বোকা মেয়ের গল্প ( ৬ষ্ঠ পর্ব )

ও মা গো – বলেই লাফিয়ে পিছনে সরে যায় কেকা।
রান্না ঘরে সাপের মতো এক বস্তু একেবেকে কেকার দিকে এগিয়ে আসছে, কেকার সমস্ত শরীর কেমন যেন রি রি করে ওঠে। বাজার থেকে এসে ব্যাগটা কেকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সজল ওয়াস রুমে ঢুকেছে। রান্না ঘরে এসে কেকা বাজারের ব্যাগটা যেই উল্টেছে এতো লম্বা একটা বস্তু মাটিতে পড়েই মেঝের মধ্যে সাপের মতো চলতে শুরু করেছে। জীবনে এই জিনিস কেকা দেখেছে কি না মনে করতে পারছে না। কেকার চিৎকার শুনে সজল দৌঁড়ে এসেছে।কেকাকে ভয়ে অস্থির হয়ে কাঁপতে দেখে সজল ঘর ফাটিয়ে হাসছে।

এবার কেকার সত্যি সত্যিই রাগ হলো – এসব কী? তুমি এটা কী নিয়ে এসেছো? আর আমাকে ভয় পেতে দেখে তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে না?

সজল বললো,আসলেই তুমি এটা কী জানো না?

-না, আমি এই জিনিস কখনই দেখিনি।

-এটা মাছ।

-কী মাছ?

-বাইন মাছ।

-তুমি জানো আমি মাছ খেতে পছন্দ করি না, তার পর যেনতেন মাছ না, তুমি সাপের মতো একটা মাছ নিয়ে এসেছো, এখন আমি এই মাছ কুটবো কী করে?সজলকে এবার একটু চিন্তিত মনে হলো।
কেকা নিজে মাছ খায় না, সে বিয়ের আগে টুকটাক রান্না বান্না করলেও মাছ কাটাকাটির অভিজ্ঞতা তার তেমন একটা নেই বললেই চলে। অবশ্য বিয়ের পরে আস্তে আস্তে সব কাজই সে শিখে নিচ্ছে কিন্তু এই সাপের মতো মাছ তার পক্ষে কিছুতেই কাটা সম্ভব না, মাছটা দেখলেই তার সমস্ত শরীর কেমন গুলিয়ে উঠছে। তাহমিনাও এখন বাসায় নেই, ওর চাচা এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেছে, সম্ভবত পাত্র পক্ষকে দেখাতে নিয়ে গেছে। মায়া বেগমের অপারেশন হবে, তিনি এখন হাসপাতালে। বাসায় একটা চৌদ্দ পনের বছরের মেয়ে আছে, নাম রুবি। সে কাজকর্ম তেমন একট বোঝে না। রুদ্রকে নিয়ে সারাদিন বসে বসে কার্টুন দেখেই সময় কাটায়।
কেকার এই মুহূর্তে মনে হলো -সে মহা বিপদে পড়েছে!মহা বিপদ!কেকার চিৎকার শুনেই মনে হয় রুবিও কার্টুন দেখা ফেলে দৌঁড়ে এসেছে, রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে উঁকি দিয়ে ভিতরের কান্ড কারখানা দেখছে। এইবার রুবির মুখে হাসি ফুটলো, রুবির চোখ দুটোই ট্যাড়া, সে ট্যাড়া চোখে হাসতে হাসতে বললো – মামী আপনি চিন্তা করবেন না,এই মাছ আমিই কুটতে পারবাম।

কেকা বেশ অবাক হলো – সত্যিই তুই পারবি? হ মামি, আমার বাবায় তো জেলে। মাছ ধরাই তার কাজ, আফনি ভয় পাইয়েন না, আমি মাছ কাইট্টা দিমুনে।
রুবি মাছ কাটছে কেকা পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। সত্যিই তো! কতকিছু ই সে পারে না। মায়ের কাছে যখন ছিলো তখন এসব কিছুই খেয়াল করে নি।শুধু ঘর গুছানোর কাজটা করলেই মা খুশি ছিলো। সময় মতো এসে খাবার টেবিলে বসেছে, মা রেঁধে বেড়ে দিয়েছে, আর কেকা আরাম করে খেয়ে উঠে গেছে। মা অসুস্থ হলে বড়োজোর সকালে নাস্তা আর ভাত ডাল ডিম ভুনা,নয়তো মুরগি রেধেছে। পড়াশোনা করেই দিন কাটিয়েছে। অথচ মাকে কখনও এই নিয়ে রাগারাগি করতে দেখেনি। খুব ভোরে ঘুম না ভাঙ্গতেই আধো ঘুমে যখন তাওয়ায় মায়ের রুটি সেকার মিষ্টি গন্ধটা নাকে এসে লাগতো, সারাটা ঘর সেই মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করতো। প্রতিটি সকাল তখন কেকার কাছে সুন্দর হয়ে উঠতো, আনন্দে ঝলমল করে উঠতো চারদিক। আর এখন রাতে ঘুমতে গেলে মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘোরে , এই বুঝি সকাল হলো,এই বুঝি দেরী হয়ে গেলো। রুদ্রর জন্য রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় না, তাই সকালে ঘুম ভাঙ্গতে কেকার বেশ কষ্ট হয়। প্রতিটি রাত এখন তার কাটে আতংকে, সকাল হওয়ার ভয়ে।
আসলেই সংসার খুব কঠিন জায়গা । মা হওয়াটা আরও কঠিন।
কেকার কাছে কাজ গুলো বেশ কঠিন লাগে তবুও কেকা চেষ্টা করে সব কিছু শিখে নিতে। কিন্তু যে ত্রিশ বছর ধরে সংসার সামলে আসছে তার সাথে কী কেকার মতো আনাড়ির কাজের তুলনা হয়? কিন্তু তুলনা হয়, ভুল গুলো তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়, কেকাদের চেষ্টা গুলো সেখানে অর্থহীন। সকালে উঠেই সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে, সবাইকে খাইয়ে বিদায় করে, নিজে কোন মতে খেয়ে উঠতে না উঠতেই বাজার এসে হাজির, এদিকে রুদ্রকে নিয়ে সহজে কাজ আগানোও যায় না। তার উপর এই আজব মাছ! কেকা ভয়ে ভয়ে মাছ রাধে,অসুস্থ মায়া বেগমের শখ হয়েছে এই মাছের ভুনা খাবেন। দুপুরের খাবার গুলো রান্না শেষ করে মায়া বেগমের জন্য টিফিনের বাটিতে সুন্দর করে ভরে হাসপাতালের জন্য প্রস্তুত করে দেয় কেকা। মায়া বেগম হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।

মাস খানেক পর কেকাদের বিবাহ বার্ষিকী। আজ তাই খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কেকা রুটি বানাতে যায়। কাজ গুলো যদি সকাল সকাল করে রাখা যায় তাহলে বিকেলের দিকে সজলের সাথে ঘুরতে যাবে এই আশায়। শোবার ঘর থেকে সজল জোরে ডাকে – কেকা এই দিকে আসো তো রুদ্র বমি করেছে। কেকা বলে – তুমি একটু দেখ, আমি আসছি হাতের কাজটা শেষ করে। কেকা উঠে যাওয়ার আগেই মায়া বেগম ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসেন।কেকার উঠে যেতে দেরী হওয়াতে রুদ্র তাড়া দেয় – তাড়াতাড়ি আসো না। মায়া বেগম এবার চিৎকার শুরু করেন- এত কী কাজ করো, এখনও আসো না? ফজরের ওয়াক্তে উঠেই তুমি রুটি বানাইতে গেলা কী জন্য? বলি আক্কেল বলতে কী তোমার কিছু নাই।

কেকা চুপ করে রুদ্রকে পরিষ্কার করে দিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেয়। কেকা জানে তাড়াতাড়ি কাজ করলেও বকা শুনতে হয়, দেরী হলেও বকা শুনতে হয়, এটাই এখন প্রতিদিনের নিয়ম। অথচ কেউ ভাবে না, ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে বিশ পচিশটা রুটি বেলে, সাথে ভাজি করে ওঠা কেকার মতো আনাড়ি মানুষের জন্য খুবই কঠিন। জলদি করলেও সে বকা খায়, দেরী হলেও বকা খায়।
আজ সাত সকালেই মায়া বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে, সারাদিন তিনি গজর গজর করেই কাটান। বিকেলে সজলের সাথে ঘুরতে যায় কেকা। সন্ধ্যাটা ঘুরে বেড়িয়ে রাতে সজল কেকাকে নিয়ে চাইনিজ খেতে যায়, ফেরার সময় ঘরের সবার জন্যও খাবার নিয়ে আসে।
সেই খাবার দেখে মায়া বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন – হ, আমার পোালরে লইয়া বাইরে বাইরে মজার মজার খাবার খাইয়া বেড়াইবা, আমি এই খাবার কিছুতেই খামু না, কিছুতেই খামু না।
মায়া বেগমের এই আচরণে ঘরের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যায়। রফিক সাহেব আর রিপন খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলেও মায়া বেগম কিছুতেই সেই খাবার মুখে তোলেন না।

বছর ঘুরে এলো রুদ্রের জন্মদিন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হলো। আত্মীয় স্বজন পরিচিত জনদের নিয়ে বেশ ঘটা করেই রুদ্র প্রথম জন্মদিন পালন করা হলো, বেলুন সাজাতে গিয়ে কেকা মায়া বেগমের হাতের কাজ করা ওয়াল মেটটা সরিয়ে আপাতত অন্য রুমে রেখে আসে। সেই খবর মায়া বেগমের কানে পৌঁছতেই তিনি এসে কেকার সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বললেন – কেকা, ড্রয়িংরুম থেকে ওয়াল ম্যাট সরাইছে কে?

-মা আমি সরিয়েছি।

-কেন সরাইলা?

কেকা মায়া বেগমকে বোঝানোর চেষ্টা করে – মা, এটা তো আপাতত আজকের জন্য সরিয়ে রেখেছি, কাল আবার জায়গা মতো এনে রাখবো। মায়া বেগম গলার স্বর সম্তমে তুলে বললেন – তুমি ইচ্ছা কইরা এইটা সরাইছো, হ্যা। তোমার বেলুনের চেয়ে কি আমার ওয়াল ম্যাট কম সুন্দর? নিজের ঘরে চলে গিয়ে খাটের উপর বসে বসে মায়া বেগম গজর গজর করতে লাগলেন। এরপর যে অতিথিই আসেন মায়া বেগম তার কাছে সবিস্তরে ঘটনা বর্ণনা করেন, কেকার মা বাবা আত্মীয় স্বজনদের এই নিয়ে কটু কথা শোনাতে ছাড়েন না ।অতিথিরা চলে যাওয়ার পর এবার ভিন্ন আঙ্গিকে আক্রমন করেন তিনি -এতগুলান টাকা খরচ করে জন্মদিন পালন করোন লাগে? এই সব বুদ্ধি হইলো কেকার, কেকার কথা শুইনন্নাই সজল এত কিছু করছে। এই মাইয়া এই সংসার লাটে তুলবো।

শিপার মেয়েরও জন্মদিন আসে, মায়া বেগমের তখন আনন্দ আর ধরে না, স্বর্নের কানের দুল বানিয়ে তিনি রওনা হন মেয়ের ঘরের নাতনীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে।

-শামীমা হক ঝর্ণা



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *