ধূসর বসন্ত (২য় এবং শেষ পর্ব)

দু’দিন পর আবীরের এমআরআই রিপোর্ট এলো। আবীর আর আমি বসে রয়েছি ডাক্তারের অফিসে। ডাক্তার একটা এমআরআই ফিল্ম লাইটের উপর ধরে আছে। কিছুক্ষণ ভাল মত লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার দেখা যায় লাল টকটকে ছোট্ট একটা বৃত্ত জ্বলজ্বল করছে—অনেকটা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর ওপরে যেভাবে লাল বাতিটা জ্বলে।

আমরা রক্তশূন্য মুখে দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। সমস্ত রুমখানি এক ধরণের অস্বস্তিকর নীরবতায় ছেয়ে গেল।ডাক্তারের আর কিছু ব্যাখ্যা করতে হলো না। আমরা সবাই জানি, ঐ রক্তবিন্দু আসলে কী? বিন্দু না আসলে বৃত্ত। আবীর সবাইকে অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত আস্থার সাথে বলল, ‘ঐ জিনিস যত দ্রুত আমার মাথার ভেতর থেকে বের করা যায়—ততই ভাল। তুমি ডাক্তারকে বল, সার্জারির ব্যবস্থা করতে।’আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো—সে পারবে। আমি আবীরের হাত ধরে বললাম, আমি জানি তুমি পারবে। আমি তাকে সাহস দিলাম।

হিউস্টনের বিখ্যাত এমডি এণ্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারে আবীরের ব্রেইন সার্জারি হলো। সার্জন তার নিপুণ হাতে আবীরের মাথার খুলি কেটে বিচক্ষণতার সাথে ভেতর থেকে টিউমারটি কেটে ফেলে আবার জোড়া লাগিয়ে দিলেন।

আবীরের সাহসের তারিফ না করে উপায় নেই। ব্রেইন সার্জারির মতো এতবড় একটা ঘটনা—অথচ সে এমন ভাব দেখাল যেন এটা ব্রেইন সার্জারি নয়—এপিন্ডিকটমি। যা শরীরের ভেতরে থাকা না থাকা সমান কথা। জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি আবীরের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। ওর হাতটা ধরলাম। আবীর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। এবং দৃঢ় চিত্তে বলল, ‘আমি রেডি। আমাকে এখন এখান থেকে নিয়ে চলো।’

সার্জারির সাত দিনের মাথায় আবীরকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ওর মাথায় তখনো ব্যান্ডেজ আছে। সুতার মত একটা কাটা দাগ স্পষ্ট।
একদিন হঠাৎ আমার ব্যথা শুরু হলো। সে কী চিৎকার—সহ্য সীমার বাইরে। আমরা দ্রুত হাসপাতালে গেলাম। লেবার রুমে ১৬ ঘণ্টা চেষ্টা করার পর ডাক্তার সি-সেকশন করে আমার ফুটফুটে বেবিটাকে বের করে এনে আমার কোলে তুলে দিল। আহ সেই মুহূর্ত, আবীরের হাসি মাখা মুখটা দেখতে কী যে ভাল লাগছিল—সেই মুখ আমি কোনোদিন ভুলব না। পুরো সময়টা আবীর এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে যায়নি। হাত ধরে বসে থেকেছে। ফোমের গ্লাসে করে বরফ কুচি এনে আমার মুখে তুলে দিয়েছে। নরম টিস্যু দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিয়েছে।দেখতে দেখতে আরো একটা বছর কেটে গেল। আমরা আবীরের জন্মদিন পালন করলাম। আমি বসার ঘরটিতে অনেক রকমের মোমবাতি দিয়ে সাজালাম। বেকারি থেকে ওর পছন্দের কেক আনলাম। ওর হাত ধরে টেবিলের কাছে দাঁড় করালাম। আমি হ্যাপি বার্থডে গান গাইলাম। আবীর কেক কাটল।আমি আবীরকে ওর প্রিয় কেকের একটা পিস কেটে ওর হাতে দিলাম। সে অনেক তৃপ্তি নিয়ে কেক খেলো। তারপর গভীর দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো। তুমি একটুও চিন্তা করবে না।’

আবীর সত্যি সত্যিই অনেক সুস্থ হয়ে গেলো। অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও।

আবীর ধীরে ধীরে ওর হারানো শক্তি ফিরে পেতে থাকল। সে প্রতিদিন বিকেলে সাইকেল চালায়—কাজে যায়—বাসায় এসে বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রুটিন করে বাবুকে ঘুম পাড়ায়। ফিডার খাওয়ায়। এবং স্ট্রলারে করে পার্কেও নিয়ে যায়।

আমিও আমার কাজে ফিরে গেলাম। আমি নিশ্চিন্ত মনে অফিস যাই-আসি।

ইতিমধ্যে আবীর বেশ দক্ষতার সাথে বাবুর ডায়াপার বদলানো শিখে গেল। ডায়াপার র‍্যাশ হলে ক্রীম লাগিয়ে দেয়। বাচ্চাকে নিয়ম করে খাওয়ায়। আমরা ভুলেই গেলাম আবীরের ব্রেইনে একটা টিউমার ছিল—এবং সেই অধ্যায়টা এখন শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।আমাদের আনন্দের সীমা রইল না। আমরা আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতই আমাদের সময় কাটাতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের এই আনন্দ বেশিদিন কপালে সইল না। দুঃস্বপ্নের দিন আবার ফিরে এলো। দু-মাস যেতে না যেতেই আবীরের মাথায় অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার আবীরের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে কিছু টেস্ট করালেন এবং দ্বিতীয় সার্জারির জন্যে তৈরী হতে বললেন। দ্বিতীয় সার্জারিও সফল হলো, কিন্তু আবীরকে নিয়মিত রেডিয়েশন থেরাপির মধ্যে দিয়ে যেতে হলো। আবীরের হতবিহ্বল, বিধ্বস্ত ও শঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘যা ঘটেছে সব অতীত। সব কিছু ভুলে যাও আবীর। মনে করো তোমার জীবনে কিছুই ঘটেনি।’ আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দু’হাতে ওর হাত দু’খানি আমার হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, ‘এসো, আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি। তুমি, আমি আর আমাদের চাঁদের টুকরা।’

‘আগামী এক বছরের মধ্যে আর কোন সার্জারি নয়।’ আবীর হাসি হাসি মুখে বলল।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এক বছরের মধ্যে আর কোন সার্জারি নয়।’ আমিও তাকে আশ্বস্ত করে বললাম।

দেখতে দেখতে সামার চলে এলো। পুরো সামারটা আমরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ালাম। সুন্দর সুন্দর জায়গায় গেলাম। সুন্দর একটা ভ্যাকেশন কাটিয়ে ফিরে আসতে না আসতেই আবীরের মাথাব্যথা বেড়ে গেল। আর বাড়ল আমার দুশ্চিন্তা। আবীরের টিউমারটি আবার ফিরে এসেছে।স্টেরাইল মেডিক্যাল অফিসে বসে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পরে নিউরো-অনকোলজিস্ট আমাদের সামনে এসে খবরটা দিল। স্টেজ ফোর। গ্লিওব্লাস্টমা।

মস্তিস্কের ক্যান্সার একটি জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধি; বিশেষ করে গ্লিওব্লাস্টমা মাল্টিফরমিস ব্রেইন টিউমার অত্যন্ত মারাত্মক। এ ক্যান্সার হলে টিউমার অপারেশন করে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দেওয়ার পরও রোগী বাঁচে মাত্র ১২-১৪ মাস।

আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিল—এটা সেই একই টিউমার যার কারণে টেড কেনেডীর মৃত্যু হয়েছিল—আর পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের চিকিৎসা নেবার সুযোগ তার ছিল। আমাদের সামনে কী আছে। আমি ছলছল চোখে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।

‘মীরা, তুমি একটুও চিন্তা করো না। আমি সুস্থ হয়ে যাবো। আমরা আগের চেয়েও অনেক ভাল থাকব, তুমি দেখে নিও।’ আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আবীর গাঢ় স্বরে বলল। ‘আমি দুঃখিত তোমাকে এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমি খুবই দুঃখিত।’ করুণ চেহারা করে সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

‘এটাতো তোমার দোষ নয় আবীর।’ আমি আবীরকে স্বান্তনা দিয়ে বললাম, ‘তুমি তো ভুল কিছু করোনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এখন এটাই আমাদের জীবন।’

এরপরে আর কোনো কিছু লুকাবার ছিল না। আমরা জেনে গেলাম, আর কোনো চিকিৎসাই নেই যা দিয়ে আবীর কে ভাল করা যেতে পারে। এখন যা করার তা হচ্ছে অপেক্ষা—শুধুই অপেক্ষা। সেই অপেক্ষা কত দিনের? কয়েক মাস? না বছর? একমাত্র আল্লাহই জানেন।

আবীর, মাই পুওর হাজবেন্ড দিনে দিনে কেমন অসহায় হয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ওর চোখেমুখে আর কোনো ভাবাবেগ নেই। একটু একটু করে দুর্বল হতে শুরু করল তার শরীর। একটু পর পরই বলে, খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু ঘুমানো দরকার। দিনের বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়েই কাটায় এখন। ঘুম ভাঙ্গার পর একটু ভাল বোধ করলে বাবুটার সাথে একটু খেলার চেষ্টা করে। তারপর আবারো বিছানায় যেয়ে শুয়ে থাকে।

আমাদের পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসল। একে একে কাছের বন্ধু-স্বজন, পরিবার-পরিজন আসা শুরু করল। তারা আসে, কিছুক্ষণ বসে থাকে। দু’একটি সাহস দেয়া কথা বলে। তারপর চলে যায়। কেউ ফুল নিয়ে আসে—কেউ আনে খাবার। লোন দেবার নামে কেউ টাকা পয়সা সাহায্য দিতে চায়—আমি বলি, যখন লাগবে জানাব। একে একে সবাই আসে-সবাই চলে যায়। যা যায় না তা হচ্ছে কঠিন বাস্তবতা আর ভয়ংকর সত্য। যার মুখোমুখি হচ্ছি আমি আর আবীর প্রতিদিন একটু একটু করে।

মানুষের শরীরে ক্যান্সার একবার বাসা বাঁধলে অস্ত্রোপচারের পরেও ক্যান্সার কোষগুলি বৃদ্ধি পায় এবং সেগুলো রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আবীরের শরীরে ক্যান্সার কোষগুলি বাড়তে থাকল—ভয়ংকর রূপে। চুড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বল হয়ে পড়ল সে। তার ব্রেইন কাজ করা বন্ধ করে দিল। ভুলে গেল কিভাবে টিভি অন করতে হয়। আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকল সবকিছু। আমার সাহায্য ছাড়া সে এক পা-ও আগাতে পারে না। একটা বাচ্চা ছেলের মত ব্যবহার করতে লাগল সে। একদিকে আমার কোলে এক বাচ্চা—আর এ্কদিকে আবীর। চোখে অন্ধকার দেখার মত অবস্থা হলো আমার।

আস্তে আস্তে আমি আমার ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। অল্পতেই আমি ক্ষেপে যাই। একদিন আবীরের শার্টের কলার ধরে তাকে ঝাঁকি দিয়ে বললাম, ‘কেন আবীর কেন? আমাকে কেন এই মহা সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে এখন তুমি চলে যেতে চাইছ। এমন কী অপরাধ আমি করেছিলাম যার শাস্তি আমাকে এভাবে পেতে হচ্ছে।’আবীর কী বুঝল জানিনা—তার দু চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তার চোখের দিকে।

এরমধ্যেও প্রতিদিন আবীর আমাকে মনে করিয়ে দিল—আমার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অন্য যে কোনো মেয়ে হলে এতক্ষণে ওকে ফেলে হয়ত চলেই যেত। আমি বললাম, না যেত না। কোনো মেয়েই যেত না। মেয়েদের ভালবাসাকে এত তুচ্ছ জ্ঞান করো না। দিনে দিনে আবীরের শরীরের অবনতি হতে থাকল। শরীরে ব্যথার পরিমাণ বেড়ে গেল অসহনীয় পর্যায়ের। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি লক্ষণ এটি। রেডিয়েশনে আর কোনো কাজ হচ্ছে না। তার স্মরণশক্তি সম্পূর্ণরূপে লোপ পেল। উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু সে করতে পারে না।

একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই সে কোনো রকমে বলতে পারল শুধু, ‘আই’ম লুজিং মাই শিট।’আমি দেখলাম আবীরের পাজামার পেছনে হলুদ রঙের তরল পদার্থের মতো কিছু একটা লেগে আছে। আমি শুধু একবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল বেচারা। এতটা অসহায়ত্ব এর আগে আমি কারো চোখে কোনোদিন দেখতে পাই নি।

আমি ওকে ধরে নিয়ে গেলাম বাথরুমে। ওকে সহজ করার জন্য বললাম, ‘ইটস ওকে। ডোন্ট ফিল ব্যাড এবাউট ইট।’

আবীরের ডাক্তার কেমো বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। জানতে চাইলাম, ‘আমাদের হাতে আর কত সময় আছে?’

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে বলো দেখে যেতে।’

‘তিন মাস? ছয় মাস?’ আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম।

‘বড়জোর দু’সপ্তাহ!’ ডাক্তার বললেন।

একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের সাথে এক বিছানায় ভাগাভাগি করে থাকার কী অভিজ্ঞতা তা বোধকরি একমাত্র ভুক্তভোগি ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব না। হঠাৎ আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বুক ফেটে কান্না বের হয়ে আসল। আমি ভাবতেই পারছি না আমাদের ছেলেটা বড় হয়ে দেখবে ওর বাবা নেই।

একদিন রাতে, আমাদের বাবুটা ঘুমিয়ে যাবার পর আবীর আমাকে কাছে টেনে নিল। দীর্ঘসময় আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকল। কিছুক্ষণ খুনসুটি করল। তারপর তার কী হলো কে জানে—সে আমাকে ছোট্ট একটা চুমু দিল। তারপর আরেকটা তারপর আরো। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল আমাকে। আমি বাঁধা দিলাম না। যদিও আমি জানি আবীরের শরীরের অবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হাঁপাতে থাকল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম।

সে বলল, ‘দেখে নিও আমি ভাল হয়ে যাব। তোমার সুন্দর দিনগুলি আমি ফিরিয়ে দিব।’

আমি চুপ করে ওর কথা শুনলাম। আমি ভাবলাম সে কী জানে যে আমরা রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখান থেকে আর সামনে এগুবার রাস্তা নেই। দি এন্ড অফ দি রোড! ডেড এন্ড!

‘আবীর তুমি আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছ।’ যে মানুষটি মারা যাচ্ছে, তাকে কী এই কথা বলা যায়? আমি কিছুই বললাম না।

আবীর বলল, ‘খেয়াল রাখবে, আমাদের ছেলেটার লেখাপড়া যেন বন্ধ না হয়। আমি চাই ও কলেজে যাবে-লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। এর বেশি কিছু আর আমি চাই না।’

আমি তার হাত ধরে চুপ করে বসে রইলাম। আমার চোখ ভিজে উঠল উষ্ণ পানিতে।

একদিন বিকেলে আমরা পার্কে হাঁটতে গেলাম। আবীরকে শেভ করিয়ে, গোসল করিয়ে, তার পছন্দের কাপড় পরিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে আবীরের সংগে আমাদের কিছু ছবি তুলে রাখা। আমাদের বাবুটাকে আবীরের কোলে দিয়ে আমার ফোন দিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। আবীর আমার কাছে এসে বলল, আমার সাথে সেলফি তুলবে না? আমি হেসে দিয়ে কয়েকটা ফ্যামিলি সেলফি তুললাম। ছবি তোলা শেষ হতেই আবীর আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি শুধু আমার!’আমার চোখ ভিজে উঠল। আমি দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম আবীরকে। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হু হু করে কেঁদে ফেললাম।

এক সপ্তাহ পরেই আবীরের খিঁচুনি উঠল। সাথে সাথেই তাকে নিয়ে গেলাম ইমার্জেন্সিতে। সেখান থেকে তারা নিয়ে গেল হসপিস কেয়ার সেন্টারে। আবীরকে নিবিড় পরিচর্যা রুমে রাখা হলো। আবীরের সঙ্গে আমার শেষ এক ঘণ্টা সময় কাটল নীরবে।

আমি বাসায় চলে এলাম। বাবুটা অনেক বিরক্ত করছিল। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে নির্ঘুম আমি ভাবছি আকাশ-পাতাল। ভাবছি আমার নিজের কথা। আবীরের কথা। জীবনের বাঁকে কখন হোঁচট খেতে হয়—কেউ জানে না।

মানুষের সুখের জীবন এত ছোট কেন? আমার সমস্ত জীবনখানি রিওয়াইন্ড করে প্রথম থেকে ভাবছিলাম। আমরা কী এমন অপরাধ করেছিলাম—যার জন্যে এত বড় শাস্তি আবীরকে পেতে হচ্ছে। ভুল কিছু যদি হয়ে থাকে সেটা করেছি আমি।

হঠাৎ করেই বাবুটার ঘুম ভেঙে গেল—কোনো কারণ ছাড়াই। ঘুম ভেঙ্গেই সে কান্না শুরু করল। কান্নার মধ্যে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম ফোনটার দিকে। এই ফোন আমি ধরতে চাই না—কিছুতেই না। অসভ্য ফোন তবুও নির্লজ্জের মত বেজেই চলেছে। আমার হৃৎপিণ্ডের কাঁপন বেড়ে গেল—কাঁপা হাতে আমি ফোনটা ধরে চুপ করে রইলাম। ওপাশ থেকে অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে কেউ একজন কিছু বলল। কী বলল তার কিছুই যেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার চোখ দুটো দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। আমি নীরবে কেঁদে চললাম। এ কান্নার কোনো শব্দ নেই। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেল। আমি ফোন হাতে মূর্তির মত বসে রইলাম।

আবীর মারা গেল আমাদের দ্বিতীয় বিয়ে বার্ষিকীর কিছুদিন আগে। এক ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে বিয়ে করেছিলাম আমরা। আরেকটি ভ্যালেন্টাইনস ডে আসার আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল সে। সেটাই ছিল তার শেষ বসন্ত। এক বসন্তে সে এসেছিল আমাকে রাঙিয়ে দিতে আর আরেক বসন্তে বিদায়।

কিছু বসন্তের রঙ ছড়িয়ে যায় প্রকৃতিতে আর কিছু রঙ কেবলই ধূসর হয়ে যায়।


সময় যেমন কারো জন্য থেমে থাকে না—জীবনও থেমে থাকে না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে—আপন গতিতে। সেখানে আমাদের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। আমাদের ছোট্ট বাবুটা এখন হাঁটি হাঁটি পা পা করছে—সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। একদিন সে স্কুলেও যাবে, কলেজ শেষ করবে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে উঠে যাবে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে—আবীর বলেছিল, আমাদের ছেলেটাকে কলেজে পাঠাবে।

মাঝে মাঝে মনে হয়—জীবন তো চলে যাচ্ছেই। ছেলেটা বড় হচ্ছে—তার পেছনে সময় দিচ্ছি। আমি তার মা আবার আমিই তার বাবা। আমার ছেলের ভাল-মন্দের বাইরে এখন আর অন্য কিছু ভাবনার অবকাশ নেই। আমার ছেলেটাই আমার জীবনের সব আনন্দ—সব ভালবাসা। আমার বেঁচে থাকার আনন্দ!

আবীরকে মিস করি। অনেক। যখন দেখি আবীর নেই—তখন দম বন্ধ হয়ে আসে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে—মনে হয়ে প্যারালাইজড হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দীর্ঘশ্বাসে বুকটা ভারি হয়ে ওঠে।

আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে এভাবে একা একা আর কতদিন? যে যাবার সে চলে গেছে। নতুন করে জীবন শুরু করতে অসুবিধা কোথায়? আমি জানি নতুন কাউকে খুঁজে নেয়া আমার জন্যে কোন কঠিন কিছু না। কিন্তু যার জন্যে আমার বেঁচে থাকা—তার স্থানে অন্য কাউকে আমি বসাই কী করে?

বেঁচে তো আছি। নিঃশ্বাস নিচ্ছি, হাসছি, দেখছি। বত্রিশ পাউন্ডের একটা ছোট্ট স্বপ্নকে সাথে নিয়ে ঘুরছি আর অনুভব করছি আবীরকে যে রয়েছে এবং থাকবে আমার বুকের গভীরে—সারা জীবনের জন্যে। যে মানুষটি তার নিজের মান বিপন্ন করে আমার মান বাঁচিয়েছে, যে আমাকে ভালবেসেছে নিঃস্বার্থ ভাবে—তার জন্যে আর কিছুই করতে না পারি, এটুকু স্যাক্রিফাইস কী করতে পারব না?

পরম করুণাময়ের কাছে শুধু প্রার্থনা—আমার আবীরকে তুমি ভাল রেখো!

(সমাপ্ত)

  • ফরহাদ হোসেন
    লেখক-নির্মাতা
    ডালাস, টেক্সাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *