কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে জ্বর এসে হাজির। যেন তেন জ্বর না, এক লাফে একশ ছয়। রাতে একটার দিকে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক হঠাৎ করে বলা যায় না। ঘুম ভেঙে গেল ঠান্ডায়। হঠাৎ করে মনে হলো আমি এন্টার্কটিকা মহাদেশে এসে পড়ে গেছি। তাছাড়া এত ঠান্ডা লাগার কারণটা কি।
কোন রকমে চোখ খুলে নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখি মাথা গরমে পুড়ে যাচ্ছে। তার মানে আমি এন্টার্কটিকা মহাদেশে না। আমার ঘরেই আছি। জ্বরটা ভাল মতই এসেছে। আসুক। জ্বর আসাই দরকার। এমন লোকের শুধু জ্বর কেন কঠিন কঠিন সব রোগ একবারে ধরলেও ক্ষতি নেই। সহজে মরার একটা তরিকা তো বের হত। অসুখ বিসুখে না মরলে আমার মরার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। আত্মহত্যা করার মত এত বড় কলিজা আমার নাই। আমার কলিজা হলো পুঁটি মাছের কলিজা।
বেশ কিছুদিন হলো ফারহানা আমার সাথে ঘুমায় না। ও ঘুমায় পাশের ঘরে। কথায় কথায় আমি মরলে তার যে কি কি উপকার হয় তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ বুঝিয়ে দেয়। আমিও বুঝে শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে বলি- ঠিকই বলেছ। মরাই দরকার। কিন্তু মরবটা কিভাবে?
বিছানা থেকে কোন রকমে নেমে থার্মোমিটারটা খুঁজে বের করে মুখে পুড়ে দিলাম। মিনিট খানিক পর বের করে দেখি- এ্যাই সেড়েছে। ফারহানার প্রতি ঈশ্বর বোধহয় মুখ তুলে চেয়েছেন। নইলে এমন রাত বিরাতে হঠাত করে একশ চার জ্বর আমার আসবে কেন। এ জ্বর মরার জ্বরই।
তাছাড়া সারা জীবন জ্বর আসার আগে আমাকে অন্তত একটা সিগনাল দিয়ে আসে। হয় গলার ভেতর খসখস করে, নয়ত ঘনঘন পানি পিপাসা লাগে। আমি বুঝতে পারি, জ্বর বাবাজী আসছেন। সেই মোতাবেগ রেডি হয়ে যাই। এইবার আমাকে জ্বর বাবাজী সেই টাইম দেন নাই। সম্ভবত সে এইবার ফারহানার পক্ষ নিয়েছে। আমাকে একটু টাইট দেওয়ার জন্য।
শক্তি যেটুকু ছিল গায়ে, জ্বর মাপার পর সেটুকুও একলাফে নাই হয়ে গেল। একশ ছয় জ্বর। আমি এখন করবোটা কি? মাথায় একটু জলটল দিতে পারলে বোধহয় হতো। সেই সুযোগ নাই। নিজের মাথায় নিজে নিজে তো আর জলপট্টি দেওয়া যায় না। দেওয়ার শক্তিও আমার নাই। ফারহানা থাকলে ভাল হতো। কিন্তু সে তো পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে।
ওকে ডাকার কথা যে মনে হলো না এক দুই বার, তা না। জিদ করে ডাক দিলাম না। তাকে ডেকে কি হবে? তার চেয়ে এইভাবে চুপচাপ পড়ে থাকি। রাতে রাতে জ্বর আরো বাড়ুক। সকাল বেলা ফারহানা আমার মরে ভূত হয়ে যাওয়া শক্ত দেহটা দেখুক। সে তো চায়ই আমি মরে ভূত হয়ে যাই। তাকে ডাকা যাবে না।
অথচ আমার গোঙাতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বেশি হলে গোঙাতে ভাল লাগে। আহা আহা উহু উহু, ওরে বাবা রে মরে গেলাম রে, ওরে মা, ওরে বাবা, ওরে আল্লাহ করতে ভাল লাগে। কিন্তু আমি ঠিক করেছি টু শব্দটি করব না। ফারহানা আমার হাঁকাহাঁকিতে জেগে যাক সেটা আমি চাই না।
হঠাৎ পাশের ঘরে আলোটা জ্বলে উঠল। খুট করে একটা আওয়াজও হলো। এত রাতে ফারহানা লাইট জ্বেলে কি করে? সে কি, মনে হচ্ছে সে তো এই ঘরের দিকেই আসছে। আমার ঘরে এত রাতে আসছে কেন সে?
আমি যথা সম্ভব শব্দ না করে স্বাভাবিক ভাবে ঘুমিয়ে আছি এমন ভান করে পড়ে রইলাম। অবশ্যই চোখ বন্ধ করে আছি। পারলে শ্বাসটাও বন্ধ করে রাখতাম। সেই সুযোগ নাই। কাজেই চোখ বন্ধ করে যতটুকু পারা যায় সামলিয়ে রাখা অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে আছি।
সে কি ফারহানা আমার বিছানার পাশে বসলো বলে মনে হয়। হুম,তাইতো। আমার কোমর ঘেঁষে বসেছে। ওর কোমরের ঠেস লেগে আছে আমার বাম পাঁজরে। আমি বুঝে পাই না, ফারহানার গা হাত পা এত নরম কেন। ধূর কি যাতা ভাবছি। জ্বরের ঘরে পড়েও আমি মানুষ হলাম না।
হঠাৎ আমার মনে হলো জ্বর এক লাফে অন্তত কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। কারণটা কি? কারণটা হলো আর কিছুই না। খুবই সাধারণ একটা কারণ। হঠাৎ কপালের ওপর পাঁচ আঙ্গুলের একটা হাত আলতো করে চেপে বসল। হাতটা কপালে চেপে বসেই ক্ষ্যান্ত হলো না। আমার গাল মুখ গলা ভ্রমন করে ফেলল। টুপ করে কি যেন এক ফোটা পড়ল আমার ডান গালের ওপর। জায়গাটা হঠাৎ শীতল হয়ে গেল। মনে হলো গালের জ্বর এখন নেমে গেছে। গাল ব্যাটা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনন্দে নাচছে।
কিন্তু সে কি, ফারহানা কাঁদবে কেন? আমার জ্বর হলে তার কাঁদার তো কোন কারণ দেখি না। সে তো রোজই কয়েকবার করে বলে আমি মরি না কেন। তাছাড়া এই রাত দুপুরে আমি এঘরে জ্বরে মানুষে পাঞ্জাপাঞ্জী লড়ছি সে খবর ফারহানাকে কে দিল? আমি তো কোন আওয়াজ করি নি। ফারহানা কাঁদছেই বা কেন?
হঠাৎ আমারও গলা ভেঙে কান্না আসতে লাগল। আমি কোন রকমে সেটা আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ফারহানা আমার কপালে গালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। সে সম্ভবত বুঝতে পারে নি আমি জেগে আছি। বন্ধ চোখের কোনা দুইটায় আমি না চাইলেও দুই বিন্দু জল জমে গেল। চোখের বন্ধ পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বের হওয়ার পথ খুঁজছে।
আমি আস্তে করে হাতটা তুলে ফারহানার হাতের ওপর রাখলাম। ফারহানা শক খাওয়ার মত কেঁপে উঠে হাত সড়িয়ে নিল। আমি আবার তার হাতটা চেপে ধরে বললাম- কিছু কি বুঝতে পেরেছো? মরে যাচ্ছি।
ফারহানা বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল- এত ঢং কেন তোমার? আমাকে ডাকলে কি হতো? ঘুমের ঘরে একলা মরে পড়ে থাকার খুব শখ? জ্বরে মাথায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ একটা লোক অদ্ভুত ভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
ফারহানা বালতি ভর্তি করে পানি নিয়ে বসল মাথার কাছে। পানিতে রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে আমার কপালে। আর খানিক পর পর নাক টেনে টেনে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছে। আমি ওর দিকে তাকাচ্ছি না। চোখ বন্ধ করেই আছি। জ্বর এখন বেশি না কম বোঝা যাচ্ছে না। তবে হঠাৎ খুব আহা উহু ওরে বাবারে ওরে মারে করতে ইচ্ছে করছে। আমি শুরু করে দিলাম। আহা উহু ওরে বাবারে ওরে মারে…আহা। কি শান্তি।
ফারহানা রাগ্বত স্বরে বলল- এত ষাঁঢ়ের মত চিৎকার করছো কেন?
-আরামে। আরামে চিৎকার করছি।
-আরামে কেউ চিৎকার করে? চুপ কর।
-আমি করি। চুপ করতে পারব না। যতক্ষণ ইচ্ছা আহা উহু করব। তোমার তাতে কি?
-আমার আর কি। আমার কিছু না। আমার কিছু না।
আমি ফারহানার হাতটা তৃতীয়বারের মত চেপে ধরে বললাম- কাল থেকেও কি ওঘরে শোবে তুমি?
-কেন শোব না, একশ বার শোব। তোমার সাথে আমি আর নাই।
এক ঝটকায় আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার জলপট্টি দিতে লাগল সে। টুপটুপ করে পানি পড়ছে তার চোখ বেয়ে। সেই পানির নামই কি ভালবাসা? সেটা যদি ভালবাসা হয় তবে এই রাত দুপুরের জলপট্টির কি নাম? আর কোন রকম ডাকাডাকি ছাড়া হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে এঘরে আসার নাম কি? আমার প্রচন্ড জ্বর এই খবর তাকে কে দিল ঘুমের ঘোরে? এইটার নামও কি তবে ভালবাসা?
হঠাৎ ফারহানা বলে বসল- শোন, এইবার জ্বর সাড়লে আমরা কাঁঠালতলী যাব। ওই বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয় না। এবার গিয়ে সপ্তাহখানেক থেকে আসবো। সিদ্ধ চাল ভাজা আর পেয়াজ মরিচ এক সাথে বেটে জাম্বুরা পাতা দিয়ে খাব বারান্দায় বসে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ না তোমার পছন্দ? বর্ষা কিন্তু আসছে।
ফারহানার কথা শুনে আমি ধরফর কর উঠে বসলাম। বললাম- চল। জ্বর আমার সেরে গেছে।
ফারহানা চোখ গরম গরম করে বলল- ফাইজলামির আর জায়গা পাও না? শুয়ে পড়। দেখি তো জ্বর এখন কত।
ফারহানা থার্মোমিটার বের করে আমার মুখের মধ্যে পুড়ে দিল। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি মেয়েটার মুখের দিকে। কি শান্ত স্নীগ্ধ চেহারা। সে চেহারায় থার্মোমিটারে জ্বর কত উঠে সেই চিন্তা স্পষ্ট।
আমি চেয়ে আছি। ওর চোখ নাক মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। সে আমার জ্বর মেপে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার আহা উহু করতে ইচ্ছে হলো আবার। আহা উহু শুরু করলাম। ফারহানা চোখ পাকিয়ে বলল- উফ, এমন বাচ্চাদের মত কর না তো। জ্বর এখন কমে গেছে। একশ দুই। আমি আরো জোড়ে আহা উহু করতে লাগলাম।
ফারহানা তার মাথাটা আমার বুকের ওপর রেখে মুখের কাছে মুখ এগিয়ে বলল-চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি আছি তো তোমার পাশে।
আমার মনে হলো এমন জ্বরের রাত থাক না বছরের পর বছর।
-রবিউল করিম মৃদুল