ছায়াসঙ্গী

বিরামহীন এই বৃষ্টিময় সকালে ভাগ্যক্রমে একটা রিক্সা পেয়ে গেলাম। সাধারণত আমি রিক্সায় অফিসে যাতায়াত করি না। কিন্তু আজ এই দুর্যোগমুখর দিনে রিক্সাই ভরসা। গ্রিন রোড ধরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর মাঝারি ধরণের বাতাসের দাপট সহ্য করে করে রিক্সাটা চলছিল। হঠাৎ এক মেয়ে রিক্সার সামনে এসে পড়লে রিক্সাটা খুব জোরে ব্রেক কষে থামল। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মেয়েটি বলল প্লিজ আমাকে একটু সামনে নামিয়ে দিয়েন। খুব জরুরী। কিছু পাচ্ছি না।

আমাকে হ্যাঁ না কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটি টুপ করে রিক্সায় ওঠে বসল। হুডতোলা রিক্সায় উঠতে গিয়ে মাথায় একটু আঘাত পেল। এরকম অনুমতি ছাড়া কারো রিক্সা সঙ্গী হওয়া অন্যায় – এজাতীয় প্রতিবাদ না করে আমি তাকে দরদমাখা কণ্ঠে বললাম লাগেনি তো?

রিক্সায় পাশাপাশি বসাটা এতো ঘনিষ্ট হয় যে ভদ্রতার সাথে একে অপরের চেহারা দেখা যায় না। রিক্সায় ওঠার আগে যতটুকু দেখেছি কালো শাড়িতে ছিপছিপে গড়ন।

বললাম কোথায় যাবেন?

কোনো উত্তর নেই। জব করেন?

এবারো কোনো উত্তর নেই।

আমি অস্বস্তিতে পড়লাম। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টি ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পড়ছে। আমার শরীরের সাথে তার শীতল শরীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেগে আছে। বকুল ফুলের একটা তীব্র ঘ্রাণ নাকে লাগছে। তার এই নির্বাক আচরণে মনে হচ্ছে যেনো দাম্পত্য কলহ শেষে স্ত্রীকে নিয়ে বৃষ্টি ভেজা শহরের রাস্তায় দিগবিদিগ এক অসহায় বউ পাগলা স্বামী।

আমি খুব সাহস নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করলাম। আধাভেজা চুলে তার মুখ ঢাকা। তীক্ষ্ণ নাকের আড়ালে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। কালো শাড়িতে সাদা-হলুদ ফুলের আঁকিবুঁকির উপর ফর্সা সরু হাতের আঙ্গুলগুলো আলুলায়িত।

খুব অস্থিরতার সাথে বললাম আপনার নামটা জানতে পারি?

এবারো নীরবতা।

আমি এক তরুণ তপস্বী। সবসময়ে নারীদের সম্মান করি। ঝুটঝামেলা এড়ানোর জন্য প্রায় সময়ই মেয়েদের এড়িয়ে চলি। যে কারণে আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। ইউনিভার্সিটিতেও তেমন কেউ ছিল না। বন্ধুরা বলতো তোর মতো সুদর্শন হলে মাসে এক ডজন প্রেম করতাম। সেই পরোপকারী সুদর্শন এক যুবককে এড়িয়ে চলছে, অবজ্ঞা করছে এই মেয়ে? আমার অহংবোধে কী যেনো চেপে বসলো।

আমি বেশ সশব্দে বললাম আপনি কি আমার কথা শুনছেন? কথা বলছেন না কেনো?

এতো দেমাগ যখন আরেকজনের রিক্সায় উঠেছেন কেনো? এএইই শুনছেন??

নামেন রিক্সা থেকে! এক্ষণি নামেন!!

রিক্সাটা জোরে ব্রেক করে থেমে গেলো। রিক্সাওয়ালা বলল থামতে কন ক্যান? আপনি না কাঁটাবন যাইবেন? আর অনেকক্ষণ থেইকা হুন্তাছি আপনি কার লগে কথা কন?

কাকভেজা আমি রিক্সায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম একা। তাইতো কার সাথে কথা বলছি!!

রিক্সা আবার চলতে শুরু করলে বাতাসে বকুল ফুলের ঘ্রাণ আবার তীব্র হলো!

-জামান একুশে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *