গোধূলীবেলায় ( ১০ম পর্ব )

” রেবুর বিয়ের বাজার করা কি হয়ে গেছে? ”
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রশীদ সাহেব। ” হ্যাঁ মোটামুটি সবই হয়েছে। গয়না গুলো করতে দিয়েছি। কিছু টাকা আগেই জমা দেয়া আছে। বাকি টাকা গয়না তোলার সময় দিলেই চলবে।”

” আহ ! সে কথাতো আমিও জানি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম বিয়ের বাজার করা হইছে কি না সেটা কও।” ” হ্যাঁ মোটামুটি সবই হইছে। কিছু বাকি আছে। এই যেমন ধরো জামাইয়ের পোশাক আসাক কেনা বাকি আছে। ও ভালো কথা, গায়ে হলুদের ও বিয়ের খাওন দাওনের বন্দোবস্ত কি করবে তা কি কিছু ভেবে দেখেছো? আত্মীয়স্বজন কাকে কাকে দাওয়াত দিবা সেটা ঠিক করতে হবে না? রশীদ সাহেব পান চিবুতে চিবুতে এক মুহূর্ত কিছু চিন্তা করে উত্তর দিলো, ” হ্যাঁ সেগুলো তো কিছু ভেবেই রেখেছি। অনেকদিন দেয়াল গুলোতে রঙ করা হয় নাই। ভাবছি এই সুযোগে গোটা বাড়িঘর চুন দিয়ে রঙ করে ফেলবো। তাতে ঘরদোরও কিছুটা চকচক করবে, তুমি কি বলো? ”

” করলে তো ভালোই হয়। কিন্তু গোটা বাড়িঘর রঙ করতে তো অনেক টাকার ব্যাপার। ”

” তোমাকে এই সব নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। মেয়ের বিয়েটা যেনো ভালভাবে হয় সেটাই খেয়াল রেখো। আর একটা কাজ করো, আমি কিছু টাকা পয়সা তোমাকে কাল সকালে দিয়ে যাবো, ওই টাকা দিয়ে তুমি জামাইয়ের জন্য জিনিসপত্র সব কিনে ফেলবে। আর এর সাথে সাথে রিমি ও খোকার জন্য সুন্দর দেখে দুইটা করে ড্রেস কিনে ফেলবে। ওদের কোন ভালো পোশাক নেই। বিয়ের দিন ওই নতুন জামা কাপড় গুলো তারা পড়বে। তুমিও নিজের জন্য ভালো দেখে একটা শাড়ি কিনে নিও, বুঝছো। ” ”আমার কিছু লাগবে না,যা আছে তাই পরলেই চলবে।” রশীদ সাহেব খানিকটা বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন,
” আহ, এতো বেশি কথা বলো নাতো! যা বলছি তাই করো। ”
কথাটা বলেই তিনি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।

সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে রশীদ সাহেব কাঠের আলমারি খুলে টাকার বাণ্ডিল খুলে পাঁচশ টাকার একটা বাণ্ডিল বের করে স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, ” এই নাও টাকাগুলো রাখো। এটা দিয়ে যা বাজার করতে বাকি আছে তা সেরে ফেলো। ভালো দেখে জামা কাপড় কিনো। আবার কিপটেমি করো না যেনো। ” আলমারির তাকে টাকার একগাদা বাণ্ডিল দেখে আয়েশা বেগম বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্বামীর হাত থেকে টাকা নিতে নিতে বললেন, ” আচ্ছা সত্যি করে বলোতো এতো গুলো টাকা তুমি কোথা থেকে পেলে? আমার কিন্তু বড় ভয় করছে। তুমি না আবার বড় কোন বিপদে জড়িয়ে পড়ো! আমি গরীবের বৌ, গরীবই থাকতে চাই। আমি চাই না মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে বাকি ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন বিপদে পড়ি। ”
স্ত্রীর কথা শুনে রশীদ সাহেব রাগে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আলমারির পাল্লাটা লাগিয়ে দিয়ে গট গট করে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অফিসে দুপুরের পর ম্যানেজার দ্বীন মোহাম্মদ রশীদ সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। রশীদ সাহেব ম্যানেজারের রুমে প্রবেশ করে সালাম জানাতেই ম্যানেজার একটু বিরক্ত প্রকাশ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ” রশীদ সাহেব আপনার হিসাব পত্র গুলো দিতে আর কয়দিন লাগবে? চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। আপনি এখনও আমাকে গতমাসের ক্লোজিং রিপোর্টটা রেডি করে দিতে পারলেন না। কই কখনও তো আপনার হিসাব পত্র দিতে দেরী হয় না। আজ হঠাৎ কেনো এইরকম হচ্ছে? আমি ব্যালান্স টানতে পারছি না, স্যারকেও রিপোর্ট দিতে পারছি না। কি ব্যাপার কথা বলছেন না কেনো? উত্তর দেন। ” রশীদ সাহেব কিছুটা কাচু মাচু করে উত্তর দিলো,
” মেয়ের বিয়ে নিয়ে কয়েকদিন ধরে খুব দৌঁড়ের উপর আছি স্যার। তাই টেনশনের কারনে ঠিকমতো করা হয়ে উঠেনি। আর কয়েকটা দিন সময় দেন স্যার। আমি সব রেডি করে দিচ্ছি। ”

” আপনার সমস্যা থাকলে শওকত সাহেবকে দিয়ে দেন। সে নাহয় কমপ্লিট করে জমা দিবে। ”

” তার দরকার পরবে না স্যার। আমিই কাল পরশুর মধ্যে করে ফেলবো। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি তাহলে দ্রুত কাজটা সেরে ফেলুন। আর হ্যাঁ, আমি ঘন্টা খানেকের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। আপনি তাহলে সবকিছু একটু দেখে রাখবেন। আর কিছুক্ষণ পর ব্যাংকে গিয়ে টাকাগুলো জমা দিয়ে আসবেন। আপনি টাকাগুলো জমা দিলে স্যার ব্যাংক ডিপোজিটের মেসেজটা পেলে একটু ঠান্ডা হবেন। তাহলে আপনি ব্যালান্সশীট দুইদিন পর জমা দিলেও স্যার অতোটা রাগ করবেন না। ”
রশীদ সাহেব ঘাড়টা একদিকে কাত করে ম্যানেজারকে সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আধঘণ্টা পর ম্যানেজার অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পনেরো বিশ মিনিট পর রশীদ সাহেব চেয়ার থেকে উঠে ম্যানেজারের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

রেবেকা রান্নাঘরে প্রবেশ করে মাকে মনমরা হয়ে রান্না করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, ” কি হয়েছে মা? মন খারাপ করে বসে আছো কেন? বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি? ”

আয়েশা বেগম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুলায় খড়ি ঠেলতে ঠেলতে উত্তর দিলো, ” এই বুড়ো বয়সে তোর বাপের সাথে ঝগড়া করতে যাবো কোন দুঃখে! আমি ভাবছি অন্য কথা। ”

” কি কথা মা? ”

” ভাবছি তোর বাবার হঠাৎ করে কি হলো? কোন কিছু বাছবিচার না করেই যা মন চায় তাই করে বেড়াচ্ছে। ”’ বাবা আবার কি করতে গেলো? বাবাতো সেই সকালবেলা ভাত খেয়ে অফিসে যায়। সন্ধার পর অফিস থেকে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। এর মধ্যে খারাপটা কি দেখলে তুমি? ”

” আজকাল তোর বাবার খরচের বাহার দেখেছিস! যেটা মন চায় সেটাই কিনে ফেলছে। সেদিন বলছিলো ফ্রিজ কিনবে। আবার বলতে শুনলাম, ঘরের পুরোনো টিভিটা নাকি বিক্রি করে দিয়ে বড় দেখে রঙিন একটা টিভি কিনবে।
আজ সকালে কি হয়েছে শোন, বিয়ের বাজার করার জন্য আলমারি থেকে টাকা বের করার সময় অনেক গুলো টাকার বাণ্ডিল দেখতে পেলাম। সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল বের করে আমার হাতে দিলো। অতগুলো টাকা দেখার পর থেকেই আমার মাথাটা কেমন যেনো ঝিমঝিম করছে। বলতো রেবু তোর বাবাকে এতগুলো টাকা কে দিলো? কোথা থেকেই বা জোগাড় করলো? জিজ্ঞেস করলেই দেখি আমার উপর চেতে যায়। তুই তো পড়ালেখা করা মানুষ। আমিতো মুখ্য শুখ্য মানুষ অতো কিছু বুঝি না। আচ্ছা তুই বলতো এতগুলো টাকা অফিস থেকে কি যেনো ফান্ড বলে সেখান থেকে কি ধার পাওয়া যায়? কি জানি বাপু, আমার কিন্তু কোন কিছুই ভালো লাগছে না। ভয়ে হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে আসছে। ”

রেবেকা মায়ের কথাগুলো চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে গিয়ে উদাস মনে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।

(চলবে)

-ফিরোজ চৌধুরী


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *