অনুধাবন( ১৪তম পর্ব )

( নাজমা)

কথায় বলে টাকা থাকলে নাকি বাঘের দুধও মেলে। আমার শ্বশুর সে কথা যেন আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ওনার সাথে কথা শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা শহরে কোন এক ডিগ্রী কলেজে আমার ভর্তির কাগজ, হোস্টেলে থাকার কাগজ সহ এক বিশাল ফাইল আড়তের ম্যানেজার সাহেব লোক মারফত পাঠিয়ে দিলেন, সাথে ব্যাংকের কাগজপত্র। দেখলাম আমার কাবিন বাবদ করা প্রায় এক লক্ষ টাকা উসুলের একটা ফিক্সড ডিপোজিট লেখা কাগজ আর চেকবই। কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে সব দাগিয়ে দিয়েছেন। পুরো ফাইলটা নিয়ে বেকুবের মতো কতক্ষণ ঘর আটকে বসে রইলাম। সব কাগজের নীচে একটা স্ট্যাম্প করা কাগজ ও রয়েছে, যেরকম কাগজে দলিল লেখা হয় তেমন কিছু। ওটাতে লেখা আছে আমার সাথে আমার শ্বশুরের রাসেলকে তালাক দেয়া সংক্রান্ত কথাবার্তার একটা খসড়া। ঐ কাগজেও একটা সই দিতে বলা হয়েছে। যে ফাইলটা দিয়ে গেছে সে জানিয়েছে ঘন্টা দুয়েক পরে এসে সব কাগজ পত্র নিয়ে যাবে। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম কোথা থেকে যে দু ঘন্টা পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। নিজেকে মনে হচ্ছে যেন দম দেয়া কলের পুতুল। আমার জীবনের গতি পথটা যেন শুধু অন্য লোকের অঙ্গুলী হেলনেই এঁকেবেঁকে গেছে। আমি শুধু হেঁটে যাওয়া পথিক মাত্র। কোন পথে হাঁটবো সেটা অন্য লোকেই ঠিক করে দিল আজ তক।

সবগুলো কাগজে একে একে সই করে যেভাবে দিয়েছে সেভাবেই গুছিয়ে রাখলাম আড়ত থেকে কেউ নিতে আসবে সে আশায়। ফাইল গুছিয়ে উঠতেই দরজায় টোকা পরলো। ফাইল নিয়ে যাওয়ার লোক এসেছে, যাওয়ার পথে সে জানিয়ে গেলো আগামী শুক্রবার আমার ঢাকা যাওয়ার বাস। আমি যেন সকাল সকাল সব গুছিয়ে তৈরী থাকি।

গরীবের ঘরে বড় হওয়া এই আমি কখনো কোন বাহুল্য দেখিনি। সারা বছরে দুটো বড় জোর তিনটে জামা হয়তো পেয়েছি বাবার ঘরে। সৎ মায়ের কাছে থাকা অবস্থায় সেরকমও কিছু জোটেনি ফি বছর। এ বাড়িতে যখন আসি আমার বোঁচকায় ছিল শুধু একটাই ঘরে পরার শাড়ি। বাড়ির ঠিকে ঝি গুলোরও বোধহয় আমার চেয়ে বেশী কাপড় আছে। আমার শাশুড়ী আমাকে মেনে না নিলেও বেশ কয়েকটা শাড়ি কাপড় অন্তত কিনে দিয়েছে। হোক না কম দামী তবু তো দুইয়ের অধিক সংখ্যায় নতুন কাপড় পাওয়া যে আমার জীবনে সেই প্রথম। আমি যত্ন করেই রেখেছি সব কিছু। কোন সোনার গয়না পাইনি আগে কখনো। নাক খালি দেখে শাশুড়ি একটা সোনার নাকফুল দিয়েছে। এই আমার সবচেয়ে দামী সম্পদ। ওহ না না আরো একটা মূল্যবান সম্পদ আছে। তা হচ্ছে আমার মেট্রিক ইন্টারের সার্টিফিকেট দুটো। ও দুটো থাকার কারণেই না আমার অন্য রকম একটা জীবনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি অন্যরকম কিছু? এক জীবনে না পেতে পেতে কিছু পেলে মনে হয় নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে ভেতরে।

এ বাড়ির কেউই আমার সাথে তেমন একটা কথা বলেনা দেখে আমি চুপচাপই থাকি। যে যা বলে শুনি। কিছু বললে আবার সেটা নিয়ে যদি হাসি তামাশা করে তখন শুধু শুধু মন খারাপ হবে এই ভেবে নীরবে শুধু শুনেই যাই। কিন্তু আমারো মাঝে মাঝে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। একটা মানুষ এক জীবনে কতটা সময় চুপ করে থাকতে পারে? ঠিকে ঝি দের কাছেই শোনা রাসেলের দুই চাচাতো ভাইকে নাকি কে বা কারা কিছুদিন আগে বেধড়ক পিটিয়ে খাল পাড়ে ফেলে রেখে গেছে। তারা দুজনেই হাসপাতালে ভর্তি। এই নিয়ে আমার শ্বশুরদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ভীষণ গন্ডগোল চলছে। ছোট ভাই বলছে আমার শ্বশুরের লোকেরা করেছে এ কাজ। আর বড় ভাই বলছে ছোট ভাইয়ের ভাড়াটে গুন্ডাদের কাজ। যারা মার খেয়েছে তারাও নাকি শুনেছে গুন্ডারা বলেছে তারা তাদের ছোট চাচার নির্দেশে এ কাজ করেছে। এদিকে রাসেলের অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা দেখে নাকি তাকে বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমি সব শুনি আর একেকজনের মতামত দেয়া দেখি। সবার একটাই কথা তালুকদার বাড়িতে এতো গন্ডগোল আর এক জীবনে তারা দেখেনি।

আমি যে আর কিছুদিনের মধ্যে এ বাড়ি ছেড়ে একেবারে চলে যাব কাউকেই এ কথা বলিনি তিতলী ছাড়া। আমার যে কথা বলারও আর কেউ নেই। মেয়ে মানুষের স্বভাব কেমন যেন শেকড়ের মতো। যেখানে থাকে সেখানকার মানুষের জন্য কেমন একটা মায়া জন্মে যায়। আর কিছুদিন পর থেকে আমার জীবনে এই মানুষগুলোর আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। পুরো পৃথিবীতে আমি হব একলা একা একজন মানুষ। কি যে হাহাকার করা ব্যাকুল সেই অনুভব তা যদি কাউকে বোঝানো যেত। মনের কষ্ট বুঝি কিছুটা কমতো। কি মনে করে যেন পায়ে পায়ে লিমা বুবুর ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আগে উনি সবসময় দোর দিয়ে রাখতো, এখন প্রায় সময় খোলাই থাকে।আস্তে উঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকি, বুবু আসবো?
আমাকে দেখে বেশ চমকে গেলেন উনি।কিন্তু কিছু না বলে ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইলেন।

‘আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। পছন্দ করার কারণ ও অবশ্য নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হলো আপনাকে দুটো কথা বলে যাই। আমি সামনের সপ্তাহে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, চিরদিনের জন্য; আপনার আমার শ্বশুরের নির্দেশে। আমার তাতে কোন দুঃখ নেই। রাসেলের সাথে আপনি সুখে থাকেন আমিও তাই চাই। কিন্তু কি জানেন, আমার না এই পৃথিবীতে আর একটা কোন নিজের মানুষ নেই। বাংলা অভিধানে এতিম শব্দটা আমার জন্য বড় বেশী প্রযোজ্য। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গাছে ঝুলে বা বিষ খেয়ে মরে যাই ।কিন্তু আত্মহত্যা করা নাকি মহাপাপ। মরলে পরে বেহেশত পাব না। আমার না খুব একটু সুখ পেতে ইচ্ছে করে বুবু। সেই যে ছোটবেলায় মা মরে গেল, ঘরে সৎমা এলো তারপর থেকে আর কেউ কোনদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু ভালো কথা বলেনি। নিত্য লোকের লাথি গুতা খেয়ে বড় হয়েছি। কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে। এই বাড়িতে যখন এলাম মনে মনে লাথি খাবার জন্য তৈরীই ছিলাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধহয় একচ্ছত্র দুঃখ কারো জীবনে রাখেনা। কয়দিন আর বান্দাকে না খাইয়ে রাখবেন? তাই বাড়ির কেউ কথা না বললেও খাওয়া পরাটা জুটে যাওয়াতে নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হতো। কথায় বলেনা, লোকে খেতে পেলে শুতে চায়। আমার হয়েছে সেই দশা। খাওয়া পরা যেই জুটেছে এখন আমার মায়া পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পথের নেড়ি কুকুরকে হয়তো উচ্ছিষ্ট ভাত ছিটিয়ে দেয়া যায়, ভালবাসা যায়না, তাইনা বুবু? আমি মেনে নিয়েছি। আমি জানিনা আমার সামনে কি জীবন অপেক্ষা করছে। তবু কেন যেন মনে হলো কাউকে একটু বলে যাই আমার এক জীবনের কেবলই না পাওয়া আর বেদনার কথা। আমার ওপর রাগ করে থাকবেন না। রাসেলের সাথে বিয়ের পুরো ব্যাপারটায় আমার কোন হাত ছিল না। আমি শুধুই পরিস্থিতির শিকার। আমার জন্য পারলে একটু দোয়া করবেন। পোয়াতি মেয়েলোকের দোয়া নাকি কবুল হয়।’

একটা জীবন দুঃখ কষ্টে থেকে আমি আসলে কাঁদতেই ভুলে গেছি। আজ কি যে হলো আমার? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা না কি নিজের কুড়িয়ে পাওয়া মাথার ওপর ছাদটুকু হারিয়ে ফেলার শোকে আমার দুচোখের জলেরা অবিরাম নেমে এলো। লিমা বুবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। দোর লাগাতে মনে ছিল না। মাথার ওপর কারো আলতো হাতের স্পর্শে চোখ তুলে দেখি লিমা বুবু দাঁড়ানো।
‘ আমার দোয়া রইলো তোমার জন্য। আমি তোমার খোঁজ রাখবো। পৃথিবীতে যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।’ এইটুকু বলেই উনি চলে গেলেন।

ওনার কথাটুকুর জোরে নাকি অনেক সময় ধরে কান্নার ক্লান্তিতে আমি চোখ মুছে নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, আসলেই তো সামনের জীবনে কার কি আছে কেউই তো জানেনা। তারচেয়ে জীবনের চিন্তার ভারটুকু সৃষ্টিকর্তার ওপরেই না হয় ছেড়ে দেই। খুব বেশী হলে মরে যাব, এই তো? সে তো সবাই মরবে একদিন।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2212541902367815/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *