গহীনের শব্দ (২য় এবং শেষ পর্ব)

‘ বিয়ের আগে কখনও কি আপনার মেয়ে এই ধরনের আচরণ করেছিল ? ‘ ডাঃ হাবিব মিলির মা মিসেস সাহেদাকে জিজ্ঞেস করলেন ।

‘ নাহ্ ! এবারই প্রথম দেখলাম। ‘ উত্তর দিলেন মিসেস সাহেদা ।

‘ আচ্ছা বিয়ের পরে মিসেস মিলির কি কখনও এ্যাবরোশন হয়েছিল ? ‘

‘ নাহ্ ! এধরনের তো কোনকিছুই ঘটেনি ! তার দুটো সন্তানের জন্মের সময় কোন প্রকার সমস্যাই হয়নি । ‘

‘ বিয়ের আগে কি কোন কিছু ঘটেছিল তার জীবনে ? ‘

মিসেস সাহেদা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে
উঠলেন , ‘ আপনি আসলে ঠিক কি জানতে চাচ্ছেন বলেনতো ? ‘

ডাঃ হাবিব বেশ ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ,
‘ আমি আপনার মেয়ের অতীতের সকল ঘটনাই জানতে চাচ্ছি ! আশা করি আপনি আমাকে সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন ! আপনার মেয়েকে সারিয়ে তুলতে আপনার প্রতিটি তথ্যই আমার কাছে খুব মূল্যবান । আশা করছি আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি জানতে চাচ্ছি ! ‘

মিলির মা বললেন ‘ ঠিক আছে ! ‘

‘ বিয়ের আগে আপনার মেয়ের কি কারও সাথে এ্যাফেয়ার ছিল ? ‘

‘ জ্বী না ! ‘

‘ কোন ছেলের সাথে কি আপনার মেয়ের কোন ধরনের সম্পর্ক ছিল ? প্লিজ আমার কাছে কোনকিছুই গোপন করবেন না । এখানে আমি এবং আপনি ছাড়া আর কেউ নেই । আপনার মেয়ের জামাইও বাইরে অপেক্ষা করছে । আপনার ও আমার কোন কথা কেউ কোনদিন জানতে পারবেনা । ‘

‘ আমিতো আগেই আপনাকে বললাম যে , এধরনের কোনকিছুই তার জীবনে ঘটেনি । আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই খুব ঘরকুনো স্বভাবের ছিল । তাছাড়া তার বাবা খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ । বিয়ের আগে বাইরে কারও সাথে তার মেলামেশার প্রশ্নই আসে না । ‘

‘ একটা কথা আমি আপনার কাছে সরাসরি জানতে চাচ্ছি , বিয়ের আগে আপনার মেয়ে কখনও প্রেগন্যান্ট হয়েছিল কিনা ? ‘

মিসেস সাহেদা ভীষণ ভাবে চমকে উঠে
বললেন , ‘ কি ..কি বলছেন আপনি এসব ? কে আপনাকে এগুলো কথা বলেছে ? সব মিথ্যা কথা ! ‘

ডাঃ হাবিব মৃদু হেসে বললেন , ‘ আমি তো একবারের জন্যও বলিনি যে , এসব কথা কেউ আমাকে বলেছে ! আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছিলাম । অবশ্য এটা নাল বা নেগেটিভও হতে পারে ! আপনারা সবাই বলছেন যে , এর আগে মিসেস মিলি এধরনের আচরণ কোনদিনই করেননি । তাহলে প্রশ্ন আসে কেন হঠাৎ করে সেদিন থেকে তিনি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ? সেদিন তিনি টিভিতে যেসব অনুষ্ঠান দেখেছিলেন তা আমি পরে ইউ টিউবে দেখেছি ! সেই সিরিয়াল গুলোতে অস্বাভাবিক কোনকিছুই আমার নজরে পড়েনি। তবে সেদিনের প্রথম আলো পত্রিকা যা তিনি সেদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়েছিলেন , সেদিনের সেই পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ একটা নিউজ ছিল । নিউজটা এরকম যে , ঢাকার পরীবাগ এলাকার একটি ডাস্টবিনে মৃতপ্রায় এক নবজাতক শিশুকে কে বা কারা ফেলে গেছে ! খুব ভোরে ডাস্টবিন থেকে নবজাতক শিশুটির কান্নার আওয়াজ দূর থেকে শুনতে পেয়ে এক পথচারী বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয় । ঐ পথচারী দেখার আগে পর্যন্ত রাস্তার এক নেড়ি কুকুর সেই সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিচ্ছিল । এই যে দেখুন সেদিনের সেই পত্রিকার ছবিসহ রিপোর্ট । ‘ বলেই ডাঃ হাবিব টেবিল থেকে পত্রিকাটি মিসেস সাহেদার দিকে ঠেলে দিলেন ।

মিসেস সাহেদা ডাঃ হাবিবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন । ডাঃ হাবিব কোন কথা না বলে চুপচাপ একমনে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন । একটু পর ডাঃ হাবিব মিসেস শাহেদার দিকে টিস্যুর বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন ,
‘ আপনার স্বামীর ব্যবসা বাণিজ্য ও ইটের ভাটা সব আপনাদের দেশের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা কেন্দ্রিক । তাহলে পাশের থানা আলমডাঙ্গায় কেন তিনি বসবাস করেন আর কেনইবা সেখান থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেন ? আর কেনইবা তিনি তাঁর পরিবার পরিজনকে ঢাকায় এত দূরে রেখে নিজে একা একা এত কষ্ট করে জীবন যাপন করে আসছেন ? ‘

ডাঃ হাবিব একটু থেমে আবারও বলে উঠলেন ,
আপনার মেয়ের জীবন খুবই সংকটাপন্ন । তার জীবনের সব ঘটনা আমি আজ যদি জানতে না পারি তবে তাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। ‘

মিসেস সাহেদা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছে ডাঃ হাবিবের দিকে দুহাত জোড় করে আবারও কেঁদে উঠে বললেন ,
‘ ডাক্তার সাহেব , আমার মেয়েকে আপনি যেভাবেই হোক রক্ষা করেন । দেখবেন তার সংসারটা যেন ভেঙ্গে না যায় । আজ কতদিন ধরে সেই পাপ আমি ও তার বাবা আজও বুকে চেপে ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি ! ‘

‘ আপনি আমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন। রোগীকে সারিয়ে তোলাই আমার ধর্ম ! আর কারও সংসারের ব্যপারে আমার কোন আগ্রহই নেই । ‘

‘ আমরা একসময় চুয়াডাঙ্গায় সবাই একসাথেই বসবাস করতাম । মিলি যখন ক্লাস নাইন এ পড়ে তখন আমাদের স্থানীয় হাই স্কুলে মিজান নামে এক অল্প বয়সী যুবক ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে । মিলির বাবা সেই ছেলেকে লজিং মাস্টার হিসেবে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন । বিনিময়ে সে আমার দুই সন্তানকে পড়াতো । এই ভাবেই আমাদের দিনগুলো চলে যাচ্ছিল । কিন্তু একদিন মিলির চালচলন ও শারীরিক পরিবর্তন দেখে আমাদের সন্দেহ হয় । এক মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে ঢাকাতে মিলিকে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখাই । কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে । আমরা এ্যাবরোশন করাতে চেয়েছিলাম । কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় কোন ডাক্তারই আর রিস্ক নিতে চায়নি । তখন মিলির বাবা লোকলজ্জার ভয়ে তাড়াতাড়ি করে ঢাকাতে বাসা ভাড়া করে আমাদের পাঠিয়ে দেন । সেই সময়গুলো যে আমাদের কিভাবে কেটেছে তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারবোনা ডাক্তার সাহেব ! ‘

‘ আমি আপনার মনের অবস্থা ফিল করতে পারছি মিসেস সাহেদা । তারপর কি হলো বলুন ? ‘

‘ তারপর থেকে দুই ছেলেমেয়ে সহ আমি ঢাকাতেই বাস করতে লাগলাম । এদিকে মিলির ডেলিভারির সময়ও কাছে চলে আসলো । তখন তার বাবা ঢাকায় এসে আমাদের পরিচিত এক ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ঢাকার এক ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করান । যথাসময়ে মিলির ডেলিভারি হলো । ‘

‘ তারপর ! তারপর কি হলো মিসেস সাহেদা ? চুপ করে থাকবেন না । বাচ্চাটার কি হলো ? ‘

‘ বাচ্চার কথা আমি বলতে পারবোনা ডাক্তার সাহেব । তবে …. তবে শুনেছিলাম বাচ্চাটাকে মিলির বাবা ক্লিনিকের এক আয়াকে দিয়ে কোথায় যেন ফেলে দিয়ে আসার ব্যবস্থা
করেন ! ‘ বলেই মিসেস সাহেদা আবারও হুহ করে কেঁদে উঠেন ।

‘ বিশ্বাস করেন ডাক্তার সাহেব আমি সত্যিই তখন আমার মেয়েকে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলাম । বাচ্চাটার কথা সেই সময় আমার মাথায়ই আসেনি । পরে তার বাবাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম । কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি । আমি অনেক পরে বাচ্চাটার পরিণতির কথা জানতে পারি ! ‘

‘ আর সেই শিক্ষকের খবর কি ? সে এখন আছে কোথায় ? ‘

ঘটনাটা জানার পর সেই ছেলেকে মিলির বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন । তারপর সেই ছেলে স্কুল থেকে রিজাইন দিয়ে কোথায় যেন চলে যায় ! পরবর্তীতে আমরা কেউ আর তার কোন খোঁজ খবর জানিনা । ‘

ডা: হাবিব বলে উঠলেন , ‘ ঠিক আছে , আমার আর কিছু জানার দরকার নেই । আমি দ্রুত আপনার মেয়েকে সুস্থ করে তুলব । আপনি আগামীকাল মিসেস মিলিকে এখানে পাঠিয়ে দিবেন । আর আজকে থেকে তার প্রতি সজাগ থাকবেন । সে যেন কখনও একা না থাকে আর সুন্দর একটা হাসিখুশি পরিবেশের মধ্যে সবসময়ই যেন থাকে । ঠিক আছে আপনি এখন আসুন । ‘

আজও গভীর রাতে তীব্র কান্নার শব্দে মিলির ঘুম ভেঙ্গে গেল । প্রথমে ঘুমের ঘোরে মনে হলো নিজের বাচ্চা বুঝি ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদছে ! একথা ভেবেই ঘুমের ঘোরে পাশে হাত বাড়িয়ে বাচ্চাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে আনার চেষ্টা করে কাছে না আনতে পেরে মিলি টের পেল গভীর ঘুমের ঘোরে আসলে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শাহেদকে বৃথাই কাছে টানছিল । আবারও তীব্র কান্নার শব্দের সাথে মাও … মাও বলে কে যেন খুব করুন শব্দে তাকে একমনে ডেকে চলার আওয়াজ হতেই মিলি ভীষণ অস্থিরতা বোধ করতে লাগলো । বিড়বিড় করে বলে উঠল ‘ ‘ আমি আসছি রে মা । ‘ বলেই কি এক ঘোরে আবিষ্ট হয়ে আজও সে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো । মেইন গেটের কাছে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো মিলি । বুঝতে পারছেনা কোন দিক থেকে শব্দটা ভেসে আসছে । আবারও কান্নার আওয়াজ পেতেই কালবিলম্ব না করে সে মেইন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দক্ষিণ বনশ্রীর নির্জন রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে বালু নদীর দিকে দ্রুতবেগে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলো ।

আজকের সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় একটা সংবাদ টক অব দা টাউন হিসেবে ভীষণ ভাবে সকলের কাছে আলোড়ন সৃষ্টি করলো । সংবাদটা নিম্নরূপ :

” আজ সকালবেলায় ঢাকা শহরের দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার অধিবাসী জনাব শাহেদ আহম্মেদের স্ত্রী লায়লা আফরোজ মিলির মৃতদেহ পাশের বালু নদীতে ভাসমান অবস্থায় স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করে । তার বাড়ির সদস্যরা জানায় , মিলি গত কয়েকদিন ধরে মানষিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিল । তার মানসিক চিকিৎসাও চলছিল। সেদিন গভীর রাতে বাড়ির সকল সদস্য ঘুমিয়ে থাকার সময় কোন এক মুহূর্তে মিলি একা একা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । সেদিন রাতে ঐ বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জনাব ফখরুদ্দিন সাহেব রাতের ফ্লাইটে বিদেশে যাবেন বলে দারোয়ান মেইন গেট খুলে রেখেছিল । মিসেস মিলির মৃত্যুর সংবাদ তার বাবা মা পাওয়া মাত্রই সেখানে এসে উপস্থিত হন । ঘটনার এক পর্যায়ে মেয়ের লাশ দেখে তার বাবা চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা নিবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব আজমল সাহেব মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে একপর্যায়ে স্বীকার করেন যে , তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী । ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের চিত্র । ‘

মিসেস মিলি ছোটবেলা থেকেই তার বাবামায়ের সাথে চুয়াডাঙ্গা শহরে বসবাস করতেন । তিনি যখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী ছিলেন তখন তাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার মিজানের সাথে বাড়ির সকলের অজান্তে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন । প্রেমের এক পর্যায়ে মিলি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েন । উপায়ন্তর না দেখে মিলির বাবা লোকলজ্জার ভয়ে তার দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে ঢাকাতে বাসা ভাড়া করে অদ্যবধি সেখানেই রাখেন । এদিকে ঢাকার এক স্থানীয় ক্লিনিকে মিলি একটি সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু আজমল সাহেব এক আয়া দ্বারা সেই সদ্যজাত শিশুকে ডাস্টবিনে ফেলে দেন । এদিকে আজমল সাহেব সেই লজিং মাস্টার মিজানকে বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং মিজানকে চুয়াডাঙ্গা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিও দেন । একপর্যায়ে মিজান স্কুল থেকে রিজাইন দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মেয়ের ভবিষ্যৎতের কথা চিন্তা করে মিজানের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্য রাতের অন্ধকারে সকলের অজ্ঞাতে মিজানকে তুলে নিয়ে এসে আজমল সাহেব তার নিজস্ব জ্বলন্ত ইটের ভাটায় সোজা নিক্ষেপ করেন । পরবর্তীতে তিনি চুয়াডাঙ্গা শহর ত্যাগ করে পাশের আলমডাঙ্গা থানায় অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে অদ্যবধি নিজ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন । তার স্বীকারোক্তির পর রামপুরা থানার পুলিশ তাকে আটক করে । বর্তমানে তিনি রামপুরা থানায় পুলিশের হেফাজতেই আছেন ॥ ”

( সমাপ্ত )

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *