-এই যে শুনছেন?
-আমাকে বলছেন?
-জ্বি আপনাকেই বলছি। আপনার নামটা জানতে পারি?
-হুম সেটা অবশ্যই জানতে পারেন। কিন্তু আপনাকে নামটা আমি কেন বলব সেটা একটা প্রশ্ন।
-জানতে চেয়েছি সেজন্য বলবেন।
-আমি তো অপরিচিত কাউকে আমার নাম বলি না। পরিচিত হলেও বলি না। কারণ পরিচিতরা সবাই আমার নাম জানে।
-আমাকে আপনি অপরিচিত বলছেন কেন?
-আপনি কি আমার পরিচিত?
-অবশ্যই পরিচিত।
-তাহলে আমার নামও নিশ্চয়ই জানেন।
-হুম জানি বৈ কি। তবে আপনার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম।
-দু:খিত, আপনার চাওয়া আমি পূরণ করতে পারলাম না।
-ঠিক আছে। বাদ দিন। চলুন আমার সাথে।
-কোথায়?
-ওই ফুলের দোকানে।
-কেন?
-আপনাকে কয়েক গোছা ফুল কিনে দেব। আপনি সেই ফুল খোঁপায় গুজে ঘুরবেন। চাইলে বাসায় নিয়ে ফ্লাওয়ারভাসেও রাখতে পারেন।
-আমি আপনার ফুল নিতে যাব কোন দু:খে?
-দু:খে পড়ে কেউ ফুল নেয় না। ফুল নেয় সুখে। যারা শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানর জন্য ফুল নেয়, সেটাও আপাতদৃষ্টে দু:খের ঘটনা মনে হলেও ঘটনা আসলে সুখের। শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রাপ্য যার এমন লোককে শ্রদ্ধা করার মধ্যেও এক ধরণের সুখ আছে।
-কথা তো ভালই বলেন দেখি। এইভাবে রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করেন কেন?
-আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
-না! খুব খুশি হচ্ছি! চিনি না জানি না এমন একজন আমাকে জোড় করে ফুল দিতে চাইছে এতে খুশিতে আমি একেবারে ডগমগ!
-আবারও চিনি না জানি না বললেন? মনে কষ্ট পেলাম কিন্তু!
-একটু আধটু কষ্ট পেলে মন শক্ত হয়। মনটা শক্ত করেন। এবার আমার সামনে থেকে ভাগেন। অন্য কারো কাছে যান। গিয়ে বলুন আপনাকে আমার তো খুব চেনাচেনা মনে হচ্ছে। চলুন ওই ফুলের দোকানে। আপনাকে এক বস্তা ফুল কিনে দিব। ফুলের বস্তা মাথায় নিয়ে হাঁটবেন।
বেলা চরম বিরক্তি নিয়ে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। কয়েক কদম নির্বিঘ্নেই গেল সে। হঠাৎ কি যেন মনে হতে লাগল তার। মনের মধ্যে অস্পষ্ট একটা ছবি ক্রমেই স্পষ্ট হতে লাগল। ধীরে ধীরে, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর!
একটা পরিপূর্ণ মানুষের ছবি চাইলেও মন থেকে এই মুহূর্তে দূর করতে পারছে না বেলা। যে ছবি তার মনের ক্যানভাসে ধরা পড়েছিল বছর পনের আগে। বেলা তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী।
বেলারা তখন নাটোরে থাকত। বেলার বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ায় নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা কার্যালের সরকারি কোয়ার্টারে কেটেছিল কিছুকাল তাদের। ছেলেটার সাথে তখনই পরিচয় বেলার।
শুধু পরিচয়ই নয়। আরো অনেক কিছু। এক কথায় বেলার বেলা অবেলা সব সময়ের ভাবনাজুড়ে ছিল ছেলেটা। বেলাও ছিল তার কাছে একই রকম। মুহূর্তেই হাজার কথা মনের মধ্যে উথাল পাথাল করতে লাগল বেলার। সেই সব সময়, সেই নীল খাম চিঠি, চিঠির ভেতর শুকনো গোলাপের পাঁপড়ী, লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটের ছাপ, কয়েকটা কাঁঠাল চাঁপা আর একটা রক্তাক্ত রুমাল! সব চোখের সামনে নাচানাচি করতে লাগল বেলার। না না এ হবার নয়। মাঝখানে পনেরটা বছর।
বেলার বাবার হঠাৎ চাকরী বদলী এবং ঢাকায় চলে আসা। ছেলেটার সাথে কোন ক্রমেই আর যোগাযোগ করতে পারেনি বেলা। উপজেলার ঠিকানা বরাবর অনেকবার চিঠিপত্র দিয়েছে। কোন জবাব আসেনি। কোন ফোনও আসে নি কোনদিন। অবশ্য ফোন আসার কোন কারণও ছিল না। বেলাদের ঢাকার ঠিকানা ছেলেটার জানবার উপায় ছিল না কোনকালে।
বেলা ওকে এতক্ষণ চিনতে পারেনি? ভেতরটা কেমন করতে লাগল তার। আবার সেই ছেলেটার মুখোমুখি হবে নাকি বাসায় চলে যাবে এইসব ভাবতে ভাবতে একটু আগে কথা বলার জায়গাটায় ফিরে এলো বেলা। ছেলেটা নেই। বেলার চোখ গেল পাশের ফুলের দোকানে। ছেলেটা ফুল কিনছে।
একটু এগিয়ে গিয়ে বেলা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ডাকল পেছন থেকে- সমুদ্র!
সমুদ্র পেছন ফিরে তাকাল। হাসিহাসি মুখ। হাতে দশাসই এক গোছা ফুল। হাসিমুখ আরো প্রস্ফুটিত করে সমুদ্র বলল- জানতাম আসবে। তাই ফুল কিনে ফেললাম।
বেলার হতবিহ্বল চেহারায় তখন ডুবে যাওয়া সূর্যের অন্ধকার। সে কি বলবে, কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাকিয়ে আছে অপলক, বিনম্র চোখে।
সমুদ্র জিজ্ঞেস করল-এখন কি চিনতে পেরেছ?
বেলা কিছু বলল না। বার কয়েক অস্ফুট স্বরে সমুদ্র সমুদ্র বলেই ক্ষান্ত হলো। সমুদ্র বেলার হাত ধরে পথের ধারে একটা বেঞ্চের ওপর এনে বসাল। তারপর মুখোমুখি বসে নিশ্চুপ কাটলো তাদের বেশ খানিকটা সময়! চোখে চোখে যদি কথা হয়, তো মুখের কথার দরকার কী? কিছু মুহূর্ত থেমে থাকলেই বরং ভালো লাগে। কোন কথা নয়, নড়াচড়া নয়, কেবল চুপচাপ মুখোমুখি কিছুটা সময়। দু’টো চোখ চোখে রেখে চেয়ে থাকা শুধু ।
হঠাৎ বেলার মনে হল তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। ছোটনকে স্কুল থেকে তুলে নিতে হবে ফেরার পথে।
-রবিউল করিম মৃদুল