রূপকার

কখনো কখনো কিছু শোক আমরা আমাদের ভেতরে রেখে দেই, জমিয়ে রাখি খুব আলগোছে। সেখানে মায়া থাকে, স্মৃতি থাকে, থাকে কিছু গল্পের মতো প্রিয় সব মুহূর্ত। মানুষ ভীষণ ভঙুর বলেই আমাদের টিকে থাকা অসীম নয়৷ বরং সীমিত। এই যে টিকে থাকা, তার ও তো শেষ আছে, সমাধির গায়ে প্রতিটা অধ্যায়েরই নাম লেখা হয়, পৃথিবী ঠিক এমনই গোছানো। আমি বা আমরা সে গোছানো সময়ের একেকটা অস্তিত্ব মাত্র, যে অস্তিত্বে আমরা অনেক সময় পর পর ঠিক বিলীন হই।

নগর বলেই হয়তো চির বিষাদের অভিশাপ গায়ে মাখায় না ল্যাম্পপোস্ট, আজো আঁধার ঘনাতেই তারা একযোগে জ্বলে ওঠে, কোথাও শূন্যতার মতো কিছু কিছু আলোয় মরচে ধরে, ব্যথাতুর মলিনতায় ওদিকটা আলোকিত হয় না, আমি সবকিছুই দেখছিলাম। আজ আফ্রোদিতির ছায়া জলছাপ মাখায়নি আমার জীর্ণ কার্নিশে, ভেজা কাকটাও ক্রোনাসের রূপ ধরে আমার জানালায় জন্মান্ধ সভ্যতার নতুন নামকরণ করেনি, সব যেন এক স্থির চিত্রের মতো, স্থির দৃশ্যপটে সাজানো সাঁজোয়া গল্পের মতো। এখানে বড় বেশী অস্থির প্রাগৈতিহাসিক ক্রন্দনগুলো, ল্যুভরের অতি যত্নে বোনা মোনালিসার হাসিটাও নিভে আছে কৃত্রিম সব আলোর উৎসবে। সম্ভবত আমার মনে নেই, আমি কবে কখন কোথায় নিজেকে হারিয়েছি, প্রতিবার আবার কোথায় খুঁজেছি, আমার কোনো ধারণা নেই এইসব প্রতিলিপির আকারের শব্দ গুচ্ছ নতুন মেটামরফোসিস শব্দার্থে ফুটে উঠবে কি না। সে উৎসাহের অবাস্তবতায় আমি প্রতিবার মলিন হই নিজের সাথে। ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে, আজ তবুও ছায়া দিন নয়, আজ কোনো সূর্যগ্রস্ত দিন নয়।

আজ তামাটে রঙা দিন ছিলো, মায়া বাড়ছিলো তাদের সাথে। অসংখ্য অলস দুপুর কতো ভিন্ন ভাবেই হারাতে থাকলো, আমি গুনিনি আর, এইসব জানা অজানার গুনিন আমার ভেতরটাকে ঠিক দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো বহুকাল আগেই। শেষ কবে কোথায় আমি ঘুড়ি উড়িয়েছি মনে করতে পারছিনা, আমি পারছিনা আমার কাছে পড়ে থাকা আয়নাটায় নিজের উহ্য হয়ে যাওয়া দেহের ভেতর নিজেকেই আবার খুঁজে নিতে। এটা যেন ইল্যুশন, যেন মোজার্টের অরক্ষিত হৃদপিণ্ড আমার শূন্য ঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রেলিং ধরে ধরে সপ্তাহের শেষ বেলার কথা মনে পড়লো, সেদিন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি অবশ্য, শুধু আমি বুড়ো সময়কে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম সূর্যগ্রস্ত দিনে। একান্ত আপন সময়ের এটুকুই ছিলো নিজেকে চেনার, নিজেও হেঁটেছি চেনা পথের অচেনা ভিড়ে। আজ আর ছায়াপথ নেই কাছে, পিছুটানের মাসকাবারি রাতগুলোও মিলিয়ে গেছে, যেন জ্যামিতির পরম কোনো শূন্য কোণে লুকিয়েছে সব- সবাই, অথবা কেউ না। আমি আবার চমকে তাকালাম, নিজের নিজেকে চেনা মনে হচ্ছেনা, অচেনাও মনে হচ্ছেনা, কিছুই মনে হচ্ছেনা। একটা ফিউনারেল মুহূর্ত ঘাসফড়িঙ হয়ে মিশে যাচ্ছে আমার বইগুলোতে- যে বইতে আছে মার্ক্স, টলস্টয় আর ডিকেন্সরা। তাদের কফিনে আজো সাদা গোলাপ শুভ্রতা ছড়ায়, অথচ মাটির ঘর কি ভীষণ অন্ধকার…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *