নাকফুল

নিলুর জন্য একটা নাকফুল কেনা হবে। ডায়মন্ডের নাকফুল। এই নিয়ে আমি আর নিলু প্রতি রাতে শলাপরামর্শ করি। আজ নবম দিন। কাল শুক্রবার। আমি আর নিলু আগামীকাল যাব বসুন্ধরা মার্কেটে । যদিও নাকফুল কেনা হবে না। আমরা যাব নাকফুলের দাম জানতে। স্বর্ণের নাকফুলের দামের ধারণা আমার আছে। নিলুর সাথে বিয়ের সময় আমাদের ফুলবাড়িয়া বাজারের বনলতা জুয়েলার্সের সুশীলের কাছ থেকে তেরশো টাকায় একটা স্বর্ণের নাকফুল নিয়েছিলাম। নাকফুলটা বেশ সুন্দর। নিলু খুব পছন্দ করেছিল। কিন্তু ডায়মন্ডের নাকফুলের দামটাম বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।

বিয়ের দুই বছর হলো। নিলুকে আমি তেমন ভালো কিছু উপহার দিতে পারিনি কখনো। খুব ইচ্ছে করে। মতিঝিলে ছোটো একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের চাকরি। ষোলো হাজার টাকা বেতন দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। এই দিয়ে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার চিন্তা কখনোই করিনি।

আমি জানি না কেন। মাসখানেক আগে থেকেই নিলুকে একটা দামি উপহার দেওয়ার কথা মাথায় শুধু ঘুরছে। মেয়েটা আমার কাছে কখনো কিছু চায় না। ভাবলাম একটা নাকফুল কিনে দিই। দাম জানি না। শুধু মাথায় এলো একটা ডায়মন্ডের নাকফুল কিনব নিলুর জন্য। অল্প-অল্প করে কিছু টাকা জমিয়েছি। আড়াই হাজার টাকা জমেছে। নয়দিন আগে নিলুর হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকাগুলো রাখো। আরও কিছু জমিয়ে তোমার জন্য একটা নাকফুল কিনব। ডায়মন্ডের নাকফুল।

ভেবেছিলাম নিলু না করবে। অভাবের সংসারে একটু এদিক-ওদিক টাকা খরচ করলেই নিলু মন খারাপ করে। মাসের শুরুতে বাজার সদাই সবকিছু একবারে আনি। আজ পর্যন্ত নিলুকখনো বলেনি এটা শেষ। আবার নিয়ে এসো। বরং মাঝে মাঝে বলে এই মাসে লবণ আনা লাগবে না। হলুদের গুঁড়া অনেক জমে আছে। এটা লাগবে না। ওটা লাগবে না। অল্প তেলে সবকিছু কী স্বাদের করে রান্না করে নিলু। আধা কেজি তেল দিয়ে পুরো মাস পার করে। আমার খুব অবাক লাগে। আমি হাসতে হাসতে বলি, রান্নায় তেলটেল দেওয়া বাদ দিলে বুঝি!

আমার কথা শুনে নিলু একটু আহ্লাদী অভিমান করে বলে, না তেল দিব কেন, আমি তো সব রান্না-বান্না তোমাকে সিদ্ধ করে খাওয়াচ্ছি। সিদ্ধ রান্না-বান্না খেয়ে-খেয়ে তোমার মুখে বুঝি অরুচি ধরে গেল?

নিলুর অভিমান দেখে আমি আর কথা বাড়ালাম না। সংসারে কিছু টাকা সাশ্রয়ের জন্য নিলু দিনরাত আপ্রাণ চেষ্টা করে। আমার খুব মায়া হয়। ভীষণ মায়া। মাঝে মাঝে মনে হয় ইস, নিলুকে যদি আরেকটু সচ্ছল রাখতে পারতাম।

টাকা খরচের বিষয়ে সবকিছুতেই না করা নিলু কেন জানি নাকফুল কেনার বিষয়ে না করল না। কথাটা শুনে নিলু খুব খুশি হয়ে গেল। নিলুকে আমি কখন এত খুশি হতে দেখিনি। কেন জানি না। খুশিতে নিলুর চোখের কোণে পানি জমে আছে। নিলু বোধহয় কাঁদছে। নিলুর এই কান্না দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।

আমি রোজ এক দুইশ টাকা করে গত নয় দিন ধরে নিলুকে দিচ্ছি। একটা টিনের কৌটায় নিলু টাকাগুলো জমিয়ে রাখছে। রোজ-রোজ টাকাগুলো বের করে গোনে। আমি বিছানায় শুয়ে থাকি। নিলু আমার পাশে বসে টাকা গোনে। আমার দেখতে ভালো লাগে। সব মিলিয়ে এখন চার হাজার দুইশ টাকা হয়েছে। কাল সকালে আমি আর নিলু নাকফুল দেখতে যাব।

বসুন্ধরা সিটিতে আমি আর নিলু ঘুরছি। নিলু এই প্রথম বসুন্ধরা সিটিতে এলো। এত বিশাল শপিং সেন্টার দেখে নিলু অবাক হয়ে গেল। বিশাল-বিশাল জুয়েলারি দোকানের সামনে দিয়ে আমরা দুজন কয়েকবার ঘুরে এসেছি। আমাদের কেমনজানি ভয় ভয় লাগছে। এত বড়ো দোকান। কত পরিপাটি। সেই দোকানে ঢুকে ডায়মন্ডের নাকফুলের দাম জানতে চাওয়ার জন্য সাহসে কেন জানি কুলাচ্ছে না। তাছাড়া আজ তো আমরা কিনব না। পছন্দ করে দাম জেনে রাখব। জুয়েলারি দোকানগুলোর আশপাশে শুধু ঘুরছি। বেশ অস্বস্তি লাগছে। আমি আগে কখনো এমন দোকানে গিয়ে কিছু কিনিনি।

নিলু বলল, দূর চলো বাসায় যাই। নাকফুল কেনা লাগবে না। এখানে খুব দাম রাখবে। দেখছো না কত বড়ো দোকান। বড়ো দোকানের দাম বড়ো হবে। এক টাকার নাকফুল একশ টাকা বলবে। শুধু শুধু কেন দাম বেশি দিতে যাব।

আমি বুঝতে পারি নিলুও আমার মতো ভয় পাচ্ছে। তাছাড়া আমার অস্বস্তি দেখে হয়তো তার মায়া হচ্ছে। নিলু খুব ভালো করে জানে এত বিশাল দোকানে গিয়ে কিছু কেনার অভিজ্ঞতা আমার নেই। নিলু চায় না আমি এই নাকফুল কেনা নিয়ে এতটা অস্বস্তিতে থাকি। নিলুর মুখে বাসায় ফিরে যাবার কথা শুনে আমার ভেতরটা জেগে উঠল। আমি সাহস করে একটা দোকানে ঢুকে গেলাম। দোকানিরা বেশ ভালো। অনেক নাকফুল দেখাল। সব দামি-দামি। দাম শুনে নিলু খুব ভয় পেয়ে গেল। লুকিয়ে আমার হাত ধরে টানছে বাসায় ফিরে যেতে। আমার আমতা-আমতা দেখে দোকানিরা বুঝতে পারে। তাছাড়া নিলুর আচরণ দেখেও হয়তো বুঝে নিয়েছে আমরা অত দামি নাকফুল নিতে আসিনি। শেষে অল্প দামের কিছু নাকফুল দেখলাম। ছয় হাজার টাকা দামেরটা আমি আর নিলু পছন্দ করলাম। খুব ছোট। তারপরও নিলু ওটাই নিবে। নাকফুল দেখে আমি আর নিলু বেশ খুশি মনে বাসায় ফিরে আসলাম।

ঠিক সাতদিন পর আমি আর নিলু গিয়ে সেই নাকফুল কিনে আনলাম। পুরো রাস্তায় নাকফুলটা নিলুর হাতের মুঠোয় ধরা ছিল। আমি অনেকবার বলেছি ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে। নিলু নাকফুল হাতের মুঠোয় রাখল। নিলু বলল, না এটা আমার হাতেই থাকবে। ছোট জিনিস ব্যাগে রাখলে যদি হারিয়ে যায়।

গাড়িতে বসে মাঝে মাঝে নিলু হাতের মুঠোতে নাকফুলটা দেখছে। নিলু কী যে খুশি। আমি ভাবি, ছোট একটা নাকফুল পেয়ে মেয়েটা এত খুশি হয়েছে। আমার ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। ভীষণ ভালো।

নাকফুল কেনা হয়েছে প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গেল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিলু হঠাৎ খুব অস্থির হয়ে পড়ল। পুরো ঘরের জিনিসপত্র ওলটপালট করা শুরু করল। আমি জানতে চাইলে নিলু চুপ করে থাকে। নিলুর এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি দেখে আমি জোর করে জানতে চাইলাম কী হয়েছে?

নিলু কাঁদছে, হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার নাকফুল খুঁজে পাচ্ছি না।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, এটা নিয়ে এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। তুমি ভালো করে খুঁজে দেখ, পেয়ে যাবে।

নিলু পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজল। একদিন, দুইদিন, তিনদিন যায় কিন্তু নিলু আর সেই নাকফুল খুঁজে পায় না। এবার আমি নিশ্চিত হলাম এ নাকফুল আর পাওয়া যাবে না। আমি নিলুকে খুব করে বললাম, মাস দুয়েক পরে আমি আরেকটা নাকফুল কিনে দেব। এটা নিয়ে আর চিন্তা করার দরকার নেই।

নিলু কিছুই মানতে চায় না। রোজই নিলু কাঁদে। ভীষণ কাঁদে। আমার দেখতে খুব খারাপ লাগে। নিলুর একটাই কথা, তার ওই নাকফুলই চাই।

সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেল। নিলু তারপরও ওই নাকফুলের জন্য অস্থির হয়ে আছে। তার বিশ্বাস এই নাকফুল না পেলে আমার নাকি অমঙ্গল হবে। আমার মনে হচ্ছে নিলু নাকফুলের চেয়ে আমার অমঙ্গলের কথা ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে অস্থির হচ্ছে। আমি নিলুকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করি। এসব কুসংস্কার। তারপরও নিলুর কান্নাকাটি থামে না। রোজ এসব দেখতে আমার আর ভালো লাগে না।

অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমানো টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা লোন নিয়ে আমি গেলাম বসুন্ধরা শপিং সেন্টারে। নিলুর জন্য কেনা আগের নাকফুলের মতো হুবহু আরেকটা নাকফুল কিনে নিয়ে গেলাম বাসায়। নিলু প্রতিদিন ফ্লোর ঝাড়ু দিয়ে ময়লাগুলো একটা ব্যাগে জমিয়ে রাখছে। নাকফুল হারানোর পর থেকে ফ্লোর ঝাড়ু–দেওয়া ময়লা একটুও ফেলেনি। আমি অফিসে যাওয়ার পর রোজ এই ময়লায় নাকফুল খোঁজে। আমি লুকিয়ে সেই ব্যাগে নাকফুলটা রেখে দিয়ে অফিসে চলে আসলাম।

দুপুর ১২টার দিকে নিলু ফোন দিয়েছে। নিলু চিৎকার করে কাঁদছে। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, আমি নাকফুল পেয়ে গেছি। আমি নাকফুল পেয়ে গেছি। নিলু এত খুশি হয়েছে যে খুশিতে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার কারণে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।

নিলুর খুশির কান্না শুনে আমার চোখে পানি চলে এল। আমি জানি নিলু কেন এত খুশি। নিলুর মনে ভয়। আমাকে নিয়ে। নাকফুল হারালে স্বামীর অমঙ্গল হওয়ার কুসংস্কার ধারণাটা তার মনে প্রবলভাবে গেঁথে গিয়েছে। আমি জানি, এটা আমার প্রতি তার প্রবল ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতার জন্য। এই ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতা তাকে অনেক বেশি শঙ্কিত আর অস্থির করে তুলেছে।

সময় অনেক পেরিয়েছে। প্রায় দশ বছর। আমাদের দুই দুইটা মেয়ে। মেয়েগুলো ভীষণ লক্ষ্মী। নিলু আর দুই মেয়ে নিয়ে আমার সংসার মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিল। জুন মাসের শেষের দিকে আমার পেটে ভীষণ ব্যথা হতে শুরু হলো। ডাক্তার দেখালাম। পরীক্ষা করে জন্ডিস ধরা পড়ল। দিন-দিন শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। আমার ভীষণ ভয় ধরে যায়। এমনিতেই রোগবালাইয়ে আমার খুব ভয়। নিলু আর মেয়ে দুটোর জন্য ভীষণ ভয় হচ্ছে। নিলু আমার পাশে বসে কাঁদে, দোয়া পড়ে ফুঁ দেয়। আমার বড়ো মেয়েটা সুরা ইয়াসিন পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দেয়। তাদের দেখাদেখি ছোটো মেয়েটা এমনি এমনি ফুঁ দেয়। আমি লুকিয়ে কাঁদি। আল্লাহর কাছে বারবার বলি, এই মানুষগুলোর জন্য আমার হায়াত দাও আল্লাহ। আমি না থাকলে এই বাচ্চাগুলো অসহায় হয়ে পড়বে। এই বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমার হায়াত দাও আল্লাহ।

আল্লাহ হয়তো আমার কথা শুনেছে। নিলু আর আমার মেয়ে দুটোর দোয়া আল্লাহ ফেরায়নি। আমার শরীরটা আস্তে-আস্তে ভালো হতে থাকে। একদিন রাতে আমি নিলুর একটা হাত ধরে বলি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

নিলু বলল, কেন এসব বলছ?

আমি বললাম, দশ বছর আগে তোমার সাথে আমি একটা মিথ্যা বলেছিলাম। তোমার হারানো নাকফুল…

নিলু আমাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। নিলু বলল, আমি জানি। আমার কান্নাকাটি আর টেনশন দেখে তুমি নতুন একটা নাকফুল কিনে ময়লার ব্যাগে রেখেছিলে। এটা আমি জেনেছি তার ঠিক তিনদিন পর যখন আমার আগের হারানো নাকফুলটা খুঁজে পেয়েছিলাম। নাকফুল খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা আমি ইচ্ছে করে তোমাকে জানাইনি। আমার কষ্ট দেখে তুমি আরেকটা নাকফুল আমার জন্য কিনে এনে যে খুশিটা হয়েছিলে তা আমি নষ্ট করতে চাইনি। আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। ভালোবাসা কখনো অবহেলা করতে নেই। এই সংসারে ভালোবাসাটা ভীষণ প্রয়োজন। আমাদের মতো মানুষের এই একটা জিনিস নিয়েই তো যুগ যুগ পার করে দিতে পারি। নানা অভাব অনটনের মাঝেও এই কিঞ্চিৎ ভালোবাসা যে আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি। আমি তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি। শুধু মনে-মনে আল্লাহর কাছে বলেছি এই মানুষটা আমাকে কিছু দিতে পারুক বা না পারুক আমার জন্য তার ভেতর ভালোবাসার জায়গাটা যেন না কমে।

শেষের কথাগুলো বলতে বলতে নিলু হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার নিজেরও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমি কান্না লুকিয়ে রেখেছি। সত্যি এই সংসারটার ভীষণ মায়ার, ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতার। এই মায়া, ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতা হারানোর ভয় মানুষকে আরও বেশি মায়া, ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতায় জড়িয়ে ফেলে। যেমনটা জড়িয়েছি আমি আর নিলু। কী এক মায়ায় জড়িয়ে আমরা দিনের পর দিন অনুভব করছি সংসার নামক সুখের ভালোবাসা।

আমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতায় জড়িয়ে থাকতে চাই।

রুহুল আমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *