ক্ষরণ ( ১ম পর্ব )

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ২৩ বছরের রুমী। হঠাৎ করে স্বীকার হয় পাশবিকতার! ওলটপালট হয়ে যায় তার চেনা পৃথিবী। আমার গল্প রুমীকে নিয়ে, তার হেঁটে চলা জীবনকে নিয়ে……।

………………………………

এজাহারের কাগজটা হাতে নিয়ে খোরশেদ খানিক টা সামনের দিকে ঝুকে বসল। তার দৃষ্টি টেবিলের অপর প্রান্তে বসা দুজন মানুষের দিকে। “আচ্ছা! আপনার বক্তব্য অনুযায়ী তখন প্রায় রাত ৮ টা। তখন কি করছিলেন ওখানে আপনি?”

আবদুর রহমান মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন। ” স্যার ও’তো প্রতিদিন ঐ সময়েই বাড়ী ফেরে।”

“আপনারে জিজ্ঞেস করছি মিয়া ? আপনি বাইরে যান, কই যান! বাইরের টুলে গিয়া বসেন। একা কথা বলব ভিকটিমের সাথে।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন তিনি, মেয়ের দিকে তাকালেন। সে দৃষ্টিতে মেয়েকে সাহস দেবার সর্বচ্চো প্রচেষ্টা ছিল।

“তো বলেন, ঘটনা ঘটল কাল রাতে। আজ সারাদিন পার হয়ে গেল। এখন আসছেন থানায়। কারন কি ? “

রুমি তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে।

“তাকিয়ে থাকলে তো চলবে না। কথা বলেন। আপনি যত কথা বলবেন তত সুবিধা। বয়ফ্রেন্ড আছে? এ যুগের মেয়ে। থাকাটা স্বাভাবিক। বয়ফ্রেন্ড থাকলে কেস বুঝতে সুবিধা। একবার হইছে কি শোনেন, ২০০৫/৬ এর দিকের ঘটনা। মেয়ে আর মা আইসা থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করল। মেয়ে কাঁদতেছে সাথে মা’ ও। ভদ্র ফ্যামিলি। মেয়ের গলা, হাতে নখের আচড়, ঠোঁটে রক্ত জমাট হয়ে আছে। এমন খারাপ লাগল, রাতেই বের হলাম আসামী ধরতে। ছেলেটা ডাক্তার, কেবল M.B.B.S করে বের হইছে। ধইরা আইনা এমন মাইর দিলাম! পুলিশের মাইর তো জানেন না। দুনিয়ার যত রাগ আছে সব ঝাড়ে আসামীর উপর। মাইর খাইয়া আধা মরা, তাও স্বীকার করে না যে সে এই কাজ করছে। সারা রাত কোঁ কোঁ কইরা সকালে বলে পিংকিকে বলেন, আমি তাকে বিয়ে করব। শুনেই মেয়ে অভিযোগ তুলে নিল! আমি তো তাজ্জব। পরে শুনি মা আর মেয়ে মিলে নাটক সাজাইয়া ছেলে টারে ফাসাইছে। ছেলেটা যে নির্দোষ তা না, তুই ব্যাটা প্রেম করছস! মজা নিছস! বিয়ে করবি না?”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রুমী।

খোরশেদ পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসল- “আপনার ব্যাপার টা অবশ্য ভিন্ন। চাকুরীজীবী মেয়েরা আবার একটু খড়খড়া হয়! প্রেম ফ্রেমে জড়াইতে চায়না। তবে বিষয় টা কিন্তু চিন্তার। মেইন রাস্তায় বাস দিয়া নামলেন, তারপর বাড়ীর রাস্তা ধরলেন। একা নিশ্চই বাস দিয়া নামেন নাই! নাকি ঐখানে নামার প্যাসেঞ্জার আপনি একাই ছিলেন ? আবার ঐ রাস্তায় তখন আর কেউই ছিল না, এইটা কেমনে হয়? ছেলেগুলা আইসাই তো আপনারে ফট করে তুলে নিয়া যায় নাই, বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত! দু’চার মিনিট কথাবার্তা ধস্তাধস্তি তো হবার কথা! কেউ যদি সাহায্য করতে নাও আসে, দূরে গিয়া তো চিৎকার চেঁচামেচি করবে, মানুষ জড়ো করবে তাইনা ? কেউ জানলো না, শুনল না, আপনি শান্ত পরিবেশে ইজ্জৎ হারাইয়া আসলেন! বিষয় টা সিনেমারে ও হার মানায় বুঝলেন !”

ক্ষিপ্র গতিতে উঠে দাঁড়ালো রুমী– “ছেলেটা স্থানীয় এম পির ছেলে। সাথের ছেলেগুলা তার বন্ধু। কয়েকজনই ছিল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আমি কারও নাম বলি নাই, কারন মরে গেলেও কেউ মুখ খুলবেনা। আমার বাবাও আমাকে হাত জোর করে কাল রাত থেকে অনুরোধ করছেন যেন থানায় না আসি। বাবা জানেন সবার আগে তিনি তার চাকরী টা হারাবেন, কারন বাবার স্কুল টা অর্ধেক চলে এম পির অনুদানে। আমরা হয়ত এলাকা ছাড়া হব, আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে থাকবে একে একে। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করলাম। কাল, আজ। কিন্তু আমি এভাবে বাচতে পারবনা। বাবা নিতান্ত বাধ্য হয়ে এসেছেন আমার সাথে। জানিনা কতক্ষণ থাকবেন আমার পাশে। মা সকালে ছোট ভাই টাকে নানার বাড়ী চলে গেছে। লোক জানাজানির পর মুখ দেখাতে পারবেনা তাই। আমি ধরেই নিয়েছি থাকবেনা কেউ আমার পাশে।”

“পারবেন না। এত সোজা না। আসামী এম পির ছেলে এইটা আগে বললে এজাহারই লিখতাম না। হুদাই সময় নষ্ট। যান, তারচেয়ে দেখেন এম পি সাহেবরে ধইরা কিছু ক্ষতিপূরণ পান কিনা। ভবিষ্যতে কাজে দেবে। এই দেশে রাজনীতিবিদ গো পোলাপানের বিচার হয়না। দু’ একটা আকাম কুকাম বরং তাগো শোভা বাড়ায়। বাড়ী ফিরা যান। রক্ত গরম তো! আরও মাইয়া মানুষ বুদ্ধি কম। এখন জোশে নাচতাছেন, এম পি সাব ধাবড়ানি দিলে ঠাণ্ডা হইয়া যাবেন। ” কাগজে মোড়ানো খিলি পান টা মুখে দিয়ে নির্বিকার ভাবে পা নাচাতে লাগল খোরশেদ।

তীব্র ঘৃণা তাকিয়ে রইল রুমী, তারপর একরকম ছিটকে বেরিয়ে এল। মাথার মধ্যে দপদপ করছে অনবরত। প্রচণ্ড গতিতে সে হেটে চলে এল অনেকটা পথ। বড় অর্জুনগাছটা পর্যন্ত এসে থেমে গেল। বসে পড়ল গাছটার শেকড়ে, বড় অসহায় লাগছে। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল, কি করবে সে! গতরাতের ভয়ংকর কুৎসিত স্মৃতি মনে চাপা দিয়ে বাচতে পারবেনা, কিছুতেই না। স্পর্শে মাথা তুলল রুমী, মাথার উপর রাখা বাবার হাতটাকে আঁকড়ে ধরে আর্তনাদ করল– বাবাগো !

২.

চারতলা এই ভবনের নীচতলা আর দোতলা মিলে ক্লিনিক। খোরশেদ রাস্তার পাশের চায়ের দোকান টায় বসল। দুপুর দুটো প্রায়, এখন লাঞ্চ টাইম। সে রিসিপশনে দাঁড়াল। অল্পবয়সী একটা মেয়ে খুব আহ্লাদ করে কথা বলছে ফোনে। তাকে দেখা মাত্রই চুপ হয়ে গেল। একটা বিষয় তার কাছে স্পষ্ট না। মানুষ তাকে দেখলেই চমকে ওঠে। সেটা তার ইউনিফর্ম দেখে না চেহারা দেখে, ঠিক বুঝতে পারেন না। তার চেহারা কি খুব ভয়ংকর!! সাদা পোষাকে বিষয়টা পরীক্ষা করতে হবে। রিসিপশনের মেয়েটার মুখ রক্ত শুন্য, আজব বিষয়! খোরশেদ হাসার চেষ্টা করল। তাতে উল্টো ফল হল, মেয়েটা আরও ভয় পেয়ে ঘামতে লাগল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার কপালে। “শোনেন! রিসিপশনে কাজ করে একটা মেয়ে, ফারজানা খানম রুমী। ও’ আসে নাই আজ ? “

“জ্বী না, আজ দুদিন ধরে সে আসছেনা। আজ সকালে তার বাবাকে দিয়ে ছুটির এপ্লিকেশন পাঠিয়েছে। ”

“ও আচ্ছা! কি হইছে কিছু বলতে পারেন? মানে অসুখ বিসুখ কিনা ? “

“জ্বী না জানিনা কিছু। আমাদের এডমিনেস্ট্রেশন স্যার কে ডেকে দেব? ওনার কাছে এপ্লিকেশন দেয়া হয়েছে!”

খোরশেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা কথা বলতে চাইছে না। এদেশে পুলিশ দেখলেই মানুষ আজাব মনে করে। পাশ কাটিয়ে যায়। সামনের বিশাল করিডোরে চোখ রাখল। হাটতে হাটতে চলে এল প্যাথলজির সামনে। বয়স্ক মতন একজন মহিলা সাদা শাড়ী আর এপ্রোন গায়ে, খোরশেদ কাছাকাছি দাঁড়াল। ” আচ্ছা! আপনাদের রিসিপশনে কাজ করে ক’জন ?

ভদ্রমহিলা তাকালেন– “স্যার তিন জন। শিফটিং ডিউটি। এখন যে আছে সে থাকবে তিনটা পর্যন্ত। তারপর আরেকজন বসবে। কেন স্যার ? “

“রুমীর ডিউটি কখন ? “

“সেতো আজ আসবেনা। ছুটি নিয়েছে। কেন স্যার, কোন ঝামেলা হয়েছে ?” তার চোখে কৌতুহল।

এরা কিছুই জানেনা। জানার কথাও না। তবে সময় লাগবেনা। একবার মিডিয়ার কানে পৌঁছতে পারলে হইছে, রাতারাতি বিখ্যাত করে ফেলবে মেয়েটারে। এ ব্যাপারে তাদের জুড়ি নেই। মিডিয়ার কারও সাথে তেমন খাতির নেই তার। কি একজন রিপোর্টার ছিল, রাশেদুল না কি নাম। কার্ড দিছিল একটা। বাদ! বাদ! খামোখা এসব নিয়ে ক্যান যে ভাবে ! “আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনাদের এই রুমী মেয়েটা কেমন? “

ভদ্রমহিলা এবার সহজ হলেন– ” সেকি কিছু করেছে স্যার? করতেই পারে। দুনিয়ার বেয়াদব মেয়ে। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে মুখের উপর, কাউকে মানেনা। আরে! তুই দুই দিন হলো এখানে জয়েন করেছিস, সিনিয়র জুনিয়র মানবিনা ? যার তার সাথে বেয়াদবি করে। মহা ফাজিল মেয়ে।”

খোরশেদ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ — “আচ্ছা আসি।” সোজা হেঁটে ডানে ঘুরে বেরিয়ে এল সে। মাথার উপর প্রচণ্ড রোদ। আশেপাশে সস্তা কোন হোটেল পেলে দুপুরের খাবার টা সেরে ফেলা যেত। ক্ষিদে একদম সহ্য হয়না তার। “হোটেল লাঞ্চ” নামের একটা হোটেলের সামনের চুলায় ইলিশ মাছের ডিম ভাজা হচ্ছে। দেখে ক্ষিদে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লালশাক ভাজি, আলুভর্তা আর বড় সাইজের একটা ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে সে ভাত খেল। এদের চালের কোয়ালিটি অসাধারণ! ভাত গুলো বেলি ফুলের মত সাদা ঝরঝরে। কোন পাথর নেই। এই ভাত খালি লবণ দিয়েও এক প্লেট খেয়ে ফেলা যায়। সারাটা জীবন কাটল মোটা চালের ভাত খেয়ে! জীবন টাই বৃথা! সামনের দোকান দিয়ে দুরকমের জর্দা দিয়ে একটা পান নিল। ভাত খাওয়ার পরে এই বিশেষ পানের মজাই আলাদা। পানের প্রথম রস টা ফেলে দিতে হয়। তারপর ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেতে হয়, ঠিক গরুর জাবর কাটার মত। পুরো শরীর জুড়ে একটা ঝিমঝিম ভাব আসে, দারুণ লাগে। হাত উলটে ঘড়ি দেখল খোরশেদ। সময় আছে। সে হাঁটতে লাগল। সামনের মোড় থেকে বাস ধরলে আধা ঘন্টায় থানায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল সে।

সুবিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। দারোয়ান টাইপের একটা লোক পকেট গেট থেকে উঁকি মারল। শালার গায়ের রঙ আফ্রিকান দের মত, তেলতেলা কালা। “তোমার স্যার আছেন কালু মিয়া?”

“আমার নাম বাহার! স্যার নাই। জরুরী কাজে ঢাকা গেছেন। “

বড় নেতাদের বাড়ীর কাজের লোকদেরও আলাদা ভাব থাকে। মানুষ জন পাত্তা দিতে চায়না। কানে গোজা ম্যাচের কাঠি দিয়া দাঁত খুচতেছে কালু। তার ভাব দেখে মনে হইতেছে , গ্রাম দিয়া কেউ সাহায্য চাইতে আসছে। খোরশেদ কাশি দিল। “তো বাহার মিয়া! ভাত খাইলা কি দিয়া?”

বাহার মিয়া বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল– “খোশগল্প করতে আসছেন? অখন যান। দুপুরে আমি একটু ভাত ঘুম দেই। রেজিস্ট্রি খাতায় নাম লিখা যান। স্যার আসলে কমু নে। ভাংতি টাকা আছে, ১০/২০ টাকা ? দিয়া যান, পান সিগারেট খামু আর কি !”

খোরশেদ হাসল— “না, খোশগল্প করতে আসি নাই। তোমার স্যারের ছেলে পড়শু রাতে একটা মেয়ের ইজ্জৎ নষ্ট করছে। একা না, বন্ধু বান্ধব নিয়া করছে। সে বিষয়ে কথা বলব। যাও ভিতরে গিয়া খবর দাও।”

বাহার মিয়ার মুখ টা এবার ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে গেল। মানুষ কে ভয় দেখিয়ে এক ধরনের আনন্দ আছে। পৈশাচিক আনন্দ। খোরশেদ আনন্দ পেল। লোকটা ভাল না, নীতিভ্রষ্ট হইছে। খারাপ মানুষেরে ভয় দেখিয়ে বেশী মজা। সে ধমক দিল– “দাড়ায়ে আছ ক্যান গাছের মত ? যাও! গিয়া বল থানার ওসি আসছে।”

বাহার মিয়া তোতলাতে শুরু করল। “স্যার, বাড়ীতে কেউ নাই। ম্যাডাম ছোট আপারে নিয়া তার ছোট বোনের বিয়েতে গেছে। আর ছোটসাব তো সকালে কক্সবাজার গেছে বন্ধুবান্ধব নিয়া।

খোরশেদ চিন্তা করল কতক্ষণ। তারপর হাঁটতে শুরু করল। মেইন রাস্তা পর্যন্ত আসতে আসতে মোটামুটি পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলল। গেম টা বড় মাপের। সময় নিয়া খেলতে হবে। এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা ঠিক না। জট পাকিয়ে যেতে পারে। হোটেলের বেলি ফুলের মত ভাত গুলোর কথা মনে পড়ল। ৩৩ টাকা দরের মোটা চালের ভাতের উপর ঘেন্না ধরে গেছে। হঠাৎ পেছনে গাড়ীর তীব্র হর্নের শব্দে চমকে উঠল সে….।

চলবে….

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

                                                     

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *