অনুধাবন ( ১০ম পর্ব )

তালুকদারের বাড়ীতে তখন আসলেই বিশাল নাটক চলছিল। রেহানার স্বামী আসলামকে সকালে তালুকদার সাহেব তার আড়তে ডেকেছিলেন। সামান্য একটু বুঝি কড়কেও দিয়েছেন! নয়তো এই মুহূর্তে রেহানার পুরো শ্বশুরবাড়ীর লোক এসে তালুকদারের বাড়ীতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকবে কেন?

আজিজ এসে বাড়ির সব ঘটনা বলে যাওয়ার পর থেকে তালুকদার সাহেব আড়তে বসে একা একাই হাসছেন। নিজেকে এই অবস্থানে আনতে কম মানুষ তো আর দেখেননি? শুধু একটাই ভয় এখন, ছেলেটাকে যে কিছুতেই বাগে রাখতে পারলেন না। এতো সম্পত্তি উনি কার জিম্মায় রেখে যাবেন? জীবন মানেই ভোগ আর নিত্য নতুন সম্পদ বাড়ানো এই নীতিতে বিশ্বাসী তালুকদার কিছুতেই ভেবে পান না তার সন্তানেরা কার মতো এমন ভীতু মানসিকতার হলো?

হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে না গেলেও তার লোকেরা ছেলের পাহারায় আছে। গত কয়েক মাস ধরে শোনা কিছু কথা নিয়ে অলস সন্ধ্যায় আনমনে ভাবনায় মেতে উঠলেন তিনি নিজের একলা অফিসে বসে। সহকারী কাজের ছেলেটা তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে। প্রসঙ্গ ওয়াদুদ। ওনার আগে থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো ওয়াদুদ কোথাও একটা ঘোট পাকাচ্ছে। ওর পিছে লোক লাগানোর কোন ইচ্ছে না থাকলেও কিছু ব্যবসায়ীক অনাকাঙ্খিত ঘটনা তালুকদার সাহেবকে বাধ্য করেছে ওয়াদুদের গতিবিধিতে লোক লাগাতে। গত কয়েকদিনে যে পরিমাণ খবর পেয়েছেন, তাতে ওয়াদুদের একটা কঠিন শাস্তি পাওনা হয়েছে। কি শাস্তি দেয়া যায় সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। সে কোন ডেরায় আছে সেটা জানলেও ঠিক এখুনি কিছু করা উচিত হবেনা ভেবে নিজেই নিজেকে থামিয়ে দিলেন। নয়তো তালুকদার চাইলে এখুনি ওয়াদুদের গলা মাথা থেকে নামিয়ে দেয়া তো খুব কঠিন কিছু না। কতদূর পর্যন্ত ওয়াদুদ আর তার সাঙ্গপাঙ্গোরা শেকড় ছড়িয়েছে সেটা না জানা পর্যন্ত কিছু করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

লোকে কেন যে অন্য লোকের পিছনে লেগে থাকে এই ব্যাপারটা তালুকদারের মাথায় কিছুতেই ঢোকেনা। এইটুকু পর্যন্ত আসতে তাকে কি কোন কষ্ট করতে হয়নি? এমনি এমনি তো কেউ তাকে এতো সম্পদ দিয়ে যায়নি। অথচ যখনই আপন ভেবে কাউকে কাছে রেখেছেন সেই ঘুরে একটা ছুরি মেরে দেয়ার চেষ্টা করেছে। নিজের ভাইদের সম্পত্তি যদি উনি লোক দিয়ে নজর না রাখতেন, দলিল পত্র করে গুছিয়ে না রাখতেন তবে তো এতোদিনে দশভূতে লুটেপুটে খেয়ে নিত। তারপরও দুই ভাইয়ের পরিবারই এখন তার পিছে লেগেছে সম্পত্তির জন্য। অথচ উনি কিন্তু কখনোই কোন ফসলের ভাগও নিতে যাননি। নিজের চরিত্র বা কর্মকান্ডের ওপর নিজের দখল সবসময় না থাকলেও ভাইদের সুযোগ সুবিধার দিকে তার চোখ সবসময়ই ছিল।

হুক্কার আগুন প্রায় নিভে গেছিল সেটা জ্বালাতে এসে ছেলেটা জানালো শামসু এসেছে কথা বলতে। শামসু ছেলেটা বিড়ালের মতো হাঁটে, কোন শব্দ পাওয়া যায়না। সামনের জানালার আয়নায় আবছা অবয়ব দেখেই তালুকদার কথা বলে উঠলেন।

– কেমন আছো শামসু? কোন নতুন খবর? তুমি আমার কাছে আসা মানেই জম্পেশ কোন খবর আছে।

জ্বী সাব, আসলেই খবর আছে। তবে জম্পেশ না।

– কি কথা বইলা ফালাও। ভনিতার দরকার নাই। কোন পয়েন্ট বাদ দিবানা। নয়তো তোমারে আবার ডাকাইতে হয়, ভালো লাগেনা সেইসব দিগদারী।

ওয়াদুদের কান্ড কারখানার কিছু খবর নিশ্চয়ই পাইসেন। ওয়াদুদের লগে হাত মিলাইসে আপনেরই ছোট ভাই। অথবা বলতে পারেন আপনের ছোট ভাইয়ে বুদ্ধি খাটায়া আরো পয়সার লোভ দেখায়া ওয়াদুদরে হাত করসে। ওয়াদুদের বাপে আচমকা মরসিলো তাগো ধানী ক্ষেতের মধ্যে চাষবাসের সময়। যেই জমিটার কিনার আছিলো আপনেগো ধানী জমির লগে। আপনের মনে আছে নিশ্চয়ই। আপনের ছোট ভাই তারে বুঝাইছে সেই জমির দখল নিতে আপনের লোকেরা তারে মারছে। আর সেই খুনীর ডাইন হাত হইয়া কেমনে সে কাজ করতেছে। মোট কথা আপনের ছোট ভাই রতনের ইশারায় এতো কান্ড। সে অন্যদিকে আপনের বড়ভাইয়ের পোলাগো উসকায়া দিছে দলিল বুইঝা নিতে; যেন দুইদিক থেইকা আপনেরে কোনঠাসা করন যায়। তারচেয়ে বড় ব্যাপার আপনেরে টলানির লাইগা তারা রাসেল ভাইজানের দিকে হাত বাড়াইসে। ওনার ড্রাগস সাপ্লাই দিত নাজমার মা, মানে রাসেল ভাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষের শ্বাশুড়ি । পুরা ব্যাপারটা আগে থেইকা সাজানো। এমনকি নাজমা ভাবীর লগে রাসেল ভাইয়ের বিয়া দিব সেই ব্যাপারটাও। ঐ বিয়ার একজন সাক্ষী হইসে ওয়াদুদের ছোট ভাই। সেও আছে ওদের গ্রুপে। সেই ছোট ভাইয়ের লগে ড্রাগওয়ালাগো সম্পর্ক আছে। সে নাজমা ভাবীর মা আর তাগো বাড়ির কাছের মুদি দোকানে ড্রাগ সাপ্লাই দেয়। তারচেয়ে খারাপ খবর যেইটা হাসপাতালে তারা এখনো রাসেল ভাইরে ড্রাগ সাপ্লাই দিতেছে। যেন হাসপাতালে থাকলেও উনি ভালো না হয় সহজে।
আরো কিছু কাম করতাসে তারা যতদূর খবর পাইসি। আপনের ছোট মাইয়ার জামাইর কাছে শাহানা আপারে নিয়া আজেবাজে কথা কইতাসে যেন শাহানা আপারে ইকবাল ভাইয়ে তালাক দেয়। আপনের সব পোলাপাইনরে দিয়া আপনেরে কাবু করনের প্ল্যান তাগো। আমি যতদূর জানি কইলাম। আপনের কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

– আমার কিছু লোক আছে হাসপাতাল এলাকায়। রাসেলের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। তার মানে ওদের মধ্যে কেউ একজন আছে ওয়াদুদের লোক। ঠিক?

জ্বি ঠিক। তারা হাসপাতালের দুইটা বয়রে হাতে রাখসে। নিজেরা হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকে না। বয়দের দিয়া জিনিস ভিতরে পাঠায়ে দেয়।

– নাজমা কি জানে এই বিয়ের পিছনের ঘটনার ব্যাপারে? মানে নাজমা ও কি ওদের দলের সাথে কি না?

না উনি তেমন কিছু জানেনা। নিতান্ত ছাপোষা মানুষ। সৎ মায়ের রোষের শিকার। উনি কিন্তুক পড়াশোনায় খুব ভালো আছিল। ওনার বাপে যতদিন বাঁইচা আছিল মেয়েরে পড়াইসে।

– ঠিক আছে শামসু, তুমি কালকা সকালবেলা ম্যানেজারের থেইকা তোমার পাওনা বুইঝা নিয়া যাইয়ো।

শামসুর গমন পথের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তালুকদার সাহেব। এই যে ছেলেটা এতো খবর দিয়ে গেল, এই খবরগুলো তার আগেই আরেকজনের কাছ থেকে তালুকদারের জানা হয়ে গেছে। শামসু ছিল খবরের সত্যতা আরো এক সূত্র থেকে জানার মারফত। কিন্তু শামসু এটা জানেনা যে ওর দেয়া তথ্যগুলোতে লুকানো খবরটাও যে তালুকদার জানেন। মানুষের লোভ আসলে বড় সাংঘাতিক। নয়তো এই খবর দিয়ে যাওয়া শামসু যে ওয়াদুদ বা রতনের দলেরই বাইরের দিকের লোক সেটা আর কেউ না জানলেও তালুকদার সাহেব ঠিকই জানেন। বিশ্বাসঘাতক লোক দিয়ে দুনিয়াটা ভরে গেলো। নানা পদের লোকের সাথে মিশে মিশে একটা দারুন গুন হয়েছে তালুকদারের, মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন, কে সত্যি বলছে আর কে বলছে না।

নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে নিজ পুত্র, রাসেলকে এসময় পাশে আসলেই দরকার ছিল। কিন্তু এই মূহুর্তে যা নেই তা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। বরং যে বা যারা হাতের কাছে আছে তাদেরকে দিয়ে নতুন কর্ম পরিকল্পনা সাজানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হলো তালুকদার সাহেবের। রতন আর ওয়াদুদের ব্যাপারটা টের পাওয়ার পর থেকেই মনে মনে একটা খসড়া তৈরী করছিলেন কয়েকদিন ধরে। আরো একবার সবগুলো সম্ভাবনা নিজে নিজে চিন্তা করলেন। বয়স হয়েছে, ইদানীং মনে রাখতে একটু কষ্ট হয়। কোথাও লিখে রাখবেন কি না ভাবছেন। সমস্যা একটাই কোন কিছু লেখা মানেই একটা ডকুমেন্ট তৈরী করা।

ওয়াদুদ আর রতনকে থামানোর একটাই উপায়। কিছু অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আপাতত মুখ বন্ধ করে দেয়া। সেই ফাঁকে নতুন কোন চাল চালতে হবে। কারণ লোভী লোকে একবার পেলে বারবারই পেতে চাইবে। কাজেই বেশীদিন ওরা শুধু কিছু টাকা পেয়ে চুপ থাকবে না।
রাসেলের বৌ লিমা যখন পড়াশোনা করতে চেয়েছিলো উনি বাঁধ সাধেননি কারণ ওনার মনে হয়েছিল একে যদি কোনভাবে পরবর্তীতে ব্যবসাতে লাগিয়ে নেয়া যায় তা আখেরে নিজেদেরই কাজে লাগবে। মফস্বলে এখনো মেয়েলোকের কাগজ পত্র বা ব্যবসা বাণিজ্যে কাজ করার তেমন কোন নজির নেই। দু কথা যেন না হয় তাই বাড়িতেই লিমাকে একটু আধটু করে ব্যবসার ব্যাপারগুলো বোঝাতে হবে। বাচ্চা হয়ে গেলে পরে না হয় পুরোপুরি সম্পৃক্ত করা যাবে। নাজমাকে রাসেলের জীবন থেকে সরানোর ব্যবস্থা ও করতে হবে। তাতে করে লিমা কে সংসারে বা ব্যবসায় মনোযোগী করাতে সুবিধা হবে। তবে সবার আগে রাসেলকে সুস্থ করার ব্যাপারে নজর দিতে হবে।

কাল একবার হাসপাতালে যেয়ে ছেলেকে দেখে আসতে হবে, হাসপাতাল পাল্টে দূরে কোন শহরে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে; এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরেন তালুকদার। জানতে পারেন নি যদিও, একজোড়া চোখ তার গমন পথের দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।

এ যেন এক নিত্য শিকারীর জীবন। বেঁচে থাকা মানে নিরন্তর হিংস্র দানব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যাওয়া আর সুযোগ মতো নিরীহ প্রানী মেরে নিজের ক্ষুধা মেটানো। জীবনের তাগিদে প্রতিটা মানুষই কি তাহলে কোন না কোন ভাবে এক ধরনের শিকারী? কেউ একটু বেশী কৌশলী কেউ বা কম। কত অদ্ভুত রকমের জীবিকা নিয়েই না লোকে জীবন পার করে। কেউ কাউকে অনুসরণ করে আর কেউ বা অনুসরণের বস্তু হয়ে।

 

চলবে……

-ডা.জান্নাতুল ফেরদৌস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *