অনুধাবন ( ২৪তম পর্ব )

কথায় বলে অনেক বেশী কাজের চাপ থাকলে লোকে মনের জোরে সেই কাজ কিভাবে কিভাবে জানি শেষ করে ফেলে। কিন্তু যেই কাজের সাহায্যকারী চলে আসে শরীর তখন ছেড়ে দেয় একেবারে। আজিজ মিয়ার হয়েছে সেই দশা। গত কয়েকদিনের অতিরিক্ত কাজের চাপে আজিজ মিয়া দিশেহারা হলেও সামলে নিয়েছে। কিন্তু আজ থেকে যেই তালুকদার সাহেব ফিরে এলেন সারাদিনভর ভীষণ ক্লান্তবোধ করেছেন তিনি। এমনকি কাজ থেকে বেশ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে এসেছেন। রাতের খাবার খেয়ে একটু সকাল সকালই শুয়ে পড়েছিলেন। ওনার মেয়ে রোশনী বা বৌ রোমেনা যদিও জেগে ছিল তখনো। তালুকদার সাহেবের গলার স্বর আজিজ মিয়ার কানে গেলেও স্বপ্ন ভেবে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে মনে হলো, আসলেই কি স্বপ্ন দেখেছেন? তখনই ত্রস্ত পায়ে রুমে এলো রোমেনা বেগম।

বাইরে তালুকদার সাবের গলা, আপনে শুনছেন?হুট করে ভেঙে যাওয়া কাঁচা ঘুম আর রোমেনা বেগমের গলার স্বরের উৎকন্ঠায় পুরোপুরি ঘাবড়ে গেলেন আজিজ মিয়া। সম্বিত ফিরে পেতেই বলে উঠলেন, ‘রোশনী কই? ওর দরজার বাইরে শিকল দেও। আমি দেখতাসি কি হইসে।’ রোশনী যদিও ঘুমিয়ে পড়েছিল তাও অতি সাবধানতার জেরে রোমেনা বেগম দরজার খিল লাগিয়ে রোশনীর পাশেই বসে রইলেন। পাছে মেয়ে উঠে যেন কোনভাবেই ঘরের বাইরে না যায়।

তালুকদার সাব, আপনে এতো রাইতে আমার বাড়িতে। আমারে ডাকলে আমিই তো যাইতাম। কোন সমস্যা না তো? আপনে একা একা রাইত বিরাইতে বাইর হওয়া ঠিক হয় নাই, মাত্র এতো বড় বিপদ গেলো আপনের উপর দিয়া। আমার কথা বাদ দাও আজিজ। তুমি তাড়াহুড়া কইরা আজকা আড়ত থেইকা চইলা আসলা। এই পথ দিয়া ফিরতাসিলাম। মনে হইলো তোমার একটু খোঁজ নিয়া যাই। তুমি আর ম্যানেজার সাব এই কয়দিন যেমনে পুরা আমার ব্যবসা সামলাইলা, আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। কি কন এইসব, আপনে? আপনের নুন খাই, আপনের বিপদে পাশে না দাঁড়াইলে কেমনে? ঘরে আসেন। রাইতের খানা খাইবেন। না না আজকা না। রাইত হইসে অনেক। বাড়ি ফিরতে দেরী হইয়া যাইবো। তোমার বাড়িতো ভালো বানাইসো। বেশ বড়সড় আছে। তোমার বৌ মাইয়া আছে কেমন?

এই প্রশ্নে যেন একটু সিঁটিয়ে গেলেন আজিজ মিয়া। ঘরের সদর দরজার দিকে বারংবার তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ওরা সব ভালোই আছে। ঘুমায়া গেছে সব। রাইত হইসে তো ম্যালা।তাগোরে নিয়া একদিন আমার বাসায় আসো। একলগে ডাইল ভাত খামু। তুমি তো কখনোই লাগে তাগোরে নিয়া আসো নাই আমার বাড়িতে। আপনে যখন কইসেন তখন তো আসুমই। চলেন আপনেরে আগায়া দেই একটু।

না আজিজ, আমার অন্ধকার রাস্তায় হাঁইটা অভ্যাস আছে। সারাজীবন তো একলাই হাঁটসি। তুমি বরং বাড়িত গিয়া ঘুম দ্যাও। শরীর ভালো না লাগলে কালকেও ছুটি নেও। আরেকটা কথা, ওয়াদুদ রে কালকে থিকা কাজে আসতে না করসি। কাজেই বুঝতে পারসো তোমাগো উপর আরেকটু কাজের চাপ বাড়বো আর কি। গেলাম তাইলে। তালুকদারের গমন পথের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা শ্বাসটা বেশ জোরেই ছাড়লো আজিজ মিয়া। ভাগ্যিস বাড়িতে বসতে চায়নি তালুকদার। নিজের ঘরে এসে দোর দিয়েও যেন মনে হলো বিপদ বুঝি কাটেনি। বৌ মেয়ের কথা জানতে চাওয়াতে আজিজ মিয়ার হঠাৎ দারুনভাবে চমকে ওঠা নজর এড়ায়নি তালুকদারের। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না এরকম চমকে ওঠার কি কারণ থাকতে পারে। অবশ্য গ্রামের লোকের অনেক রকম খেয়ালী ব্যাপার আছে। সাথে আছে পর্দা পুষিদার ও ব্যাপার। মনে করে লোকে বুঝি তাদের বৌয়ের দিকে নজর দিয়ে ফেললো; তাতে করে স্বামী হিসেবে তার না আবার বেহেশত ছুটে যায়। নিজের চোখ চরিত্র সামলানোর খবর নাই, অন্যকে সামলে নিজের আব্রু রক্ষা। সার্বিক বিবেচনায় পুরো ব্যাপারই দারুন হাস্যকর হলেও কেউ যদি ঐ ভেবে শান্তিতে থাকে তবে কার কি যায় আসে ভেবে কেউ ঐ দিকে তত মাথা ঘামায়না। তবে লোকমুখে শোনা আজিজ মিয়ার মেয়েটা নাকি পালক মেয়ে। সেই কারণেও হয়তো কোথাও নিয়ে যায়না। মানুষের যেই স্বভাব, যার যা দুর্বল জায়গা ঐখানে খোঁচা দিয়া কথা না বললেতো অনেকের পেটের ভাতই হজম হয়না। সাধারণত প্রতি বছর দু থেকে তিনবার তার ব্যবসা ও আড়তের সব স্টাফদের তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তালুকদার কিছুতেই মনে করতে পারলেন না আজিজ কখনো তার বৌ বা মেয়েকে নিয়ে তার বাড়ির দাওয়াতে এসেছে কি না। কিন্তু আজিজ মিয়ার কথায় বা কাজে তো তাকে কখনো তেমন ধর্মান্ধ মনে হয়নি। কি জানি বাপু, অন্যের বৌ মেয়ে নিয়ে অতশত ভেবে কি কাজ বলে জোর করেই মাথা থেকে সে চিন্তা সরিয়ে দিতে চাইলেন তালুকদার। চারদিকে সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখতে দেখতে সামান্য অস্বাভাবিকতাও বড় বেশী চোখে লাগে যেন। মাঝে মাঝে এমন হয় চাইলেও কিছু আলতু ফালতু ভাবনা এসে মাথায় ঢুকে পড়ে যেটা হয়তো সে সময় না ভাবলেও চলতো। তারপরও এই আবছা চাঁদের আলোয় একাকী পথ চলতে চলতে তালুকদারের নিজের অতীত জীবনের কথা মনে পরে যায় কেন যেন বারবার। মেয়েমানুষের দোষ তার কখনোই ছিলনা সেভাবে। শুধু টাকা আর সম্পদ বৃদ্ধির দিকেই মনোযোগ ছিল সবসময়। নিজের কাড়ি কাড়ি টাকা আর জমি থাকবে এমন স্বপ্ন কেন যে ছোটবেলা থেকেই দেখতো তা সে নিজে ও জানেনা। সে জন্য নিজের যত রকম কূটচাল করতে হয় সবই সে করে কারণ তার কাছে জীবন মানেই অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া। কিন্তু ঐ যে লোকে বলে চলার পথে কখনো মন থমকে যায়, ইচ্ছে হয় নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে অন্য কোন বা কারো জীবনে ঢুকে পরতে বা একঘেয়ে জীবন থেকে বৈচিত্র্যের আশায় কিছুটা সময় কাটাতে তখনই বোধহয় লোকে জীবনের অদ্ভুত রকমের ভুল গুলো করে বসে। যেটা স্বাভাবিক সময়ে করার কোন কারণ নেই। তালুকদারের জীবনেও এমন একটা দিন এসেছিল। প্রায় বছর পনের আগের কথা, তখন মোটে তার নিজের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। ছেলেমেয়ে বৌ নিয়েও ভরভরন্ত সংসার। রোজ রাতে বাড়ি ফেরার হয়তো সময়ও মিলতো না ব্যস্ততার জন্য। ঘরের বৌয়ের ছিল তালুকদারের ওপর অগাধ বিশ্বাস। কোনদিন চরিত্র নিয়ে কোন ঘটনা কানে মুখে না হলে বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই দিন শেষ বিকেলে প্রায় দিন তিনেক পরে বাড়ি ফিরছিলেন। ব্যবসার কাজে আটকে গেছিলেন দূর শহরে। হঠাৎই পা ও চোখ দুটোই আটকে যায় পুকুর থেকে পানি নিয়ে ফিরতে থাকা এলোচুলের এক দীর্ঘাঙ্গিনীর অবয়ব দেখে। শেষ বিকেলের কন্যাসুন্দর আলোয় সেই নারীর রূপ যেন ঠিকরে পড়ছিল তার প্রতিটি পদক্ষেপে। খবর নিতে সময় লাগেনি মোটেও। মোটামুটি ক্ষেতির কাজ করা জনৈক গৃহস্থের কন্যা। তার পরের ব্যাপার গুলো ঘটে যায় ঠিক সেভাবে না চাইতেই। আজীবন অন্তত চরিত্রের দিক থেকে শুদ্ধ থাকা তালুকদার ও পঁচা শামুকে পা কাটেন। তার পরবর্তী দুই রাতও আর বাড়ি ফেরা হয়না। আড়তের পেছনে তার নিজের থাকার একটা জায়গাতেই কাটে দুদিন। কথায় বলে প্রতিপত্তি যাদের থাকে তাদের গায়ে বোধহয় কলংক বা বদনাম সেভাবে না লেগে থেকে পিছলে যায়। কিংবা তারা জানে কেমন করে অঘটনকে রটনা বলে চালিয়ে দিতে হয়। শুধুমাত্র ওয়াদুদ ছাড়া আর কেউই জানার কথা না সে সময়ের কথা। পরবর্তীতে মনে সামান্য অনুতাপ হওয়ায় আড়ালে আবডালে মেয়েটার খোঁজ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেন ভোজবাজির মতো পুরো পরিবার হারিয়ে যায় গ্রাম থেকে সপ্তাহ না মিলাতেই। তালুকদারও বাড়তি কোন ঝামেলা এড়ানোর আশায় ভুলে যেতে চেয়েছেন বা ভুলেই থাকেন সেই ঘটনাটুকু। তারপরও কোন একলা রাতে বিবেকের কাছে বুঝি খানিক দংশনে পোড়েন বলেই ঐ স্মৃতিটুকু না চাইতেও চোখের সামনে হুটহাট চলে আসে।

মানুষের মন কত অদ্ভুত! আজিজ মিয়ার আজকের চমকে ওঠা চোখের সাথে নিজের যেন খানিক মিল পেলেন তালুকদার। সে ঘটনার পর নিজের স্ত্রীর চোখের দিকে অনেকদিন ভালোভাবে তাকাতে পারেন নি তিনি। শুধু মনে হয়েছে কিছু একটা ধরা পরে যাওয়ার ভয়। আসমা বেগম অবশ্য কিছুই বুঝতে পারেননি। তালুকদারের মাঝে মাঝে মনে হয় আসমার সাথে নিজের মনের আগল খুলে কিছু কথা কন। কিন্তু বোকা চোখে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি দেখলে আগ্রহই হারিয়ে ফেলেন। কি হতো নিজের বৌ টা একটু চালাক চতুর হলে?

চাচা, আমি কি অহন বাড়িত যামু?

বরকতের কথায় আচমকা হুঁশ ফিরে তাকিয়ে দেখেন বাড়ির প্রায় সদর দরজায় চলে এসেছেন। এতোটা বেখেয়াল তো কখনো হন না তিনি। বয়স কি হয়ে গেছে তাহলে সব কিছু ছেড়ে দেবার?
যা রে বরকত। তোর দাদাকে বলিস, কালকে যেন একটু সকাল সকাল আড়তে আসে। তুই ও পারলে চইলা আসিস। এক জায়গায় যাইতে হইবো কাইল।
বরকত চলে গেলে পরে ইশারায় তার পিছু হেঁটে আসা বাকী দুজনকেও বাড়ি চলে যেতে বলেন। কাল তালুকদার বাড়ীর আনন্দের দিন। রাসেল আর তার বৌ দুজনকেই হাসপাতাল থেকে ছাড়বে। যাবতীয় আপাত বিপদ কেটে যাওয়ায় তালুকদারের মনে বড়ই শান্তি শান্তি লাগছে।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *