ধূসর বসন্ত (১ম পর্ব)

কোনো এক ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে আমাদের বিয়ে হয়।

বিয়েটা আমার হওয়ার কথা ছিল মারুফের সঙ্গে। কিন্তু আমার বিয়ে হলো মারুফের বন্ধু আবীরের সঙ্গে। আবীর কী আমার বন্ধু ছিল না? ছিল—প্রেমিকের বন্ধু তো বন্ধুর মতই। আবীরের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ছিল অন্য রকম। ওর পরিমিত রুচি আমার ভালো লাগত—এটুকুই।

ভালোবাসতাম আমি মারুফকে—পাগলের মত। মারুফ আর আমি, দুজন ছিলাম আত্মার বন্ধনে বাঁধা।

চার বছরের বোঝাপড়ার সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—বিয়ে করব। সব কিছু ঠিকই ছিল—কিন্তু এর মধ্যে কিভাবে কী হয়ে গেল। অন্তরঙ্গতার কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তের খেসারত দিচ্ছি এখন আমি। আমার ভালোবাসার মানুষটি তার ভালোবাসার বীজ আমার শরীরে বপন করে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে।

কেন নিরুদ্দেশ হলো সেই ঘটনাটা বলি।

একদিন মারুফের সঙ্গে দেখা করে আমি বললাম, ‘আই মিসড মাই পিরিয়ড। আই থিঙ্ক আই’ম প্রেগন্যান্ট।’

‘ইউ হোয়াট? হাউ?’

যেন আকাশ থেকে পড়ল মারুফ। এমন কিছু হতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে।

‘মনে হয়ে কিছু বুঝতে পারছ না? তোমাকে তখনই বলেছিলাম—তুমি কথা শোনো নি। বলেছিলে কিচ্ছু হবে না—এখন?’

মারুফ চুপ করে রইল।

‘লেট’স গেট ম্যারিড। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া আগে হোক পরে হোক বিয়ে তো আমরা করতামই—সেটা না হয় একটু আগেই করলাম।’

‘আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়।’

‘কেন নয়? এতোদিন তো বলে এসেছিলে—তুমি যে কোনো সময়ে আমাকে বিয়ে করার জন্যে রেডি।’

মারুফ এবারো চুপ করে রইল।

‘তাহলে, এখন আমি কী করব?’

‘এবরশন করে ফেল।’

‘অসম্ভব।’ আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, ‘আমি এবরশন করব না।’

‘আই’ম সরি। আই’ম নট গোয়িং টু টেক দিস রেসপন্সিবিলিটি।’

‘রেসপন্সিবিলিটি তুমি একা নেবে কেন? ভুল আমরা দুজনেই করেছি। যা করার আমাদের দুজনের একসাথেই করতে হবে।’

মারুফ নিশ্চুপ।

‘কিছু একটা বলো মারুফ—এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না।’

একটু সময় নিয়ে মারুফ বলল, ‘আমাকে একদিন ভাবতে দাও।’

‘ওকে—ভাবতে দিলাম। ভেবে আমাকে জানাও।’

সেদিনের পর থেকে মারুফের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হলো না আমার। হলো না ঠিক না—চেষ্টা করেও তার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারলাম না। কাপুরুষেরা যা করে তাই করল সে—একেবারে গভীর গর্তে ঢুকে পড়ল।

জীবনটা হঠাৎ করেই যেন থেমে গেল আমার। চারিদিকে শুধু অন্ধকার। একটুও আলো নেই কোথাও। কী করব এখন আমি?
অন্ধের মত বিশ্বাস করেছিলাম মারুফকে আমি। আর সেই মারুফ আমার সঙ্গে এমন করতে পারে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। আমার স্বপ্নগুলোকে এক মুহূর্তে, ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেছে সে। আমি মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙে পড়লাম যে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা রইল না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—আত্মহত্যা করব।

আর ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল আবীর।

আবীর আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, সে যেভাবেই পারে মারুফকে খুঁজে এনে আমার সামনে হাজির করবে। কিন্তু এক দিন দুই দিন করে সপ্তাহ পেরুল। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস গড়াল, আবীর মারুফের কোনো খোঁজ বের করতে পারল না। ইতিমধ্যেই সে কয়েকবার চেষ্টা করেছে—প্ল্যানড প্যারেন্টহুডে আমাকে নিয়ে যেতে—এবরশন করানোর জন্যে। আমি রাজী হইনি। অপেক্ষা করেছি—মারুফের ফিরে আসার আশায়।

সে আশার গুড়ে যখন বালি পড়ল, তখন আবীর আমাকে বলল, ‘এখন কী করবে?’

‘আর যাই করি, বাচ্চা এবোর্ট করব না। ইট’স ফাইনাল।’

‘আমাদের কমিউনিটির মানুষ জনের কথা ভেবেছ একবার? কী বলবে সবাই?’

‘জীবনটা আমার—আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। যদি ভাবতেই হয় তাহলে আমার ফ্যামিলির কথা ভাববো—কে কী ভাবল, কে কী বলবে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

আবীর আর কিছু বলল না।

এদিকে দিনে দিনে আমার শারিরিক এবং মানসিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকল। এর মধ্যে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিল এবং আমাকে হসপিটালেও থাকতে হলো কয়েকদিন।

আবীর আমাকে সকাল-বিকাল দেখতে গেল। যেদিন রিলিজ নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম—একটা গোলাপ ফুলের তোড়া, বড় এক প্যাকেট চকলেট আর একটা টেডি বিয়ার নিয়ে এসে হাজির হলো আবীর। সাথে হরেক রকমের খাবার।

একথা-সেকথার পর হঠাৎ করে আবীর গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর বলল, ‘মীরা, আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। আমার কথাগুলি তুমি শুনবে?’

‘শুনব—শুধু কোনো এডভাইস দিতে পারবে না। আমার কী করা উচিৎ কী উচিৎ নয় সেটা আমি জানি। ভুল আমি করেছি, শাস্তি যা পাওয়ার আমি পাব। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।’

আবীর চুপ করে রইল।

হঠাৎ করেই আমি কেঁদে ফেললাম। কান্না চলল অঝোর ধারায়।

আবীর আমার সামনে এসে বসল। আমার হাতটা টেনে নিল হাতে। তারপর বলল, ‘উইল ইউ ম্যারি মি?’ বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আবীরের কণ্ঠে কী ছিল জানিনা—আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি তাকে। আমি চোখ মুছে বললাম, ‘কেন?’

‘যদি তুমি ভাবো—তোমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি তাহলে ভুল হবে।’

‘তাহলে কী?’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মীরা।’

‘তাই নাকি?’ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভ্রূ কুঁচকে বললাম, ‘তা তোমার আবার কী প্লান? একজন তো পেট বাঁধিয়ে চলে গেল—তুমি কী করবে?’

‘ছিঃ এভাবে কথা বলছ কেন?’

‘কীভাবে বলব? এই শরীরটাই তো দরকার তাই না? তোমাদের ভালোবাসা মানেই তো শরীর। একজনকে যতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম, ততদিন আহা কত মধুর মধুর কথা। মধু খাওয়া শেষ—এখন তিনি নিরুদ্দেশ।’

আবীর আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল আমার দিকে।

রাগে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছি আমি। মারুফের ওপর আমার যত ক্ষোভ যেন ঝারছি আবীরের ওপর। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘এসো।’

‘মানে?’ কিছু বুঝতে না পেরে আবীর তাকাল আমার দিকে।

‘এসো—ভোগ কর আমাকে। এখন লজ্জা পাচ্ছ কেন? এসো—’ আমার কী হলো জানিনা। আমি নিজেই আবীরের হাত ধরে আমার শরীরে ছোঁয়াতে চাইলাম আর অমনি আবীর সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিল আমার গালে।

আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালাম।

উচ্চস্বরে আবীর বলল, ‘হ্যাভ ইউ গান ম্যাড? কাম ডাউন মীরা। লুক অ্যাট ইয়োরসেলফ—কী করেছ এ’কদিনে নিজের অবস্থা? সামওয়ান ইজ গ্রোয়িং ইনসাইড ইউ—ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যাণ্ড?’

আমি চুপ করে রইলাম। আমার দু’চোখ ভেসে গেল জলের বন্যায়। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘পাপ করেছি আমি—প্রায়শ্চিত্ত যা করতে হয় করব আমি। এর মধ্যে তুমি নিজেকে কেন জড়াতে চাইছ?’

‘ঠিক আছে মানছি। কিন্তু তোমার শরীরে যে বড় হচ্ছে—সে তো কোনো পাপ করেনি। সে যখন পৃথিবীতে এসে দেখবে তার বাবা নেই—তখন তুমি কী বলবে?’

আমার সমস্ত বোধ অসাড় হয়ে গেল। আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। দু’চোখ দিয়ে বয়ে চলল নিঃশব্দ জলের ধারা।


আমার জীবনে আবীরের আবির্ভাব দেবদূতের মত।

যেন এক দমকা হাওয়া। আমার হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস, অফুরন্ত হৈ-হুল্লোড়, ছেলেমানুষি সবকিছুই যেন আবীর আমাকে ফিরিয়ে দিল। আবীর যেমন রঙ ছড়ায়—তেমনি সে আমার জীবনের রঙ হয়ে এলো। আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ সময়টাতে তার মহানুভবতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনল স্বাভাবিক জীবনে।

আমার যখন বিয়ে হয় আমি তখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

বিষয়টি নিয়ে আবীর তেমন মাথা ঘামাল না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের সমস্ত আয়োজন করল। কোনো কিছুরই কমতি রাখল না। আমি তার আয়োজন দেখে বললাম, ‘কেন এমন পাগলামি করছ? মানুষজন জানানোর দরকার কী?’আবীর কোমল স্বরে বলল, ‘আমরা তো কোন পাপ করছি না যে লুকিয়ে করতে হবে।’

আবীর নিজেই আমার এনগেজমেন্ট রিং আর ওয়েডিং ব্যান্ড ডিজাইন করল। আমার পাহাড়সম ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে সাহায্য করল। আমাকে স্বাবলম্বী হবার পথ সহজ করে দিল ওর শক্ত হাত।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আমাদের প্রথম সন্তানের আগমন ঘটবে। আমরা দুজন সন্তান বিহীন আমাদের শেষ সময়টুকু উপভোগ করছিলাম। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি—কেউ একজন, পর্দার আড়াল থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে কৌতুক করছেন আর মিটিমিটি হাসছেন।

সেই বসন্তে আবীর যখন অসুস্থ হলো, সেটা ঘটলো খুবই দ্রুত এবং হঠাৎ করেই। আবীরের রঙ যেন একটু একটু করে ফ্যাকাসে হতে শুরু করল। সেই সাথে আমার বসন্তের রঙও বদলাতে বদলাতে হয়ে গেল ধূসর।আবীর মাঝে মাঝেই বলত ওর মাথা ঘুরছে। ওটাকে আমরা সাধারণ মাইগ্রেইনের বেশি কিছু মনে করে আমলে নেই নি।

আমরা প্রায়ই লাঞ্চ করতাম বাইরে। একদিন একটি রেস্টুরেন্টে বসে আমার জন্যে মিক্সড সালাদ, আবীরের জন্যে একটা স্যুপ আর একটা চিকেন স্যান্ডুইচ অর্ডার করেছি ভাগ করে খাবো বলে। ওয়েট্রেস মেয়েটি চলে যাওয়া মাত্রই আমি লক্ষ্য করলাম আবীরের চেহারার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন। আমি বললাম, ‘আবীর, এনিথিং রং? তোমার কী খারাপ লাগছে?’

‘একটু ডিজি ফিল করছি। অসুবিধা নেই—ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আমার মনে হয় তোমার ডাক্তারের সঙ্গে ইমেডিয়েটলি একটা এপয়েন্টমেন্ট করার দরকার। এভাবে ঘন ঘন ডিজি ফিল করছো, এটা কোন ভালো লক্ষণ নয়।’‘হ্যা, আমি ডাক্তার দেখাব খুব শীঘ্রই। মুখে একটু ঠান্ডা পানির ঝাপ্টা দিলেই ঠিক হয়ে যাবে… আমি আসছি।’ বলেই আবীর উঠে দাড়াল, তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেল রেস্টরুমের দিকে।

ওর ধীরলয়ে হাঁটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি আমার আইস-টি’তে একটা চুমুক দিলাম। হঠাৎ করে ওর কী হতে পারে এটাই ভাবছিলাম। আমি হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে ভেতরের দিকে তাকালাম। দেখি ওয়েট্রেস ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে আমাদের টেবিলের দিকেই আসছে।

হঠাৎ করেই একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি আমাদের ওয়েট্রেস মাটিতে পড়ে আছে। চারিদিকে খাবার ছিটকে পড়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি আবীরও মেঝেতে পড়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, রেস্টরুম থেকে ফিরে আসার পথে আবীর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওয়েট্রেসের উপরে গিয়ে পড়েছে। এবং সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়েছে।

রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার ইতিমধ্যেই ৯১১ কল করে দিয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এম্বুলেন্স এসে আবীরকে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রেসপন্সে নিয়ে গেল। দায়িত্বরত ডাক্তার প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশন শেষ করে বলল, ‘You can go home. But I would like you to follow up with an MRI.’

এমআরআই কেন? আমার মাথায় প্রথম চিন্তা এলো। আবীরের মুখ শুকিয়ে গেল—সে তাকাল আমার দিকে, তারপর ডাক্তারের দিকে।

ডাক্তার বলল, ‘You’re going to die.’

আবীরের মুখটি রক্তশূন‍্য হয়ে গেল। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালাম।

ডাক্তার হেসে দিয়ে বলল, ‘We all are going to die one day, right?’

কিছু কিছু ডাক্তার এমন সিরিয়াস মুহূর্তে রোগির সঙ্গে মাঝে মাঝে হালকা রসিকতা করার চেষ্টা করে। কিন্তু আবীরের এই ডাক্তারটির বয়স কম বিধায় তার রসিকতা আবীর ধরতে পারল না। সেই মানসিক অবস্থাতেও সে নেই। সে শুকনো মুখে হাসার চেষ্টা করল।ডাক্তার আবার বলল, ‘Come on man, you’re not going to die, ok?’ এবার আবীর হেসে ফেলল। মনে হয় একটু সাহস পেল। সে বোকার মত তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে।

  • ফরহাদ হোসেন
    লেখক-নির্মাতা
    ডালাস, টেক্সাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *