অনুধাবন ( ১১তম পর্ব )

(লিমা)

গতকাল রেহানা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ীতে আবার অখন্ড নীরবতা। গত কয়েকদিন পুরো বাড়ীতে কেমন একটা হুল্লোড় ছিল। রেহানার ছেলেরা আর তিতলী মিলে পুরো বাড়ী যেন মাথায় তুলে রেখেছিল। প্রানহীন গৃহে প্রানের পরশ যেন শিশুরাই কেবল এনে দিতে পারে। আমার শরীরও আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো। শুধু রাতের বেলার নির্ঘুম রাত আর পরদিন সকালের একটু ক্লান্তি ছাড়া। ডাক্তার বলেছে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে। আপাতত নাকি বিপদ নেই কোন। আর মাত্র কয়েকটা মাস। এতো বড় হয়েছে পেট নিজের কাছেই আজকাল অস্বস্তি লাগে। এখন আর নিজের ঘরে খাওয়া এনে খেতে হয়না। খাওয়ার ঘরে যাই, সবার সাথে দেখা হয়, কথা হয়। শুধু নাজমা ছাড়া। ওর কোন দোষ আছে কি নেই সে প্রসঙ্গে কথা নাই বা হলো, ধরে নিয়েছি এটা আমার নিয়তি। তিতলী ওর ঘরে গেলে আজকাল তাই আর ডাক দেইনা। কিন্তু তাই বলে গায়ে পরে ওর সাথে বন্ধু বা ছোটবোন মেনে থাকা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব না। যে যার মত থাকুক ভালো থাকুক, আমার গায়ের ওপর এসে না উঠলেই হলো।

বিয়ের পর থেকে আমাকে কখনোই হেঁসেলের ভার পুরোপুরি নিতে হয়নি। ইচ্ছে হলে রেঁধেছি না হলে নাই। আমার শাশুড়ীই মূলত পুরো ঝামেলা সামলেছে। বাড়ীতে মানুষ তো আর কম না। তার ওপর সপ্তাহে দুদিন আড়তে সবাইকে খাওয়া পাঠানো হয়। সে এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। কিন্তু রাসেলের হাসপাতালে থাকা, আমি বা নাজমার কেউ ওর ব্যাপারে কোন মাথা না ঘামানোর দরুন আমার শাশুড়ীকেই ছেলের খাবার, যত্নের জন্য নিত্য হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। এর মধ্যে রেহানার শ্বশুরবাড়ির সমস্যা। সব মিলিয়ে বাড়ীতে একটা হট্টগোল শুরু হয়েছিল যেন। নাজমা নিজ দায়িত্বে হেঁসেলের দায়িত্ব নেয়াতে আমার শাশুড়ী এমনকি আমার দুজনেরই বেশ সুবিধা হয়েছে। কাজের লোকেরা চালিয়ে নিতে পারতো ঠিকই, কিন্তু তাদের চালাতেই যে আরেকজন দরকার হয়। আমি সহ গেলে ওরা হয়তো নাজমার কথা শুনবেনা ভেবেই আমি দূরে দূরেই রইলাম। নাজমাকে নিয়ে বাড়ির ঝি মহলে আড়ালে আবডালে হওয়া কথা যে কানে আসেনা তা নয়। আমি সেসব প্রসঙ্গেও কোন মাথা ঘামাইনা। না শোনার মতো চুপ করেই থাকি। ঐ যে বললাম নিয়তি মেনে চুপ করে থাকাটাই আমার কাছে সমীচীন মনে হয়েছে। যেহেতু আমার আর কোথাও আপাতত যাওয়ার জায়গা নেই, শুধু শুধু উল্টাপাল্টা ভাবনা ভেবে নিজের শরীর আর খারাপ করতে চাইনা। বাচ্চাটার ভালোয় ভালোয় ডেলীভারী হয়ে গেলে পরে তখন চিন্তা করবো।

সকালের নাস্তা তাড়াহুড়ো করে খেলে এমনিই আমার বমি আসে, তাই আস্তেধীরে সবার শেষে খেতে বসি। আজকে নাস্তায় পরোটা আর চিকন করে কাটা আলুভাজি করা হয়েছে। রংটা এতো সুন্দর হয়েছে মনে হচ্ছে পুরো বাটির আলুভাজি বোধহয় আমিই খেতে পারবো। সত্যি কথা কি মেয়েটা যেদিন থেকে রান্নার হাল ধরেছে নানা নতুন নতুন পদ খেতে পারছি। আর রান্নার হাতও বেশ ভালো। মাত্র এক গ্রাস খাবার মুখে তুলেছি বাড়ির ঝি এসে জানালো আমার শ্বশুর নাস্তা শেষে ওনার ঘরে আমাকে ডেকেছে। হঠাৎ এরকম একটা খবরে খিদে যেন পুরোপুরি চলে গেল।

আমার শ্বশুর সাধারণত নিজে বাড়ির লোকেদের সাথে কথা খুব কম বলেন। আমার শাশুড়ীর মারফত যাবতীয় কথাবার্তা প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছায়। এমনকি আমি যখন তিতলী কে নিয়ে চলে যাই তখনো কিছু বলেন নি, না কিছু বলেছেন আমি ফিরে আসার পর। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় উনি ইচ্ছে করে বাড়ির সবাইকে এড়িয়ে চলেন। তবে এটাও ঠিক বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে সব ওনার নখদর্পনে থাকে। এই যে রেহানার জামাই সহ পুরো শ্বশুরবাড়ি হুমড়ি খেয়ে এসে পরলো রেহানার পায়ে সেটা যে এমনি এমনি ঘটেনি সেটা মুখে কেউ না বললেও বাড়ির সবাই ঠিক ঠিক বুঝেছে যে পেছনে কলকাঠি কে নেড়েছে। কি কথা বলতে পারে এই চিন্তায় এতো মজার আলুভাজি ও বিস্বাদ ঠেকলো। কোনরকমে নাস্তা শেষ করে নিজের ঘরে এলাম একটু গুছিয়ে নিতে। মনে মনে ঝড় বইছে কি বিষয়ে কথা থাকতে পারে বোঝার চেষ্টায়।

সালাম দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি শাশুড়ীও বসা আছেন।

বসো মা। তোমার সাথে তো কথাই হয়না। শরীর কেমন যাচ্ছে?

জ্বি আব্বা ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো?

বুড়া বয়সে আর শরীর ভালো আর খারাপ। চলে যাচ্ছে আর কি। তিতলী বেগম কই? সকাল থেকে কোন আওয়াজ পেলাম না।

এ সব কথাই তবলার ঠুকঠাক। মনে মনে অস্থির লাগছে আসল কথা বলছেনা কেন? আলতো করে জবাব দিলাম, এইতো আছে বাড়ির ভেতরেই দৌঁড়াচ্ছে বা খেলছে হয়তো।

“আচ্ছা শোন মা, যে কারণে তোমাকে ডেকেছি। রাসেলের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে তুমি কতদূর কি জানো আমি জানিনা। কিন্তু ওর শরীর ঠিকঠাক হয়ে আমার ব্যবসা বুঝে নিতে আরো কতটা সময় দিতে হবে তা আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। কিন্তু নিজের ওপরে আমি আর বাড়তি কোন চাপও নিতে পারছি না। তুমি পড়াশোনা করতে চেয়েছো আমি বাঁধা দেইনি, কারণ মনে হয়েছে তুমি আর রাসেল দুজনে একসাথে কাজ করলে আমার ব্যবসার হাল ধরা সহজ হবে। আমি যতদিন আছি আমিতো তোমাদের পিছু পিছুই থাকবো। তোমার শরীর এখন খারাপ তাই আমি জোর করছি না। কিন্তু আমি এখন থেকে তোমাকে একটু একটু করে আমার হিসেবের খাতা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করবো।”

“কিন্তু আব্বা এতো অনেক কঠিন কাজ। আমি পড়াশোনা করেছি মানে তো এই না আমি হুটহাট এতো জটিল হিসাব বুঝে যাবো। আর মেয়েমানুষ আড়তে যেয়ে ব্যবসা দেখছে, লোকে কি বলবে?”

“তোমার দুটো প্রশ্নের জবাবই আমার কাছে আছে। আমি তোমাকে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেব না। একটু একটু করে তুমি নিজে শিখবে। তোমার ডিগ্রী পরীক্ষার সময়ের কথা মনে আছে? তিতলীকে পেটে নিয়েও তুমি পড়া চালিয়ে গেছো এবং খুব ভালো রেজাল্টও করেছো। আমি পারবো না বলে হাল ছেড়ে দেয় বোকা লোকে। আমিতো তোমাকে বোকা মনে করিনা। আর মেয়েমানুষ ব্যবসা দেখবে? আমার অবর্তমানে তোমাদের খাওয়া থাকার কি ব্যবস্থা হবে কিছু ভেবেছো? দশ ভূতে লুটেপুটে খাবে আমার এতো কষ্ট করে জোড়ানো সম্পদ। পারবে সেটা দেখতে চোখের সামনে? রাস্তায় যেয়ে দাঁড়ানো কি এতো সোজা?”

“না আব্বা, আমি আসলে ওভাবে বোঝাতে চাইনি। তাছাড়া আমি একাই বা বুঝে নেবার কে? আপনার ছেলে তো আরেকজন ও ঘরে তুলেছে। তারও কিছু বলার থাকতে পারে।”

“তোমার কথায় যুক্তি আছে। আমি যে সেটা ভাবিনি তা কিন্তু না। আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলবো। তুমি শুধু তোমার অংশটুকু নিয়ে ভাব এই মূহুর্তে। আমার অবস্থাটুকু বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই।”

“সেটা বুঝেছি। কিন্তু আমি কি পারব? ভয় লাগছে ওভাবে ভাবতেই।”

“পাগল মেয়ে, এতো চিন্তার কি আছে। আমি আছিতো পিছে বললাম ই। আমার সব লোকজন সবখানে গোছানো আছে। শুধু আমার পাশে থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কেউ নেই। মেয়ে জামাই গুলো একটু পদের হলেও হতো। কিন্তু ওরা দুজনও যেন শুধু শিকারী বেড়ালের মত ওঁত পেতে রয়েছে আমার থেকে কি সম্পদ পাবে তার আশায়। ইচ্ছে করে সবকিছু কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে কোন একদিকে চলে যাই।”

এসব জ্ঞানগর্ভ কথার কি উত্তর দেব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। “আমি তাহলে আসি। আপনি যখন বলবেন তখন থেকেই শুরু করবো।”

“আরেকটা কথা, এখনো যেহেতু তুমি শেখার স্টেজে আছো আমি কিন্তু তোমাকে এ সময়টায় আমার কর্মচারীদের মতো বেতন দেব। তোমার কাজের দক্ষতার ওপর দিন দিন বেতন বাড়বে।”

“আমি টাকা দিয়ে কি করবো? আর আপনার কাজ মানে তো আমার নিজের ঘরের কাজ, সেখানে টাকা নেই কিভাবে? আমার টাকা লাগবে না।”

“না টাকা লাগবে। কারণ পারিশ্রমিক পেলে তোমার কাজের আগ্রহ বেড়ে যাবে। তারপর যখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে তখন আর বেতন না নিলেও হবে।”

“তাহলে তো আমি কখনোই পুরো কাজ শিখতে চাইবোনা” বলে হেসে দিলাম। আমার সাথে সাথে আমার শ্বশুরও হেসে উঠলেন। আমি বোধহয় আমার বিবাহিত জীবনের এতো বছরে এই প্রথম ওনাকে হাসতে দেখলাম।

হাসি ব্যাপারটাই যেন কেমন। সবার চেহারায় একটা অন্যরকম দীপ্তি এনে দেয়। আমার শ্বশুরের গলার স্বরের ক্লান্তিটুকু এরকম প্রানখোলা হাসির মধ্যেও আমার কানে ঠিক বাজলো। এ কি নিজের সন্তানের ব্যর্থতার ভার মেনে নিয়ে অন্যকে নিজের দখল ছেড়ে দেয়ার কষ্টে নাকি সত্যিই বয়সের ক্লান্তিতে তা যেন ঠিক পরিস্কার বোঝা গেল না। তবু এতোটা আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল ওনার কন্ঠে যে আমি পারবোনা বলার ইচ্ছেটুকু আমি করে উঠতে পারিনি।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *