(রতন)
হোসেন মিয়ার তিন ছেলের মধ্যে একেকজন হয়েছে একেক ধাঁচের। বড় ছেলে কালাম একটু সহজ সরল ধরনের। জমি চাষ আর ঘর গৃহস্থালীর দিকেই তার নজর বেশী ছিল। তাই হোসেন মিয়া তার বড় ছেলেকে জমি জিরাতের কাজে নিজের সাথে সাথেই রাখলেন। বড় ছেলের মাথা তেমন ভালো না হলেও কোন সময় কি ফসল লাগাবে বা কিভাবে কোথায় চাষীদের কাজে লাগাবে এসব ব্যাপারে ছিল বেশ দক্ষতা। যার কারণে কালামকে দায়িত্ব দিয়ে হোসেন মিয়া বেশ নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন। বেশ অনেকটা জমি তিনি ছেলের পুরো দায়িত্বে দিয়ে দিয়েছিলেন। আর কালাম ভালোভাবেই বছর শেষে ফসলের হিসাব বুঝিয়ে দিতে পারতেন বাবা কে।
অন্যদিকে মেঝো ছেলে তালুকদার ছিলেন একটু অন্যরকম। জমি জিরাত খুব একটা টানতো না তাকে। পাড়ার মক্তবে সবচেয়ে ভালো আরবী পড়তে পারতেন। মুখে মুখে হিসাব ও করতে পারতেন ভালোই। একদিন বাবার কাছে এসে জেদ ধরেন উনি স্কুলে পড়বেন। হোসেন মিয়ার পুরো পরিবারে কোন পড়ালেখার ব্যাপার না থাকায় উনি হেসেই উড়িয়ে দেন ছেলের কথা। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে শেষমেষ একদিন কয়েক মাইল দূরের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসেন। কালাম এবং তালুকদারের মাঝে তাদের আরো দুই বোন হয় যারা কেউই বেশীদিন বাঁচেন নি। আর তাই তালুকদারের ব্যাপারে হোসেন মিয়া আর তার বৌ সবসময় আতংকে থাকতেন কোন বিপদ না হয়। একজন বাড়ির কাজের লোক রোজ কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে তালুকদারকে স্কুলে দিয়ে ও নিয়ে আসতো। রোজ এতোদূর আসা যাওয়া কষ্টের হবে ভেবে পড়াশোনা হয়তো ছেড়ে দেবে এমনই ভেবেছিল হোসেন মিয়া। তালুকদারের এক খালার বাড়ি স্কুলের কাছাকাছি হওয়ায় তালুকদার ঐ বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যায়। সপ্তাহান্তে কখনো মাসান্তে বাড়ি ফিরলেও তার বাবা আর মা অবশ্য নিয়ম করে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ছেলেকে দেখে যেতেন।
এই নিয়মের ব্যতয় হয় তালুকদারের ছোট ভাই রতনের জন্মের কারণে। তার মা চাইলেও আর ছেলেকে দেখতে আসতে পারতেন না সহজে। কিন্তু তালুকদার ততদিনে বেশ একা থাকা শিখে গেছে। শেষ বয়সের কোলপোছা ছেলে হিসেবে রতন ছিল বাড়ির সকলের আদরের। তালুকদারের খুব ইচ্ছে ছিল রতন পড়ালেখা করুক। কিন্তু সবার আদর আহ্লাদে রতন দিনদিন বেশ ডানপিটে হয়ে উঠলো। স্কুলে নিয়ে তাকে বসানো গেল না বকা বা মার দিয়েও। তালুকদারের মা খোদেজা বিবি তখন তালুকদারকে বুঝিয়ে নিরস্ত করে এই বলে যে অতিরিক্ত শাসনে রতন যদি বিগড়ে যায়। তারপর থেকে তালুকদার আর এ ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। বাড়ির সবার অতিরিক্ত আদরে ডানপিটে রতন দিন দিন বেয়াড়া হয়ে ওঠে। কিছু আলতু ফালতু ইয়ার দোস্ত ও জুটে যায়। তালুকদারের বারবার সতর্কতা সত্ত্বেও তার বাবা মা তেমন একটা গুরুত্ব দেয়না। অবশেষে সবার টনক নড়ে যেদিন সে অন্য গ্রামের এক মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে আসে। এ ব্যাপারটা নিয়ে বাড়ির সবাই মেনে নিলেও এ বেলা তালুকদার তাকে ভীষণ গালমন্দ করে। তার কথাই ছিল, তুই নিজেই খাস আমাদের ওপর, আরেকজনকে তুলে আমার আগে নিজে কিছু করে দেখা। রতনের দারুন রকম ইজ্জতে লাগলেও বাড়ির সবার সামনে চুপ করেছিল সেদিন কিন্তু মনে ক্ষোভের আগুন ঠিকই জ্বলে উঠেছিল।
হিসাব নিকাশ ও বিষয়বুদ্ধি সম্পর্কে ভালো বোঝাতে বড়ভাই কালাম এমনকি বাবা হোসেন মিয়া ও তালুকদারের সিদ্ধান্ত বা মতামতকে বেশ ছোটবেলা থেকেই গুরুত্ব দিত। অন্যদিকে রতনের মতামত বা পরামর্শ ছোটবেলা থেকেই ছোট বলে তেমন একটা পাত্তা পেত না। ছোটবেলা থেকেই রতনের এটা নিয়ে ক্ষোভ ছিল তার মেঝো ভাইয়ের ওপর। সে আরো খেয়াল করেছে বাড়ির সবচেয়ে ভালো খাবারটা, ভালো কাপড়টা তালুকদার আগে পেত। এটা নিয়ে ছোটবেলায় মাঝে মাঝে রাগারাগি করলেও রতন এটা বুঝতে পেরেছিল তালুকদার তার যোগ্যতা দিয়ে এসব আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু নিজের অভিমানটুকু কাউকে বলতে না পেরে সেটা মনেই জমিয়ে রাখতো। লোকে বলে বাবা মা সব সন্তানকে সমান আদর করে। কিন্তু রতনের মনে হতো এ বাড়ির সব কিছু অদৃশ্যভাবে হলেও তালুকদারের অঙ্গুলী হেলনেই চলে। যেটা তাকে দারুনভাবে পীড়া দিত। তার ওপর আড়তের থেকে বাবা বা বড় ভাই থাকলে টাকা নেয়া কোন সমস্যাই ছিল না। অথচ তালুকদার থাকলে তাকে হাজারটা জবাবদিহি করতে হতো।
সবকিছু মিলিয়ে নিজের মায়ের পেটের বড় ভাই হলেও রতনের তালুকদারকে নিয়ে অস্বস্তি ছিল সবসময়ই। যদিও তাই বলে তার ভাবী আসমা আর ভাস্তে ভাস্তিরা ছোটচাচার সবসময়ই ভক্ত ছিল। বাবা হোসেন মিয়ার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিন ভাই একই সাথে থাকলেও বাবার মৃত্যুর পর রতনই জেদ ধরে তার সম্পত্তি আলাদা করে দিতে। ততদিনে তালুকদারও বুঝি বুঝে গিয়েছিলেন তার বা তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির পথের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে রতন। ওর ওপর ছেড়ে দিলে যদি ওর একটু দায়িত্ব বাড়ে এসব কিছু ভেবে বড় ভাই কালামও সম্মতি দিয়ে দেয়।
কিন্তু বলেনা নিজের যদি যোগ্যতা না থাকে মানুষ পাওয়া জিনিসও হারিয়ে ফেলে নয়তো নষ্ট করে। রতন এক জীবন শুধু বাবা ভাইয়ের ওপর চড়ে বেরিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছে। নিজের ওপর দায়িত্ব আসাতে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও ভেবেছে আমিই বা কম কিসে। কিন্তু নিজে না শিখেছে ক্ষেতের কাজ না শিখেছে পড়ালেখা। ব্যবসা করবে এই করবে সেই করবে বলে একের পর এক জমি বিক্রি করে গেছে। কিছু নগদ টাকা হাতে পেয়ে একটু মাস্তি করে নেই ভেবে মাস্তিতেই চলে গেছে, পুরো টাকা মাঝখান থেকে সে হয়েছে দিনে দিনে নিঃস্ব। অতঃপর একদিন ওর ঘরের ফসল আসা ধানী জমি যেদিন বিক্রি করতে যায় জানতে পারে সেটা তালুকদারের নামে। ওর মাথায় পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ততদিনে জুয়ার ঠেকে জমে যাওয়া ঋণ আর ঘরের নিত্য খরচ যোগাতে বেসামাল রতন। যদিও আবারো পতনটুকু ঠেকাতে তালুকদারই এগিয়ে আসে কিন্তু রতন জমির দখলের ক্ষোভ কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারেনা।
(ওয়াদুদ)
গ্রামে পাশাপাশি গৃহস্থ বাড়ি ছিল ওয়াদুদের বাবা আর হোসেন মিয়ার। পাশাপাশি বাড়িতে জমি জিরাত নিয়ে হিংসা বিদ্বেষ মনে মনে থাকলেও দুই বাড়ির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট ছিল সবসময়ই। রতন আর ওয়াদুদ ছিল সমবয়সী, ছোটবেলার খেলার সাথী বললে কম বলা হয়না। ওয়াদুদের খুব অল্প বয়সে তার বাবা মারা যায় ক্ষেতে চাষবাসের সময়। তখন তালুকদার বাড়ির সবাই মিলেই মায়ার বশেই ওদের পরিবারের হাল ধরে রাখে। রতন তখন ছোটবেলার বিবেচনায় গরীব ওয়াদুদকে হেনস্তাই করতো সবসময়। কাজেই বন্ধুত্ব খুব একটা জোরদার থাকেনি পরবর্তী সময়ে। ওয়াদুদ ও রতনের মতো ডানপিটে হলেও বুদ্ধি বিবেচনায় বেশ তুখোর ছিল। গ্রামের লোকের সাথে ওর সদ্ভাবটুকু চোখে পরার মতোই ছিল। তালুকদারের চোখেও সেটা পরে। নিজের ব্যবসা আলাদা হওয়ার পর তালুকদারই ওয়াদুদকে তার আড়তে যোগ দিতে বলে। নানা পদের লোক সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর উপস্থিত সব দারুন সমাধান কিছু তালুকদারের উপস্থিতি আর কিছু অনুপস্থিতিতে চমৎকারভাবে সমাধা করে দিয়ে দিনে দিনে সে তালুকদারের আরো বেশী আস্থাভাজন হয়ে উঠে। দিনে দিনে হয়ে ওঠে তালুকদারের ডানহাতের মতো।
……………
রতন তালুকদারের ওপর প্রতিশোধ নেয়া আর তার সাথে তার জমির দখল বুঝে নিতে কার সাহায্য নেবে বুঝতে না পেরে শেষমেষ ওয়াদুদের ওপর নির্ভর করার চিন্তা করে। ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে আগের হেনস্তাগুলো ভুলে গিয়ে ওয়াদুদ রতনের ডাকে যাওয়া শুরু করে তার ডেরায়। কথায় বলে দুষ্টলোকের বন্ধু হওয়া সহজ বেশী তাদের কৌশলের কারণে। ওয়াদুদেরও সময় লাগেনি। ওয়াদুদকে জুয়ার নেশা ধরিয়ে দিতে খুব বেশী সময় লাগেনা রতনের। তারপরতো নগদ টাকার নেশা পেয়ে বসে দুজনকেই। সাথে তার বাবার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা গল্প ফেঁদে বসে রতন। ওয়াদুদের বাকী ভাইরাও ততদিনে তেমন কিছু করেনা। উচ্ছন্নেই গেছে বলা যায়। গ্রামে একজনের এতো থাকবে আর তাদের কেন থাকবে না সব মিলিয়ে তালুকদারের বিপক্ষে একটা শক্ত গ্রুপই দাঁড়িয়ে যায়। আপাত দৃষ্টিতে রতনকে গ্রুপের নেতা মনে হলেও তালুকদারের অনেক গোপন তথ্য জানা ওয়াদুদই মূলত সব ছেলেমেয়েকে দিয়ে তালুকদারকে ঘায়েল করতে হবে এই বুদ্ধি তৈরী করে। নিজের ভাস্তে আর ভাস্তিদের ব্যাপারে রতনের স্নেহ থাকলেও লোভের কাছে জীবনের নরম মায়ার মতো অংশ বোধহয় তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে সহসাই। আর তাই তাদের দলেই যোগ দেয় রতনের ভাস্তি জামাই আসলাম আর ইকবালও।
সম্পদের লোভ মানুষকে কতোটা নীচে নামাতে পারে রতন যেন তার এক অন্যতম উদাহরণ। যার ঘরের খাওয়া পরার খরচটুকু এখনো অন্যলোকে চালায় তার গলাতেই ছুরি ধরতেও সে পিছপা হয়না। সম্পর্কের হিসাবগুলো বুঝি এমনই। সমান ভাই রাজা হয়ে গেলে বুঝি নিজের রক্তের ভাইদের ও চোখ টাটায়।
–ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস
চলবে….