকার দিলেন এম পি সাহেব — “ফালতু কথা বাদ দাও ! তোমরা এত্ত গুলা মানুষ সামান্য কাজটা করতে পারলানা! রাজনৈতিক মহলে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। কাল দেখলাম মুখ ঢাইকা সাক্ষাতকার দিছে! এত হিম্মত এই ছেমড়িরে কে দেয়? তুমি আর কমিশনার মবিন কি এলাকায় বইসা ঘাস খাও? ছেলেটা পড়ে আছে কোন অজপাড়াগায় ! তার মা আমার ঘুম হারাম করে দিতেছে ! তার ধারনা আমি ছেলেরে বাঁচাইতে কিছুই করতেছিনা! বদ পোলাপাইন ! তোর মেয়ে মানুষ নিয়া ফূর্তি করতে মন চাইছে, কর ! এলাকার মধ্যে কি ! পয়সা দিলে মেয়ে মানুষের অভাব ? ফকিরের বাচ্চা একটা তুলে নিয়া আকাম কইরা আমারে ফাঁসাইছে!”

“স্যার মাথা গরম করবেন না। আমি এ বিষয়েই কথা বলতে আসছি। বলছিলাম কি, ব্যাপার টা তো হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, মিডিয়া এমন লাগা লাগছে পেছনে! টাকা দিয়াও বা ক’জনেরে থামাবেন! তাই বলি কি, আসেন একটা গেম খেলি। দেখেন, মিডিয়া বেশী তোলপাড় করতেছে কারন আসামী এখনো ধরা পড়ে নাই। আসামী ধরা পড়লেই দেখবেন ঢিলা দিবে।”

” কি বললা তুমি ? ”

“স্যার মাথা ঠাণ্ডা করে পুরাটা শোনেন! আপনার ছেলে যতদিন জেলখানায় থাকবে, রাজার হালে থাকবে। সব স্পেশাল ব্যবস্থা থাকবে তার জন্য। সে এরেস্ট হইলে গণমাধ্যম ভাববে পুলিশ কাজ শুরু করছে সিরিয়াসলি। তখন তাদের লাফালাফি কমে যাবে। তখন একটু সময় নিয়ে ছেলেটার জামিনের ব্যবস্থা করায় ফেলবেন। ফাঁকে আমরা যেভাবেই হোক মেয়েটারে কনভেন্স করার চেষ্টা করব। ভয়ভীতি দেখায় না হলে টাকা পয়সা দিয়া! টাকার লোভ সাংঘাতিক! পরিমাণ বাড়ায়ে দিলে এড়াতে পারবেনা, অভাবী পরিবার তো!”

এম পি লিয়াকত চুপ করে রইল কতক্ষণ। “হুম মন্দ বল নাই! ভেবে দেখা যায়।”

“স্যার আরেক টা বিষয় বলতে চাই, যদি অভয় দেন।”

“এত নাটক কইরো নাতো! বল।”

“কোন ভাবে যদি এইটা দেখানো যায় যে আপনিই আপনার ছেলেকে ধরাইয়া দিছেন, তাহলে আপনার পাবলিক ইমেজ কই গিয়া দাঁড়াবে ভাবেন! জনগণ আপনারে ফেরেশতা ভাবা শুরু করবে। নিউজ পেপারে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হবে —- “অন্যায়ের সাথে আপোষহীন এক নেতা।” এতে দুই দিকে কাজ হবে। এক, রাজনৈতিক মহলে আপনি আপনার হারানো ইমেজ ফিরে পাবেন, আর দুই, সাধারণ মানুষ আপনারে সাধুবাদ দেবে। সামনের ইলেকশনে ও এই ইমেজ টা দারুণ কাজে দেবে।”

ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল এম পি সাহেবের। “তুই তো ব্যাটা জিনিয়াস! বয়, জুস খা! মালয়েশিয়া দিয়া বড় এক কার্টন জুস আনছিলাম। আমার ছেলেটার আবার জুস ফেভারিট!”

৬.

অসময়ে স্কুল থেকে ফিরল বাবলু। ব্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়েছিল চুপচাপ। মায়ের স্পর্শ পেতেই উঠে বসল। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া বাবলু এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি তার অতি পরিচিত গণ্ডিটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। স্কুলের বহুদিনের চেনা মুখ গুলো বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাকে তাদের জগত থেকে। কেউ তেমন কথা বলে না। খেলার মাঠে খেলতে ডাকেনা কেউ। এমনকি অংকের মতিন স্যার ও ভাল করে কথা বলেন না, এড়িয়ে চলেন। অথচ সে তার প্রিয় ছাত্র ছিল! বুঝতেই পারছেনা সে, তার কি দোষ! সবাই কেন এমন ভাবে তাকায়, যেন সে অপরাধী ! মায়ের হাত ধরল বাবলু — “আমি আর স্কুলে যাব না মা।”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে মমতাজের। কারন টা জিজ্ঞেস করে পরিবেশ টাকে আর ভারী করতে চাইলেন না তিনি। “আচ্ছা যাস না। এখন ওঠ, চল খেয়ে নিবি।”

দুপুরের খাবার সময় টা পার হয়ে গেছে অনেক্ষণ। দুবার ডাকতে এসেও ফিরে গেছেন মমতাজ। ঘুমুচ্ছে মেয়েটা। সারাটা রাত জেগে থাকে, ঘুমায় না একদম। চোখ ভরে এল মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে। বাবলু ছাড়া এ ঘরের প্রতিটা মানুষ প্রায় নির্ঘুম রাত পার করে। রাত যত গভীর হয়, হতাশা আতংক অনিশ্চয়তা নামের ভয়ংকর বোধগুলো প্রবল ভাবে গ্রাস করে।

আবদুর রহমান নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন রুমীর ঘরে। মেয়েটার সাথে কথা বলা হয়না আগের মত। অদ্ভুত এক অস্বস্তি হয়। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। দৃষ্টি শক্তির স্পর্শন আছে একটা। রুমী জেগে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসল “কি হয়েছে বাবা? “

খবরের কাগজ টা এগিয়ে দিলেন তিনি — “জানোয়ারটা ধরা পড়ছে। বাপ ধরায়ে দিছে। বুঝতে পারতেছিনা কি ঘটতেছে। এত্ত কিছু করার পর আবার এখন নিজেই ছেলেরে ধরায়ে দিল! বিষয় টা চিন্তার! “

রুমী মনোযোগ দিয়ে খবর টা পড়ল — “বাবা বিষয় টা তো এমনও হতে পারে যে সে নিজের ভুল বুঝতে পারছে। নিজের ছেলে বলে একটা মায়া কাজ করছে এত দিন, তাই বাঁচাতে চেয়েছে। কিন্তু সমস্ত কিছু বিবেচনা করার পর ওনার মনে হয়েছে বিষয় টা অন্যায়, তাই ধরায়ে দিল ! “

রহমান হাসলেন “দুনিয়াটা এত সহজ নারে মা! তোর মন সাদা, তাই সব কিছু দেখিস সোজা ভাবে। এর পেছনে কোন বড় চাল তো আছে, বুঝতে পারতেছি না। থাক বাদ দে! তুই ওঠ, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে।”

স্নেহের স্পর্শে কেঁপে উঠল রুমী। খুব ইচ্ছে হল বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে কতক্ষণ ! কত দিন জড়িয়ে ধরে না বাবাকে !

আজকাল খবর দিয়ে আর অপেক্ষা করতে হয়না। খোরশেদ সরাসরি চলে যায় প্রাসাদের ভেতরে। সে এখন আস্থা ভাজন খাস লোক। সোফায় বসে পা নাচাতে নাচাতে মনে হল, জীবনে টাকা আর ক্ষমতার প্রভাব সত্যি মারাত্মক! কুকুর বিড়ালের মত বেঁচে থেকে কি লাভ! দামী সোফায় বসে ইমপোর্টেড ক্রিস্টেল গ্লাসে জুস খাওয়ার মজাই আলাদা। জুস শেষ হয়ে গেলেও হাত থেকে গ্লাস রাখতে মন চায়না! জুসের সাথে এরা আবার প্লেটে সাজিয়ে ছোট ছোট বাদাম জাতীয় একটা জিনিস দেয়, যা না খেলে জীবন বৃথা! এম পি সাহেব নামছেন সিঁড়ি দিয়ে , তার পড়নে দামী আদি কাপড়ের পাঞ্জাবী। দাঁড়িয়ে গেল খোরশেদ। “স্যার শরীর ভাল! প্রোগ্রাম আছে নাকি কোথাও? ”

“হুম। তোমার খবর বল। সব ভাল? জামিনের ব্যবস্থা কবে করব, কাল পড়শু করায়ে ফেলি, কি বল? “

“স্যার! একটা সমস্যা হয়ে গেছে একটু বসেন মাথা ঠাণ্ডা করে, বুঝিয়ে বলি।”

কপালে ভাঁজ পড়ল এম পি সাহেবের। পাঞ্জাবীর পেছনের অংশ তুলে সাবধানে বসলেন। পাঞ্জাবী পেছন থেকে কুঁচকে গেলে তার সাংঘাতিক মেজাজ খারাপ হয়।

“দেখেন, সবকিছুই তো ঠিক ছিল। কাল বা পড়শু জামিন করানোর কথা আমিই আপনাকে বলতে চাইছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে এখন ফট করে মানবাধিকার সংস্থা ঢুকে গেছে। তারা নাকি মেয়েটার হয়ে লড়বে। এরা ভেজাইল্যা লোক, খোঁচাখুঁচি করে বেশী। এদিকে মেয়েটা আপনার ছেলের নাম সুস্পষ্ট ভাবে বারবার বলছে সাক্ষাতকারে। সেটা আবার চ্যানেল গুলায় বারবার দেখাইতেছে। সব মিলায়ে জট পাকাই গেছে। আমার পুরা প্লান গুবলেট ! কি করব বুঝতেছিনা ! তবে একটু সময় দেন। এই মাথা কোন একটা পথ বের করে ফেলবে ইনশাআল্লাহ।” খোরশেদ কায়দা করে একটা হাসি দিল। এই হাসি ফাঁসির আসামী “কিরিচ কাশেমের” কাছ থেকে রপ্ত করা। শালা হাসিটা দিত জব্বর! কলিজার মধ্যে গিয়ে লাগত।

“এম পি লিয়াকত আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন “তোর উপর ভরসা করাটাই বোকামি হইছে। তুই বের হ’, এক্ষুনি বের হ’।”

খোরশেদ বের হয়ে এল। কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। এদের অস্ত্র থাকে লাইসেন্স করা। গুলি একটা মেরে বাগানে পুতে দিলে কেউ জানবেও না। একটা আফসোস রয়ে গেল! জুস খাওয়া হলো না। বুদ্ধির ভুল। জুস টা খেয়ে খবর টা বলা উচিৎ ছিল। কালু মিয়াকে দেখতে পেল, আজ সে হলুদ শার্ট গায়ে দিয়েছে। পুরা রেডিয়ামের মত জ্বলছে। তাকিয়েই মাথা ধরে গেল। গেট থেকে বেরিয়ে সোজা বাস ধরল সে। এই অসময়ে বাসে এত ভীড় ক্যান কে জানে! বসার কোন সীট খালি নাই। পুরাটা পথ যেতে হবে বানরের মত ঝুলতে ঝুলতে।

৭.

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আজ অনেক দিন বাদে ঘুম জড়িয়ে এল চোখে। বিকেলের আজান কানে আসতেই উঠে বসলেন তিনি। আজ কয়েক দিন ধরে মসজিদেই নামাজ পড়ছেন। সময়ে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে মানুষের কৌতুহলে। নামাজ সেরে বাড়ীর কাছাকাছি আসতেই মমতাজকে দেখতে পেলেন। উদ্বিগ্ন ভাবে তাকিয়ে আছে। কাছে আসতেই হাত ধরল সে “শোনেন, বাবলু রে কোথাও দেখতেছি না।”

“খেলতে গেছে হয়ত!”

“সে তো খেলতে যায়না! কিছুক্ষণ আগে বসে ছিল এই গাছ টার কাছে। এখানেই বসে থাকে। মানুষজন নানান প্রশ্ন করে, তাই কোথাও যায়না। “

“অযথাই চিন্তা করতেছ! সামনের বাড়ীর রকিবরে জিজ্ঞেস করছ? কাছেপিঠে আছে কোথাও! যাবে কই! এত অস্থির হইতেছ ক্যান? “

“মমতাজ বাড়ীর ভেতরে এলেন। হয়ত খামোখাই ভাবছেন। ছেলে মানুষ কতক্ষণ বাড়ী বসে থাকবে! মেয়েটাকে মাথায় তেল দিয়ে দিতে হবে। কয় দিনে পাগলের মত অবস্থা হয়েছে চুলের! চুল বেঁধে, বাগানের গাছগুলোতে পানি দিতে দিতে সন্ধ্যার আজান পড়ল। বাবলু এখনো ফেরেনি। অজানা আশংকায় তার বুক কেঁপে উঠল। দৌড়ে রুমীর ঘরে গেলেন তিনি।

সন্ধ্যা হবার পরও অনেক টা সময় পার হল। আশেপাশে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হল। আবদুর রহমান দিশা হারালেন খানিক টা। রুমী দাঁড়িয়ে রইল প্রাণহীন মানুষের মত। সন্ধ্যার পর বাবলু কখনো বাইরে থাকেনা, কখনোই না। ভয়ংকর কিছু কি ঘটেছে? হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল, দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে আসছে ক্রমশ। সে দরজা ধরে কোনমতে সামলালো নিজেকে। সব কিছু আজ তার জন্য। কি হবে এখন! সত্যি যদি বাবলু না ফেরে ? মুখটা মনে পড়তে লাগল বারবার। মায়ের দিকে তাকাল, একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে মা। বাবা উঠে দাঁড়ালেন — “ওজু কর রুমীর মা! জায়নামাজে বস। আল্লাহ্‌ এত নিষ্ঠুর কিছুতেই হতে পারেন না! শেষের কথায় গলা ধরে গেল তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে রুমীর। সেদিন রাতে মরে গেলেও ভাল ছিল। মেঝেতে বসে পড়ল সে। হঠাৎই যেন প্রাণের সঞ্চার হল। দৌড়ে বাবাকে ধরল শক্ত করে। “বাবা ওঠো! থানায় যাবো, এক্ষনি।”

খোরশেদ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। “বয়স কত আপনার ছেলের?”

“তেরো। ক্লাস সেভেনে পড়ে।”

“দেখেন, বাচ্চা ছেলে তো না! হারিয়ে যাবার কিছু নাই। হয়ত বন্ধু বান্ধবের সাথে আছে কোথাও! চলে আসবে। আপনারা অযথা দুশ্চিন্তা করছেন। “

“সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়েছে। বাবলু নিজে কোথাও যায়নি অফিসার। আমার ভাই টা খুবই চুপচাপ, ঠাণ্ডা। জীবনেও সন্ধ্যার পর বাইরে থাকেনি। তাকে কি করেছেন আপনারা?!” শেষের দিকে নিজের গলাটা অচেনা লাগল রুমীর।

খোরশেদ হাসল — “মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার! আমরা কি করেছি মানে? সাহস কত আপনার! আর চিৎকার দিয়া কথা বলবেন না একদম! মেয়ে মানুষের চিৎকার সহ্য করিনা আমি।”

“আমার ভাইটা দুপুর বেলা ভাত খেলো। কতদিন পর আমরা গল্প করলাম উঠানে বসে। কোথায় যাবে সে? আমার মা শোকে পাথর হয়ে গেছে। জায়নামাজে সিজদা দিয়ে আছে, আর তোলেনা মাথা! সব বুঝতে পারছি আমি। এটা একটা চাল! আমার ভাইটাকে ফেরত দেন।”

“আজব ব্যাপার! আপনি যান তো! মিসিং কমপ্লেইন করতে চাইলে বলেন, লোক ডাকি, লিখে নেবে। আজাইরা কথা একদম বাদ!”

রুমী বসে পড়ল মেঝেতে —- “কি করছেন আমার ভাইটাকে ? মেরে ফেলেছেন? ভাইরে…. আর্তনাদে কেঁপে উঠল ঘরটা।

নাঈমা পারভীন অনামিকা

                                         চলবে.........

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *