হাসি

পুকুরের পশ্চিম কোণ থেকে মল্লিকাদের রুমের জানালাটায় না চাইতেই চোখ চলে যাওয়াটা যেন নেশায় পরিবর্তন হয়ে গেছে আজকাল। এই তো সেদিনও এ জানালাটার প্রতি কোন কিওরিসিটি ছিল না এমনকি ঐ বাড়িতে কে থাকে না থাকে সে বিষয়ে কোন মাথা ব্যথাও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার মাইগ্রেনের সমস্যার সাথে বাড়তি সমস্যা হয়ে ঐ জানালা নিয়ে মাথা ব্যথা যোগ হয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারায় এখন আষাঢ় মাসেও চৈত্রের তাপদাহ আর গ্রীষ্মের ন্যায় প্রখর রোদ, তার উপরে লোড শেডিং। বাবার তৈরি ছাদ দেয়া একতলা বিল্ডিং এ টিকে থাকা দায় হয়েছিল এক ভরদুপুরে। বাহিরে তাকিয়ে পরখ করে নিলাম গাছের পাতা নড়ছে কি না, নাহ্ গাছের পাতাগুলোও যেন সেদিন মজা দেখানোর সুযোগ পেয়েছিল।তবুও গোবিন্দদের বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে যে বাঁশের চাঙ্গারী টা বাঁধা আছে, সেখানে বসলে গায়ে একটু হাওয়া লাগবে ভেবে গামছাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে পুকুর পাড়ে আম গাছের তলায় ওই চাঙ্গারীতে গিয়ে বসেছিলাম।
মোবাইলে ফেইসবুকিং করছি ভার্সিটির বান্ধবীদের সাথে । ফৌজিয়া, আমার বান্ধবী, নাম্বার ওয়ান শয়তান মেয়ে একটা এবং নাছোড়বান্দা।
যেই শুনেছে আমি খালি গায়ে পুকুরপাড়ে বসে হাওয়া খাচ্ছি, অমনি সে বায়না ধরেছে তাকে সেলফি দেয়ার এবং দিতেই হবে। অগত্যা গামছা গায়ে জড়িয়েই একটা সেলফি তুলতে উদ্যত হলাম যদিও আমি জানি এ গামছা গায়ে সেলফিটা পাওয়া মাত্রই এ পাজিনী আমার ছবি নিয়ে ট্রল করা শুরু করবে,বন্ধু গ্রুপে আপলোড করবে আর সবাই আমাকে নিয়ে হাহা হিহি করবে।
তবুও যতটুকু পারি আমার সম্ভ্রম রক্ষা করে মোবাইলটা উঁচিয়ে হাসি হাসি মুড নিয়ে যেই না সেলফিটায় ক্লিক করতে যাচ্ছি,ঠিক তখনই এ ভরদুপুরে পেত্নির মত মল্লিকাদের বাড়ির ঐ জানালাটা থেকে কে যেন পরিহাসের সুরে হেসে উঠেছিল।
ভরদুপুরে কোন পেত্নি হাসছে ভেবে আমি ভুল করে ফেলেছিলাম তবে হাসিটা যে আমাকে ব্যঙ্গ করে তা বুঝতে কিন্তু বাকি রইলো না আমার। কিন্তু কে ও? মল্লিকার তো এত বড় স্পর্ধা নয়! আমাকে নিয়ে হাসবে তো দূরের কথা আমার সামনে আসলে মল্লিকা মুখ তুলে কথাই বলেনা! কতদিন বলেছি তুই আমার সামনে আসলে এমন করে মাথা নিচু করে রাখিস কেন? মেয়েটা লাজুক সেটা ঠিক কিন্তু এতটাও ভাল না।
ছোটবেলা থেকে ওকে দেখছি, পুকুরের এপাড় ওপাড় আমাদের বাড়ি, যদিও কোন নিকট আত্মীয় না শুধুমাত্র প্রতিবেশি আমরা। তবুও আমার প্রেজেন্সে তার
লাজুকতা।
সেলফিটায় ক্লিকটা আর দেই নাই , ঐদিকে সেলফি দিইনি বলে ফৌজি আমার সাথে রাগে গজগজ করে অফলাইনে চলে গেল। আমি বারবার চেষ্টা করছিলাম ঐ জানালার পর্দার আড়ালে কে আছে জানার?? পর্দার আড়াল থেকে উচ্চস্বরে হাসে। সে কি আমাকে দেখে হাসে? তারপর থেকে প্রতিদিন আমি এখানটায় এসে বসি ঐ মিষ্টি হাসিটা শোনার জন্য। কে হাসে এভাবে? আমাকে জানতেই হবে।
রমজানের ছুটিতে ক্যাম্পাস বন্ধ প্রায় দুই মাসের জন্য তাই হল ছেড়ে যে যার বাড়িতে চলে এসেছি। বাড়িতেও বেশ ভাল সময়ই কাটছে টিভি,সাইক্লিং আর ফেইসবুকিং করে করে। এরই মাঝে সন্ধ্যায় সুবীর কাকু এসে দিদির কাছে আমার সন্ধান করছে। সুবীর কাকা হল মল্লিকার বাবা। সরাসরি কাকু আমার রুমে এসে বসলেন। কৌতুহল জাগছে আমার, উনি আমাকে খুঁজেই কেন আসবেন!
শুধু ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট বলে না বরাবরই এলাকায় ভাল ছাত্র হিসেবে আমার অনেক কদর ছিল এবং আছে। সুবীর কাকু সে সূত্র ধরেই আমার কাছে এসেছে মল্লিকাকে যেন যে কয়দিন বাড়িতে আছি সে কয়দিন সময় করে ইংরেজিটা বুঝিয়ে দেই। ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও বাহিরে না পড়ানোর সুযোগ রইলো না কেননা এলাকায় যে ভাল স্টুডেন্ট আমি বরাবরেরই! জেএসসি,এসএসসিতে, এইচ এসসি তে গোল্ডেন প্লাস পাওয়া ছাত্র আমি তাই সবার কাছে ভালবাসা আর প্রসংশা একটু বেশিই পাই, রাগ দেখিয়ে কিংবা অনীহা দেখালে আমার ইমেজ ডেমেজ করে কোন বিশেষ লাভ নেই।কাকু যখন ধরেছে তখন পড়াতেই হবে।
আজ সন্ধ্যায় মল্লিকাকে পড়াতে যেতে হবে আমার যদিও পড়াতে যাওয়ার জন্য কোন ইচ্ছাশক্তিই কাজ করছে না তবুও পিতৃসমতুল্য কাকুর আবদার রাখতে আমাকে যেতেই হবে। এলাকার কয়েকটা বন্ধুর সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছিলাম, পুকুরপাড়টায় আসতে না আসতেই সেই মন ভুলানো হাসি। কে হাসে এমন করে? মল্লিকাদের বাড়িতে গেলেই তো সমাধান হয়ে যাবে!
ড্রয়িং রুমের টি টেবিলে বসে মল্লিকাকে পড়াচ্ছি, মল্লিকার সেই চিরাচরিত মাথা নিচুতার অভ্যেস আজও বিদ্যমান। তার চোখ আমি সহজে দেখি না।
গ্রামারে মল্লিকার সমস্যার দিকগুলোই আমি দেখবো যেহেতু সময় কম আমার হাতে। তাই নেরেশন পড়াতে শুরু করলাম প্রথমদিনই। পড়াতে পড়াতে বারবার তাদের ভেতরের রুমের দিকে নজর যাচ্ছিল কিন্তু না এমন কাউকে তো দেখা যাচ্ছেনা! তাহলে হাসে টা কে?
এভাবে মল্লিকাকে পড়ানোর পঁচিশতম দিন পার হল। সুবীর কাকু হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল। ভিতরে যে টাকা আছে তা ওজনেই বুঝতে পেরেছি। খামটা সেখানে আর খুলে দেখিনি। এ পঁচিশদিনের ব্যবধানে লক্ষ্য করলাম মল্লিকা আমাকে দাদা ডাক পাল্টে স্যার ডাকা শুরু করেছে, আজকাল দুএকটা কথাও বলে,মুখ তুলে তাকায় সে !
তার সাথে প্রতিদিন চলে জানালার পর্দার আড়ালের সেই হাসি।
সুবীর কাকুর দেয়া খামটা খুলে দেখলাম আমার পড়ানোর সম্মানী হিসেবে দুই হাজার টাকা দিয়েছেন উনি যদিও এ মফস্বল এলাকাতে দুই হাজার টাকার টিউশন অনেক বিরল। মফস্বল এলাকাগুলো লোড শেডিং এর যন্ত্রণা যে কতটা ভোগ করে তা আসি বাড়ি আসলে হাড়ে হাড়ে টের পাই। প্রচন্ড গরম তাই টাকার খামটা ওয়ালেটে ঢুকিয়ে সেই পুকুরপাড়টায় এসে বসলাম, সাথে পাশের বাড়ির চন্দনও আছে। খেয়াল করে দেখলাম ঐ জানালা থেকে কে যেন আমাদের দেখছে। একটা পূর্ণ অবয়ব  বোঝা   যাচ্ছে, আধো আলো আধো ছায় রুমটাতে। রুমের ভিতরে জ্বলা লাল ডীম লাইটে ওই জানালায় কে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না স্পষ্ট করে। তবে কেউ একটা যে আছে সেটা স্পষ্ট।
মল্লিকাকে পড়ানোর ফঁকে বারবার ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি ওদের বাসায় কেউ বেড়াতে এসেছে কি না? আবার ভাবি কেউ আসলে তো অবশ্যই এদিনগুলোতে আমার সামনে পড়তো একবার হলেও! তাহলে কে এভাবে হাসে? এ হাসি তো আমার চেনা নয়, আগে কোথাও শুনিনি!
মল্লিকাকে পড়াতে পড়াতে ভেতরের রুমে স্থির দৃষ্টে চেয়ে থাকি, সবার গতিবিধি লক্ষ্য করি কিন্তু নতুনত্ব কিছু তো পাই না।
— মলি,তোরা বাসায় কি কেউ বেড়াতে এসেছে?
মলি প্রশ্নটা পাশ কেটে গিয়ে ভয়েজ চেঞ্জের একটা সমস্যা সামনে তুলে ধরেছে। আজও জানা হল না সেই হাসি,আর ছায়ামানবীর রহস্য।
আমিও বিকাল সন্ধ্যা সময় করে ওই জানালায় চোখ রাখছি আর কান পেতে হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু ১৫ তারিখ, মল্লিকাকে পড়ানোর সময় শেষ। আগামীকাল ঢাকা চলে যাব। যথারীতি সুবীর কাকু ২হাজার টাকার খাম হাতে ধরিয়ে দেন আরও একটা। সেই একই ভাবে খামটা ওয়ালেটে ঢুকিয়ে রেখে দিই। কাকীমা আজ নিজের হাতে নানান জাত রেঁধে বেড়ে আমাকে খাইয়েছেন,মল্লিকা সারাক্ষণ মুখ ভারী করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
চলে আসার আগে মল্লিকা বলে,”স্যার গ্রামারে কোন সমস্যা হলে তোমাকে ফোন দিব, নাম্বারটা দিয়ে যাও। ”
আমি সহাস্যে বললাম,”ওই তুই আমাকে স্যার ডাকিস কেন রে? আগে তো বেশ টুটুল দা বলে ডাকতি!”
— একদিন একটা অক্ষরও যদি কেউ শিক্ষা দেয় সে শিক্ষক। সে হিসেবে তুমি তো আমার শিক্ষক, তোমায় স্যার বলবো না?
—- ওরে বাবা! মেয়েটা দেখি কথাও জানে!
প্যাডের পাতায় ফোন নাম্বারটা লিখতে লিখতে ভাবলাম জানালায় কে দাঁড়িয়ে থাকে জিজ্ঞেস করে নিব কিন্তু ঠিক তখনই ফৌজিয়া পাজিনীটার কল আসলো। কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম তাই আর জানাটা হল না কে ঐ রহস্যমানবী। সুবীর কাকুর আরও দুইটা ভাতিজী আছে পলি আর প্রিয়াংকা। ওরা কেউ হবে! নাহ্ ওরা তো ওই ঘরে স্টাডি করে এ সময়টাতে। তাহলে কে হবে?
ফিরে এলাম আমার সাধের হল লাইফে,ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে ওয়ালেটে টাকার খাম দুইটা বের করে উল্টেপাল্টে দেখলাম। টাকাগুলো খাম থেকে বের করে খামটা ফেলে দিব ভাবতে ভাবতে কাগজটা এক হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেললাম। খেয়াল করে দেখলাম খামের ভিতর দিয়ে লিখা,”স্যার ভুলনা আমায়। সুযোগ পেলে পর্দার আড়ালের হাসিটা তোমায় সারাটা জীবন শুনিয়ে যাব, ভেবে দেখ। ”
তার মানে মল্লিকা?

-অরুন্ধতী অরু 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *