অনুধাবন ( ২১ তম পর্ব )

( নাজমা)

সেদিন মধ্য বিকাল থেকে কত রাত পর্যন্ত আমি ঘুমিয়েছি তা বোধহয় নিজেও জানি না। ঘুম ভেঙে কতক্ষণ থম ধরে বসে ছিলাম। ঘরের ভেতর কেমন আলো আঁধারি অন্ধকার। বাইরে থেকে একটু পরপর শব্দ আসছে। কোন ঘড়ি নেই হাতে, কয়টা বাজে, কোথায় আছি বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লেগে গেল। বাথরুমে যাওয়া দরকার, ক্ষিদে লেগেছে কিন্তু রুমের কোনদিকে কি তাই তো মনে নেই। কোন উপায় না পেয়ে খাটে চেপে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। মাথায় শুধু আসছিল রাতে হওয়া এতো শব্দে শহরের লোকগুলো ঘুমায় কি করে? আমার কাপড়ের খসখস শব্দে কিংবা হয়তো আমার নড়াচড়ার কারণে আমার পাশের বিছানার জন উঠে বসে।

আমি নিপা। আপনার নাম শুনেছি নাজমা। এতো বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন অসুস্থ কি না ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। ঘুম কি ভেঙেছে পুরোপুরি?

আধো অন্ধকারে নিপা নামের মেয়েটার গলার উদ্বিগ্নতা আমায় ভীষণ আপ্লুত করলো। কেউ কখনো এভাবে আমার খোঁজ নেয়নি কি না। জানালাম, আমি ঠিক আছি। কোনদিকে বাথরুমটা তাই বুঝে উঠতে পারছি না।

এবার নিপা মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বিছানার পাশের লাইট টা জ্বেলে দিল। কি মিষ্টি একটা মুখ। নাকী আমার প্রতি তার গলার কোমলতাটুকু তাকে আমার চোখে মিষ্টি রূপে দেখাচ্ছে, কে জানে?

আপনার জন্য রাতের খাবার এনে রেখেছি। আপনার বিছানার পাশের টেবিলে ঢেকে রাখা আছে। আমাদের আরেক রুমমেট বাড়ি গেছে। ফিরবে সামনের সপ্তাহে। আমার খুব সকালে বেড়িয়ে যেতে হবে। আপনি আপনার পাশের লাইট জ্বালিয়ে কাজ করলে আমার অসুবিধা হবেনা।

বাথরুম থেকে ফিরতেই বুঝলাম, আমি ভীষণ রকমের ক্ষুধার্ত। নিপা নামের ওনার অসুবিধা হবে ভেবে আর বাতি জ্বালাইনি। বাইরের থেকে আসা আলো ততক্ষণে অনেকটাই ভেতরের অন্ধকার কাটিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা নেতিয়ে পরা ভাত তরকারী একটু একটু করে মেখে খেতে খেতে মনে হলো যেন অমৃত খাচ্ছি। একই সাথে আবারো নিজের অনিশ্চিত জীবনের কথা মনে করেই চোখ বুঝি ভিজে উঠলো। মানুষের মন একই সাথে কত কিছু যে ভাবতে পারে। এতো ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও কয়েক গ্রাসের বেশী আর খেতে পারিনি। সারাক্ষণ শুধু একটাই চিন্তা হচ্ছিল, রুবাই নামের উনি আসবেন তো সকালে? না এলে আমি কোথায় যাবো, কি করবো ভেবে কেমন যেন দিশেহারা লাগছিল। আর ঘুমুতে না পেরে শুধু শুয়েই ছিলাম। বোধহয় চোখও লেগে এসেছিল। রোকসানা নামের সেই খালার ডাকে উঠে শুনি আমার ভিজিটর নীচে অপেক্ষা করছে।

খুব একটা পর্দা নিয়ে মাথাব্যথা কখনোই ছিল না, গ্রামের লোকের কথা আর কিছু লোকের কুনজর থেকে নিজেকে দূরে রাখা ছাড়া। তবু এই শহরে আমার বেশভূষাটুকু আড়াল করতেই বুঝিবা নিজেকে আবারো আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে ফেলি।

রুবাই সাহেব নিয়ে গেলেন আমার কলেজে। কাছেই আমার হোস্টেল থেকে, হেঁটে যাওয়া যায় দেখেই বেশী খুশী লাগলো। পাশেই রয়েছে অনেক দোকানপাট। চাইলেই কারো দিকে না তাকিয়ে নিজের যা লাগবে কিনে ফেলা যাবে ভেবে বেশ স্বস্তি লাগছিল। সেদিন ক্লাস ছিল না তাই শুধু চারদিক দেখে আসা। রুবাই সাহেব তো আর রোজদিন আসতে পারবেন না আর ওনার ই বা কি এমন ঠেকা লেগেছে রোজ রোজ এসে বসে থাকার।
ফেরার পথে সেদিন আর তেমন জড়তা ছিল না। হয়তো বা নিজের থাকার জায়গা, পড়ার জায়গা চেনা হয়ে গেছে ভেবে খুশীতেই সব জড়তা কেটে গিয়েছিল। হোস্টেলের পথে তাই স্বাভাবিকভাবেই কথা হয়েছিল অনেকটা সময়।

নাজমা, চা খাবেন? সকালে চা না খেলে আমার কোন কাজে মন বসেনা। ঐ বাড়িতে ফুলীর মা কাজ করে যে আমার সকালের চা টা মনে করে দেয়। ফুলীর মা অসুস্থ তাই আমি আজ সকালে চা খেতে পাইনি।

মেয়েছেলেরা বুঝি এখানে হোটেলে বসে ছেলেদের সাথে চা খায়? লোকে দেখলে কি বলবে?

এটা ঢাকা শহর নাজমা। এখানে লোকে অন্যের কথা শোনার জন্য বসে থাকে না। সবাই যার যার পথে দৌড়াতে ব্যস্ত।

চা এর জন্য যেখানে বসলাম সেটা ভীষণ ব্যস্ত একটা হোটেল। চারদিকে লোকে খাচ্ছে, গল্প করছে, হুটহাট বের হয়ে যাচ্ছে; যেন জীবন নামের ঘোড়া। নিজেকে কেমন বেখাপ্পা তালহীন মনে হচ্ছে এসবের ভীড়ে।

আপনি বুঝি ওদের বাড়ির জায়গীর মাস্টার? আপনি কিসে পড়াশোনা করেন?

কতক্ষণ লাগলো বুঝি রুবাই সাহেবের আমার প্রশ্ন বুঝতে। তার পরপরই হো হো করে হেসে উঠলেন।

হুম তা অবশ্য বলতে পারেন। আমার বাবা মা কেউ নেই। এর বাড়ি ওর বাড়ি জায়গীর থেকে থেকেই এতোদূর এসেছি। আপনার লোকাল অভিভাবক রফিক সাহেব গ্রাম সম্পর্কে আমার চাচা লাগেন। একবার আমার কলেজের সমাপনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালের অনুরোধে আমার খানিকটা ভার উনি নেন। আর পড়ালেখা, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছি। ওনার বাসায় থাকি, ওনার ছোট ছেলেটাকে পড়াই, রোজ দিনের টুকটাক কাজ করে দেই বিনিময়ে থাকা খাওয়া আর মাসে নামকাওয়াস্তে কিছু হাত খরচ জুটে যাচ্ছে। আরো দুটো টিউশনি করি। আমি একা মানুষ, টাকা জমাই। যখন বিসিএসের জন্য পড়বো তখন যেন কাজ না করলেও চলতে পারি। এই হচ্ছে আমার ইতিহাস। আপনার ইতিহাস কি শুনি। ও অবশ্যই আপনি যদি বলতে চান। আপনার ব্যাংকের কাজ করে দেওয়ার সময় দেখলাম তালুকদার নামে জনৈক ভদ্রলোক প্রায় আপনার এক বছরের থাকা খাওয়া ও পড়ালেখা বাবদ খরচের একটা এমাউন্ট জমা দিয়ে রেখেছেন। আপনার আত্মীয় বুঝি?

কি জবাব দেওয়া যেত এই প্রশ্নগুলোর? এটাতো ঠিক উনি এখনো কাগজে কলমে আমার আত্মীয়। কিন্তু চিঠিতে পাঠানো সতর্কতা বাণী যে বলে দেয় এ প্রসঙ্গে কোন কথা বলা নিষেধ। আপাতত এক বছরের জন্য সব কিছু মিলেছে খামোখা লোক শুনিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার কোন মানে অবশ্যই নেই। হাসিমুখে জবাব দিলাম, ঐ ওরকমই। আর আমার ইতিহাসও খুব একটা চমকপ্রদ কিছু নয় যে আপনার শুনতে বা আমার বলতে ভালো লাগবে। বাদ দেন সেসব কথা। আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার আর কি কোন ব্যবস্থা আছে? না মানে, কোন ঝামেলা বা বিপদে পরলে; আমার আসলে ঢাকা শহরে তো আর কেউ নেই।

রফিক সাহেবের বাড়ির ফোন নাম্বার আপনার লোকাল অভিভাবকের বাসা হিসাবে দেয়া আছে। কোন দরকারে ওখানে ফোন দিলে আমাকে পেয়ে যাবেন আশা করি আগামী আরো এক দু’ বছর। মাস্টার্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসলে কোথাও নড়তেও পারবো না। আমি মাসে দু মাসে এসে না হয় খোঁজ নিয়ে যাব। তবে কি জানেন নাজমা, যত তাড়াতাড়ি নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নেবেন ততই আপনার জন্য মঙ্গল। লজ্জা পাই, বুঝিনা কি করবো; এসব শব্দ বোধহয় সব মানুষের জন্য না। অন্তত আমি জীবনকে ওভাবেই দেখি। আপনার কি কোন কেনাকাটা করতে হবে? হোস্টেলে থাকতে তো অনেক কিছু দরকার হয়। চাইলে আমি আজ সাহায্য করতে পারি। নয়তো দেখেছেন তো দোকান পাট আশেপাশেই আছে কিনে নেবেন। আর আপনার কলেজের কাছেই আপনার ব্যাংকের শাখা আছে। চা শেষ; চলুন উঠি আজ।

কথায় কথায় এতো ব্যস্ত ছিলাম কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। এতো কথা কেউ কখনো আমার সাথে মা বাবার পরে বলেছে বলে মনে হয়না। বাকী পথটুকু চুপচাপই হেঁটে এসেছি সেদিন।

………….

এ সপ্তাহের শেষেই আমার ক্লাস শুরু হবে। তাই আপাতত অখন্ড অবসর। এখানে সবাই দেখি সালোয়ার কামিজ পরে। একমাত্র আমিই জবরজং শাড়ি পরে ঘুরি। দুপুরে খেতে যেয়ে এক দুজনের সাথে কথা হয়। কিন্তু সবার মধ্যেই একটা কেমন তাড়াহুড়া যেন খাওয়ার সময় দুটো কথা বললেও সময় নষ্ট হয়ে যাবে। নিজে খেতে খেতেই ভাবি, আমার নিজেকেই নিজে পরবর্তী সংগ্রামের জন্য তৈরী করতে হবে। আর তার জন্য যে যাই বলুক বা ভাবুক লোকের সাথে কথা বলতেই হবে। নিজের বেশভূষা খানিক না পাল্টালে অবশ্য সবাই গ্রাম্য ক্ষ্যাত ভেবে পাত্তা দেবেনা। কেন যেন মনে হলো নিপা আপার কথা, উনি হয়তো এসব ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন। উনি ব্যস্ত থাকেন ভীষণ। দেখা প্রায় হয়ই না বলতে গেলে। আরেক রুমমেট এখনো ফেরত আসেনি। কেন, কে জানে? অবশ্য কেউ সাহায্য না করলেই কি? নিজের পথ তো নিজেকেই তৈরী করতে হয়। রুবাই সাহেবের কথা আবারো মনে হলো, কোন চাল চুলো ছাড়াও শুধু নিজের যোগ্যতা দিয়ে এতোদূর চলে এসেছেন। কি সুন্দর ভবিষ্যতের সব প্ল্যানও তৈরী করে রেখেছেন।

জীবন বোধহয় এমনই। কাউকেই কিছু আগ বাড়িয়ে দেয়না। সময়, সুযোগ, অবস্থানের ভিত্তিতে নিজেই জোর করে ছিনিয়ে নিতে হয়। বাড়ি থেকে যখন বাইরে পা রেখেছি নিজের জীবনের হিসাব এখন থেকে নিজেকেই তো বুঝে নিতে হবে।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2217431905212148/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *