সেই মেয়েটি

নয়তলা বিল্ডিয়ের কার্ণিশে একটা চড়ুই
পাখির ভাঙ্গা বাসার পাশ দিয়ে চিরিৎ চিরিৎ করা দুর্বল বিদ্যুৎ সংযোগের লাইন বরাবর ১৫টা খাম্বা পার হলে একটি ট্রান্সফর্মার।

ট্রান্সফর্মারের কালো তেল যেদিকে টুপটাপ পড়ছে তার বিপরীত দিকে বসা একটি কাকের দুই পায়ের মাঝ বরাবর দূরে আছে একটি খোলা জানালা।

জানালা ওপাশে নতুন একটি ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় রয়েছে স্নানের পূর্বে তুলে রাখা নব বধূর কপালের একটি লাল টিপ!

সেই লাল টিপ আর লাল সূর্য একে অন্যকে হিংসায় রক্তিম বর্ণ ধারণে যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে বাচ্চা সমেত কিচির মিচির করা কিছু পাখি যেদিকে উড়ে দিগন্তের সাথে মিশে যায়, সেদিকে আছে যুবতী কন্যার গালের টোল প’রা সৌন্দর্যের মতন অপরূপ একটি জলাধার।

জলাধারের পাশে লম্বা একটি তাল গাছে বাবুই দম্পতির ঝুলন্ত বাসায় খাদ্যের জন্য অপেক্ষারত বাচ্চা পাখিগুলো হা করে যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে একটু এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে বাতাসে নুইয়ে পড়া ধানক্ষেত।

নুইয়ে পড়া ধান ক্ষেতের শীষ যেদিকে সেজদা দিয়েছে তার বিপরীত দিকের জমির আইল ধরে কদম বিশেক এগোলেই পাওয়া যাবে ফাঁদ পেতে মাছ ধরার জন্য তোল্লা বাঁশের তৈরি সরু দাড়কি।

জলে ডোবা দাড়কির সামনের জলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা বেলে মাছ আর ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ করা চিংড়ী পুটির লেজ যে দিকে, সেদিকে প্রাথমিক স্কুল না পেরোনো নেংটি মারা একটি কৃষ্ণ বর্ণের বালক তার বাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, এক হাতে জগ আর অন্যহাতে গরম ভাতের বাটি নিয়ে।

গরম ভাতের সে ঢাকনাওয়ালা বাটির ভেতর থেকে বেরোনো ভাপ : বৃদ্ধের লাগানো বিড়ির ধোঁয়ার মতন যেদিকে উড়ে যায় ; সেদিকে অল্প বিস্তর এগোতেই একটি বাজার !

এ বাজারের সওদাগর,ক্রেতা : সবুজ মাঠের ওপাশেই পৃথিবী নেমেছে , এমন ভাবনারত দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপিয়ে ওঠা একদল বালক- বালিকা।

বাজারে বালকদের কেউ পেঁপে গাছের নল দিয়ে জমিতে পানি দেবার মেশিন বানিয়েছে। কেউবা গাছের মগডালের মিষ্ট ফল, ঝোপঝাড়ের লাল হলুদ ফুল, ফল ইত্যকার জিনিস দিয়ে দোকান দিয়েছে। সে বালকদের দোকানে, বালিকারা কাঠাল পাতার টাকা দিয়ে টুকটাক জিনিস কিনছে ঠিক বালিকার মায়েরা যেমন করে বাড়ির উপর জিনিস কেনে।

আসল বাজারের ন্যায় দর কষা কষিরত ক্রেতা- বিক্রেতার এই দৃশ্যের মাঝে কোথা থেকে ঝড়ের মতন এসে দুষ্ট একটি বালক দোকান আর বালিকাদের মাটিতে তৈরি সংসার যজ্ঞ তছনছ করে পালিয়ে যেদিকে যায় সেদিকে : কানের পাশের চুল ঘামে ভিঁজে, তা গাল বেয়ে থুতনিতে এসে পর্ পর্ পড়ন্ত হতে যে সময় লাগে : সে সময়টুকুর পথ এগিয়ে নিজের ছায়ার ডান দিকে রয়েছে সবুজ চাদরে ঘেরা একটি গ্রাম।

গ্রামের প্রথম বাড়ির উঠোনে ধান মাড়াই শেষ করে ক্লান্ত দুইটি গরুর জাবর কাটার অলস সময়ে : কানে বাচ্চাদের হাসাহাসি যে খোলা ঘর থেকে আসে সেদিকে এগোলেই দেখা মিলবে বাচ্চাদের ঈশপের ফেবলস অনুবাদ করে পড়ে শোনানো পরিপাটি করে চুলবাঁধা, কাজল দেয়া শ্যাম বর্ণের সুউচ্চ মেয়েটিকে।

আমি প্রতিদিন সেই মেয়েটিকে দেখি সহস্র মাইল দূরের ইটপাথরের এ জীবন বিহীন নগরীর কোন এক সুউচ্চ ভবনের দেড় ফিট বাই তিনফিটের বেলকুনি থেকে !

-খাইরুল ইসলাম নিয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *