হাত

১.

প্রফেসর আনিসুল হক বললেন, কী নাম আপনার?

সীমান্ত।

বয়স?

চল্লিশ।

ভ্রু কুঁচকে বললেন কীভাবে সম্ভব? পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বললেন হতেই পারে, হতেই পারে।

বলুন কী সমস্যা?

দুই সপ্তাহ যাবৎ এমনটা হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে কে যেন দুই হাত দিয়ে আমাকে গলা টিপে ধরছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আর কেউ নয়, সেই হাত দুটো আমারই। মানে আমার হাত আমাকেই গলা টিপে মারতে চাচ্ছে।

তারপর?

তারপর হাত দুটো আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসে। ছেড়ে দেয়।

আপনি কী করেন? মানে পেশা?

আমি তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করি।

সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে থাকা হয়? মানে একই কাজ অনেক সময় ধরে করেন?

অনেকটা সেরকমই।

আপনার হাত দুটো দেখি?

প্রফেসর সাহেব হাত দুটো ভালো করে দেখলেন। পাশের ট্রে থেকে ছোট একটা হাতুড়ি নিলেন। আমার কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত হাতুড়ি দিয়ে ছোট ছোট বাড়ি দিতে থাকলেন। বললেন যখন ঝিমঝিম লাগবে আমাকে বলবেন।

এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রেসক্রিপশনে দুর্বোধ্য কী যেন লিখলেন। বললেন এগুলো টেস্ট করে নিয়ে আসেন।

আমি বাইরে এসে প্রফেসরের এসিস্ট্যান্টকে ফি পরিশোধ করে তার নির্দেশ মতো হাসপাতালের ছয়তলায় গেলাম টেস্ট করাতে। কাউন্টারে থাকা লোকটি বলল আজ টাকা পরিশোধ করে আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টায় আসতে হবে টেস্টের জন্য।

কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার হাত লোকটির গালে একটি চড় মেরে বসলো। অথচ এই ঘটনায় আমার নিজের কোনো কন্ট্রোল ছিল না। এই অত্যাচারী হাত আমার নয়।

২.
অনিতা আজকাল অনেক রাত করে বাসায় ফিরে। অথচ অফিস ছুটি হয় সাড়ে চারটায়।

একটি প্রাইভেট কার এসে নিচের রাস্তায় থামলো। অনিতা নামছে। সে হাসছে। সে খুব সুন্দর করে হাসতে পারে। একদিন তার হাসি শুনেই শিরদাঁড়া দিয়ে কী যেন বয়ে গিয়েছিল আমার। কিন্তু এখন ছয়তলার বারান্দায় বসে সেই মন কেমন করা হাসি আজ বিষের মতো শোনাচ্ছে।

অনিতা বাসায় ঢুকলে আমি বুদ্ধদেব বসুর রাতভর বৃষ্টি সামনে মেলে ধরি। অভিমান বা অন্য কিছু জেঁকে বসে।

একসময় পুটপুট করে কতো কথা হতো আমাদের। কতো মেসেজ! আর আজকাল প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা নেই। যেন কথা বেশি বললে আয়ু কমে যাবার ভয়। মেসেজও আসে আজকাল আলু, পটল, ঝিঙ্গা, আটা, ময়দা, সুজি টাইপের।

তবে হ্যাঁ কথা বলিনা বলিনা করেও মাঝে মাঝে অনেক কথা বলা হয়ে যায়। সেটা বেশ জোরেই শোনা যায়। চট করে কেউ শুনলে বুঝে নিবে কলহ। আমার এইসব পছন্দ না। তাই কথা আস্তে কিংবা জোরে কোনোটাই বলি না। বলতে চাই না।

আমাদের বিয়ে হয়েছে ১১ বছর। অথচ প্রাপ্তির খাতা শূন্য। অপেক্ষায় অপেক্ষায় কিভাবে এতগুলো দিন চলে গেল। ভাবা যায় না।এখন আর অপেক্ষা করি না। জানি সে আসবে না। টুইটুম্বুর ভালোবাসায়ই যখন আসেনি আর এখন তো খসখসে রজনী!

আমরা প্রায় কথাহীন রাত্রি যাপন করি। তবে মনে মনে অনেক কথা বলি। নিজের সাথে। হয়তো অনিতাও বলে। আসলে মানুষের চুপ থাকাতেই ভেতরের কথারা পুটপুট করে। হয়তো সবারই করে।

তবে আমরা একই বিছানায় শুই। হয়তো অনেকদিনের অভ্যাস। তবে আমি বুঝতে পারি আমার আর অনিতার মাঝখানে কেউ শুয়ে থাকে সারারাত। হয়তো অনিতার পিঠের লাল তিলগুলো গুনে গুনে জড়ো করে সে। ফিসফিস কথাও বলতে পারে। আমি ঘুমের ভান করতে করতে ঘুমিয়ে যাই। শেষ রাতে ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গেলে কে যেন গায়ে চাদর জড়িয়ে দেয়। টের পাই। ভালো লাগে। তবে সেটাও হয়তো অনেকদিনের অভ্যাস।

সকালে আমার আগেই অনিতা ঘুম থেকে ওঠে। ঠিক সাতটা বাজলে ঘরের লাইটটি জ্বালিয়ে দেয়। যাতে আমার ঘুম ভাঙ্গে। এটা হলো কথাহীন ঘুম থেকে আলতো করে ডেকে দেয়া। যাতে ভালোবাসাও নেই, আবার ঘৃণাও নেই। কিন্তু আজ এমন কিছুই ঘটল না। আমি একটু মটকা মেরে শুয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর ওঠে বসলাম।

অনিতা এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম অনিতার এই ঘুম বেশ গভীর। হয়তো আর ওঠার নয়। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দুই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তবে কি!!! না না এই নিষ্ঠুর, নির্দয় হাত আমার নয়!!!

-জামান একুশে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *