অনুধাবন ( ২৩তম পর্ব )

তালুকদার তার ব্যবসায় এতোদূর ভালো করার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ বোধ করি তার অহিংস নীতি। কারো সাথেই কখনো সরাসরি ফ্যাসাদ জড়ানোতো দূরে থাক, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থাকে তার সবসময়ই। হাসির সাথে বুদ্ধির খেলায় লোক হারানোকে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মনে হয়। তার সহযোগী ওয়াদুদও এভাবেই লোকজন ম্যানেজ করতো বিধায় ব্যাপারটা সহজ হয়েছিল তালুকদারের জন্য। মফস্বল বা গ্রাম এলাকায় ব্যবসা চালাতে গেলে কিছু দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়ই। সেজন্য প্রতিপত্তি সম্পন্ন মানুষদের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী থাকে। তালুকদার ও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তালুকদার অবশ্য মারামারি, মানুষ খুন এসব ব্যাপারে নিজের লাঠিয়াল বাহিনীকে জড়ান না তেমন একটা। সামান্য কথার মারপ্যাচ বা বড়জোড় লুকিয়ে চুরিয়ে সামান্য মারধোরই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যথেষ্ট মনে হয় তার কাছে। অন্তত এ পর্যন্ত এর বেশী দরকার হয়নি নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে। খুব বেশী শক্ত কোন ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী এ এলাকায় তেমন নেই। তাই তার ঘর ও বাইরের ঘটানো বিপদ যে তার নিজের ঘরের লোকের কাজ এটা বুঝতে তাকে কোন বিশিষ্ট গোয়েন্দা হতে হয়নি। তার এতোদিনের অভিজ্ঞতা আর জহুরীর চোখ বলে, আড়তের গুদামে আগুন ওয়াদুদ আর রতন মিলে দিলেও লিমার ঘরের ভেতরের কাজটুকু করেছে আসলাম। রতন আর যাই করুক রাসেলের বাচ্চা বা বৌয়ের ক্ষতি করার মতো পাষন্ড এখনো হয়ে যায়নি। এরকমই তালুকদারের বিশ্বাস। খুব সম্ভবত ঐ অংশটুকু রতন থেকে লুকিয়ে রেখে করা হয়েছে। এই সামান্য আগুনের ধ্বংসে তালুকদারের এতো বড় সাম্রাজ্যের সিকিভাগের ক্ষতিও হয়নি। কিন্তু অপর পক্ষ যে হুমকিটুকু দিল সেটা এ বেলা অগ্রাহ্য করলে এটা শতগুণে ফেরত আসলেও অবাক হবার কিছু নেই। এই ব্যাপারটাই তালুকদারকে স্বস্তি দিচ্ছেনা মোটেও। বাসার তিনজন লোক হাসপাতালে এখনো। সেদিন কোন কারণে আরেকটু দেরী হলে লিমা বা তালুকদার বাড়ির বংশধরের কত বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো সেটা ভেবে এতো সাহসী তালুকদারেরও বুঝি বুক কেঁপে ওঠে। বাসার ভেতর যে আরো মনোযোগী হওয়া বা পাহারার লোক জোরদার করা উচিত ছিল এটা আসলে তারই বোঝার ভুল।

তালুকদার খুব সন্তর্পনে ওয়াদুদের থেকে জিনিসপত্র বা যা যা সে জানতে পারে সেই প্রমানাদি গত কয়েক মাসেই একটু একটু সরাচ্ছিল। তার ইচ্ছে ছিল সব মোটামুটি গুছিয়ে একদিন হঠাৎ করে ওয়াদুদকে জানিয়ে দেবে তাকে আর তার নিজের ব্যবসায় প্রয়োজন নেই। সেই ভাবনায় ওয়াদুদকে কাজে ঠিকই বহাল রেখেছিল। কিন্তু কারো মাথার ভেতরে আসলে কতটুকু ঢোকানো থাকে তা তো আর পড়ে ফেলা সম্ভব না তাই একটা সময় ওয়াদুদ ঠিকই টের পেয়ে যায় তালুকদার যে তাকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিচ্ছে। সারা বছরের ফসলী জমি থেকে এটা ওটা ঘরের খোরাকী এলেও তালুকদারের আড়ত থেকে পাওয়া টাকাতেই ওয়াদুদের তখনও সংসার চলছিল। কিন্তু জুয়ার ঠেকে ঋণ শোধ করতেই তাকে তালুকদারের প্রতিপক্ষ হতে বাধ্য করে নয়তো কোনভাবেই যে বাড়তি টাকা পাওয়া সম্ভব না। নিজেদের জানা মতের অনেকগুলো জমির দলিল যে ইতিমধ্যে তালুকদারের দখলে। একবারও তার কেন যে মনে হয়নি তাদের পতনের দিনগুলোতে এই তালুকদারই ঠেক দিয়ে রেখেছিল। তাদেরকে পথের ফকির চাইলে তখনই করে দিতে পারতো। কিন্তু মানুষ নিজের অতীত বা অতীতের করা কারো সাহায্য বোধহয় সহসাই ভুলে যায় নয়তো আর যাই হোক নিজের জীবনের উদ্ধারকর্তার পেছনে ছুরি হাতে দাঁড়ানোকে কি উপাধিই বা দেয়া যায়? লোকে বলে তুমি যার জন্য করবে সে ই তোমাকে ঘুরে এক হাত দেখে নেবে, কাজেই লোকের জন্য করতে সাবধান। তালুকদারের হয়েছে সেই দশা। পুলিশের তদন্তে চাইলেই সে লোকগুলোকে ধরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সব যে তার নিজের ঘরের লোক এদেরকে কিভাবে ধরিয়ে দেবে তাই যে বুঝে উঠতে পারেনা। পুলিশকে তাই নিজের মতো তদন্ত চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে, কারণ এতে করে আপাত আর কোন সহিংসতা অপর পক্ষ করার সুযোগ পাবেনা আর তার সুবাদে নিজে হয়তো খানিকটা গুছিয়ে নেয়ার সময় পাবে। অনেক চিন্তা ভাবনা শেষে তালুকদার সিদ্ধান্তে নেয় ওয়াদুদের সাথে কথা বলার। ওয়াদুদ, রতন আর আসলাম শেষ কয়েকদিন নিজের বাড়িতেই আছে এমন খবরই পেয়েছেন তালুকদার।

ওয়াদুদ বাড়িতে আছিস? একটু বাইরে আয়। তোর সাথে কথা ছিল। “জ্বী তালুকদার সাব, আপনে এতো রাইতে? ভেতরে আসেন। বাইরে আপনের ঠান্ডা লাগে যদি। শীতটা এইবার যাইতাসেই না।” “আমার সারাদিনই গরম লাগেরে ভাই, বাইরেই আমার জন্য ভালো। তুই বাইরে আয়, একটু কথা বলি।”

ঘরের কাপড়ে বেরিয়ে আসা ওয়াদুদের দুহাতে একটু তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে নিতে ভোলেন না তালুকদার সাহেব, কাউকেই যে এখন আর বিশ্বাস নেই। যদিও তার নিজের লোক আশেপাশেই আড়ালে লুকানো আছে। সে রাতের পর থেকে উনি লোক ছাড়া বের হন না। রাসেল আর লিমা দায়িত্ব বুঝে না নেয়া পর্যন্ত ওনার এই সাম্রাজ্য যে উনি টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর। শুধু সৃষ্টিকর্তা সুস্থ আর বাঁচিয়ে রাখলেই হলো।

ওয়াদুদ, তুই যখন খুব ছোট ছিলি তুই আর রতন মিলে প্রায়ই আমার ঘরের জিনিসপত্র খেলার ছলে উল্টাপাল্টা করতি। আমি হাসিমুখে মেনে নিতাম, থাক ছোট ভাই করসে। তোকে আমি আমার ছোটভাইয়ের মতই জানসি সবসময়। তোদের বিপদে আপদে যখনই দরকার হইসে নিজে দৌড়ায়া আসছি। তোর বাপ মানে চাচায় মরার পরে আর কেউ ঘুইরা না তাকাইলেও আমি খেয়াল রাখসি যেন তোদের খাওয়া পরার কোন সমস্যা না হয়। সত্যি কথা কি না বল?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওয়াদুদ জবাব দেয়, জ্বি সত্যি কথা।

তাইলে তুই বা তোর লোকেরা আমার ঘরের ভিতরে হাত দিলি ক্যান, ক তো দেখি? আমার রাসেলের জীবন প্রায় শেষ করছস, আমার একটু বেখেয়ালে। আমি মাইনা নিসি, বিপদ আইসে আমার উপরে; রাসেলেরও দোষ আছিল। তাও তোরে কিছু কই নাই।কিন্তু এইবার আমার পোয়াতি পোলার বৌডার উপরে এমন একটা কাম কেমনে করলি ওয়াদুদ? আমি তো কখনো তোরে নির্বংশ করার কথা চিন্তাও করি নাই।তোর বৌ পোলা নিয়া তুই সুখে থাক এর বাইরে কিছু চাইসি?

বলবেনা বলবেনা করেও ওয়াদুদ বলে ফেলে, সামনে ক্ষতি ঠিকই করেন নাই কিন্তু জমিগুলানের দলিল সবতো নিজের নামে ঠিক ঠিক কইরা নিসেন সেইটা অস্বীকার যাইতে পারেন? আপনের ক্ষতি আমি করা লাগবো না। আপনের পাপের শাস্তি আপনে নিজে নিজে সময়মত এমনেই পাইবেন। আমার জায়গা আমারে ফেরত দেন আমিও আপনার ত্রি সীমানা ঘেষুম না আর কথা দিতাসি। “তোর কাছে যা কাগজপত্র আছে নিয়া আসিস আদালতে। কাগজে কাগজে উকিলে উকিলে কথা হইবো। কাইল থেইকা আর তোর আড়তের কামে আসার দরকার নাই। এই কথাটাই বাড়ি বইয়া আইসা জানায়া গেলাম।”

তালুকদারের এই কথায় রাগের মাথায় ওয়াদুদ জবাব দিয়ে দিল, আপনের আড়তে কাম না করলেও এই ওয়াদুদ চলতে পারে। ঠিক আছে আমি উকিল দিয়াই আপনের কথার শোধ নিমু।

ওয়াদুদের শেষ কথা দাঁড়িয়ে থেকে আর শোনার মত ধৈর্য্য হয়না তালুকদারের। ফেলে দেয়া ব্যাপার বা মানুষের ব্যাপারে মাথা ঘামানো তার কখনোই পছন্দ না। এতে করে পিছিয়ে পড়তে হয় জীবনের দৌঁড় থেকে। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সব ব্যাপারেরই আসলে ভালো এবং মন্দ দুটো দিকই আছে। এই যে তালুকদার পরিবারে এমন একটা বড় সড় বিপদ এলো তাতে তার সাময়িক কিছু ক্ষতি হলেও টাকা আর সৃষ্টিকর্তার রহমতের জোরে প্রায় পুরো ব্যাপারটাই তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই ঘটনার সুবাদে ওয়াদুদকে নিজের আড়ত থেকে বের করে দেয়া তার জন্য অনেক বেশী সহজেই হয়ে গেল। অথচ রাসেলের এতো বড় ক্ষতির পেছনে ওয়াদুদের প্রত্যক্ষ হাত আছে জানার পরেও তিনি কিছুতেই ওকে সরিয়ে ফেলার কোন উপায় পাচ্ছিলেন না তখনো কারণ ওয়াদুদ তালুকদার বাড়ির অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপারেও জড়িত ছিল। এমনকি নিজের ছোট মেয়ের বেয়াই বাড়ির আত্মীয় হিসাবটুকুও ছিল। কিন্তু নিজের উত্তরাধিকার রক্ষার প্রশ্নে এ বেলা আপোষহীন হওয়া ছাড়া কোন উপায় তার আর ছিল না। নিজের ভবিষ্যতের ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে মনে হলো একটু আজিজের খবর নিয়ে যাওয়া যায়। আড়তের গুদামে আগুন লাগা, বাড়িতে এতো বড় বিপদে তালুকদার যখন একটু দিশেহারা ছিলেন আজিজ মিয়া আর ম্যানেজার একা হাতে ব্যবসা, পুলিশ সব কাজ সামলেছে। আজিজ মিয়ার বাড়ি কোথায় জানলেও আগে আর কখনো আসা হয়নি তালুকদারের। বাড়ির সীমানা এতো বড় হবে আশাও করেননি অবশ্য। কোনদিক দিয়ে দরজায় টোকা দেবেন বুঝতে না পেরে বাড়ির উঠোন থেকেই তাই গলা উঠান,

আজিজ মিয়া, বাড়িত আছো নি? আমি তালুকদার। তোমার একটু খবর নিতে আসলাম।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *