অনুধাবন ( ২৬তম পর্ব )

শরীরটা আসলেই ভালো যাচ্ছেনা আজিজ মিয়ার গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। গতকাল রাতে তালুকদারের হঠাৎ আগমনে যেন তা আরো বেড়েছে। থেকে থেকেই বুকের কাঁপুনি কিছুতেই যেন থামছেনা। আজ আড়তে আসবেন না ভেবে সকালের নাস্তা খেয়ে তাই শুয়েই ছিলেন। বরকতের কথা শুনে না এসে পারেন নি। তাও ভেবেছিলেন শেষমেষ হয়তো একটা কোন ব্যবস্থা হয়ে যাবে, উনি বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু ম্যানেজার সাহেব ফোন রাখার পরে আর সে আশা রইলোনা। হাসপাতালে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আসতে দেরী হবে। তারপরও তালুকদার সাহেবের ফোন পাওয়ার পর ম্যানেজার সাহেবই তাড়া দিয়ে দুজনকে গাড়িতে তুলে দিলেন। শীত পেরিয়ে অল্প স্বল্প গরম পরতে শুরু করেছে। বাতাসে একটা গুমোট ভাব। গাড়ির জানালা দিয়ে আসা হু হু বাতাসটুকু থাকাতে তাই খুব ভালো লাগছে আজিজ মিয়ার। যদিও বরকত জানালার পাশে বসার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল। প্রথমে কথা ছিল তালুকদারের গাড়িতে ওরা দুজন যাবে। আবার থানা থেকে আড়ত ঘুরে আজিজ মিয়াদের আনতে দেরী হয়ে যাবে দেখে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। ফেরার পথে ঐ গাড়িতে আসবে একসাথে। একের পর এক গ্রাম আর সবুজ ধানক্ষেত পেরিয়ে যাচ্ছে বাস। আজিজ মিয়াকে সহসা নিজ শহরের বাইরে যেতে হয়না। মোটামুটি কাগজ গোছানো থাকলে তালুকদার সাহেব একাই কোর্ট কাচারির কাজ সামলে নেন। আজ বাসের এই গতির সাথে তাল মিলিয়ে আজিজের হঠাৎ মনে হলো বৌ মেয়েকে নিয়ে একবার শহর ঘুরে এলে বোধহয় মন্দ হয়না। এক কুয়োর ব্যাঙের মতোই যে নিজ অক্ষে জীবন পার করে দিলেন। মেয়েটাকে শহরের বাইরে কোথাও বিয়ে দিতে পারলেও সেই সুবাদে হয়তো নিজেদের যাওয়া আসা হবে। মেয়ের বিয়ের কথা মনে হতেই বুকের ভেতর কেমন হু হু করে উঠে। রোশনী ছাড়া যে তাদের আপন আর কেউ নেই। আজিজ মিয়ার মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে করে তালুকদারকে বলে দেন রোশনীর পরিচয়; এতো দুঃশ্চিন্তা করতে একদম ভালো লাগেনা। কিন্তু যদি তালুকদার রোশনীকে মেরে ফেলেন বা অন্য কোন ক্ষতি করেন। শত হোক রোশনী ওনার জীবনের জন্য একটা কালো দাগের মতো। ওনার মতো লোকেরা গায়ে দাগ লাগিয়ে না রেখে মুছে ফেলার চেষ্টাই করবে। আমেনা বেগমকে গাঁয়ের লোকে তিষ্টোতে না দিলেও বেঁচে থাকলে তালুকদারের রোষানলে পড়তো না সেটাই বা কেমনে বলেন? “ও চাচা, ঘুমাইলেন নি? আমারে জানালার ধারেও দিলেন না, নিজে বাইরে না দেইখা ঝিমাইতাসেন। ঘুমের থে উঠেন পরের স্টপে নামতে হইবো।” একটু বোধহয় ঝিমুনি এসেই গিয়েছিল। ওনারা সাইকেল বা পায়ে হেঁটে চলা লোক, অন্য কেউ গাড়ি চালালে ঘুম তো আসতেই পারে। কিন্তু বরকতকে তা বুঝতে দেয়া চলবে কেন? এ কালের ছেলেপিলের বেয়াদপি মার্কা কথায় যথেষ্ট বিরক্ত হলেও বিরক্তি চেপে রেখেই বললেন, ‘ না ঘুমাই নাই। তুই ঠিক জায়গায় নামতাসোস তো? পরে দেখিস আবার কোন ঝামেলা না হয়।’

বাস স্টপ থেকে হাসপাতালটা বেশ কাছে। হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। কিন্তু গরমের ভাপে ততক্ষনে আজিজ মিয়া ঘেমে নেয়ে একসা সাথে ভীড় করেছে ক্লান্তি। শরীরটা কি এতো বুড়িয়ে গেল? একটা ডাক্তার বুঝি এবার দেখাতেই হবে। রাস্তায় কোন ঝামেলা হয়নি দেখে মোটামুটি ঠিক সময়েই হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। হাসপাতালের দরজায় পৌঁছাতেই দেখতে পেলেন লিমা সাথে একটা কাজের মেয়ে আর কোলের বাচ্চাসহ ততক্ষনে সব গুছিয়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। বরকত গেছে হাসপাতালের হিসাব মিটিয়ে কাগজপত্র আনতে। হাসপাতালের পাশেই ডাব বিক্রি করছিল। আজিজ মিয়ার খুব ইচ্ছে করছিল একটা ডাব খেয়ে সটান কোথাও শুয়ে পড়তে। কিন্তু দায়িত্বের খাতিরে কত ইচ্ছেই না জলাঞ্জলি দিতে হয়। মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসার সুযোগ পেয়ে আজিজ মিয়া যেন বর্তে যান। অন্তত ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যাবে গরমে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা। “আজিজ চাচা, আপনার কি শরীর খারাপ? আপনাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে। পানি খাবেন? চাইলে ঐ যে পাশে ডাব বিক্রী করছে সেটাও কিনে দিতে পারি। ” সৃষ্টিকর্তা বলে আসলেই বোধহয় একজন আছেন যিনি লোকের মনের কথা শোনেন ভেবে আজিজ মিয়া আরো একবার আপ্লুত হলেন। লিমাকে তার মনে হলো সাক্ষাত ফেরেশতা।
হ্যা গো মা, একটু ক্লান্তি লাগছে। আমি বরং একটা ডাব কিনে খাই। আজকে আসলে আমি ছুটিতে ছিলাম। তোমার শ্বশুর থানায় আটকে না গেলে আমার আজ আসতে হতোনা। তোমার জন্য একটা ডাব আনি?

না চাচা আমি ঠিক আছি। আপনি ডাব কিনে এনে গাড়িতে বসে খান। বরকতের আসতে হয়তো খানিক সময় লাগবে।

গাড়িতে বসে এক চুমুক ডাবের পানিতে মনে হলো তার ক্লান্তি বুঝি অনেকটাই কেটে গেল।

চাচা, একটু ভালো লাগছে এখন? আপনি ডাক্তার দেখান কোন। এ বয়সে শরীরের যত্ন নিতে হয়। থানা হাজত এসবের কথা বলছিলেন বোধহয় তখন। কি হয়েছে বলেন তো চাচা?

আমি নিজেও তেমন কিছু জানিনা মা। বরকত যা বললো, পুলিশের বড় অফিসার নাকি তোমার শ্বশুরকে থানায় ডেকেছেন। উনি বেরিয়েছিল হাসপাতালে আসার জন্য। কিন্তু পুলিশের ডাক, বোঝইতো। হুম তা বুঝেছি। আচ্ছা বাড়ি গিয়ে ওনার কাছ থেকেই না হয় শুনে নেব। তা চাচা, আপনার বাড়িতে আর কে আছে? আপনার সম্পর্কে আসলে কিছুই তেমন জানিনা। আজিজ মিয়া এ বেলাও এ প্রশ্নে একটু চমকে উঠে কেশে উঠলেন।
বলার মতো কিছু না গো মা। আমার মেয়ে আর বৌ নিয়া সংসার। আছি আল্লাহ রাখসে। “একবার ওদের নিয়ে আসেন বাড়িতে। কখনোই তো আনেন না।”

তালুকদার বাড়ির হইসে কি? সবাই এক লগে আমার পরিবারের খোঁজে লাগসে।
আসুম আসুম বলতে বলতেই দেখেন জানালায় বরকতের উপস্থিতি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন আজিজ মিয়া।

(লিমা)

একই সাথে ভালো লাগা আর দুঃশ্চিন্তার মিশেল মেশানো মন নিয়ে গাড়ি রওয়ানা দিল রাসেল কে আনতে। নিশ্চয়ই সে রাতের ঘটনা নিয়েই কিছু হয়েছে নয়তো এতো জরুরী তলব থানায় কেন হবে? সম্পূর্ণ নতুন এক রাসেলকে দেখতে পাবো ভেবে মনে কেমন যে একটা অনুভূতি হচ্ছিলো যে দুঃশ্চিন্তাটুকু মনে এসেও আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল সহসাই। আচ্ছা রাসেল ও কি ওভাবেই কিছু ভাবছে?
গাড়ি হাসপাতালের দরজায় থামতেই আমি বাবুকে সাথের মেয়েটার কোলে দিয়ে নিজেই নেমে এলাম রাসেলকে নিয়ে আসতে। সত্যি বলতে কি ওকে এক নজর দেখার ইচ্ছে কিছুতেই যে সংবরন করতে পারছিলামনা।

( রাসেল)

বাড়ি ফিরবো নিজের ঘরে সম্পূর্ণ নতুন আমি, দেখা হবে আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে, আমার নতুন সত্ত্বার সাথে। কতদিন পর মা কে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবো। কাল সারারাত এপাশ ওপাশ করে কেটেছে উত্তেজনায় কখন সকাল হবে। সব কিছু রাত জেগে গুছিয়েই রেখেছিলাম। ঘড়ি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো সময় যেন আটকে গেছে কোথাও। সকালের ওয়ার্ড বয় এসে যখন জানালো আমাকে নিতে আসতে দেরী হবে, বাবা কি কাজে আটকে গেছে এমন অভিমান হলো; সেই ছোটবেলার মতো। আমার কোন কিছুর সময়ই তার কোন না কোন কাজ পরে যেতেই হবে। কি হতো আজ কোন কাজ না রাখলে? রাগে দুঃখে সকালের নাস্তা না খেয়েই আবার শুয়ে গেছিলাম। রাতে ঘুম না হওয়াতে ঘুমও বুঝি এসে গিয়েছিল। একটা কোমল অথচ পরিচিত হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকিয়ে লিমাকে দেখবো সেটা মোটেও ভাবিনি। “চল, নীচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমার ছোট্ট বাবাই গাড়িতে রয়েছে। আলতো করে লিমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারলাম, ‘ আমাকে আর কখনো একলা ছেড়ে দিওনা, প্লিজ।” “ভয় পেয়োনা, আর কখনো একলা ছেড়ে দেবোনা।”

………………..

অন্যদিকে থানায় তখন সব কাজ সেরে ঘড়িতে প্রায় দুটো বাজিয়ে তালুকদার বেরিয়ে এসেছেন। আসলাম আর রতনকে চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে হয়নি। ঘরের শত্রু বিভীষণ হলে বিরক্তি বা রাগের চেয়ে দুঃখই বোধহয় বেশী হয়। শুধু অফিসার মারফত জানিয়ে দিয়েছেন ওনার অনুগ্রহটুকু। পিছু ফিরলে দেখতে পেতেন আসলাম গত রাতের পিটুনির ভারে মিইয়ে গেলেও রতনের চোখ এখনো রাগে গনগন করছে। তার মনে যে এখনো দৃঢ় ধারনা এটাও তালুকদারের কূটচালের অংশ। দয়া দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া আমি চাইলেই তোমাদের হাজতবাস করাতে পারতাম। এই ক্ষমতার দম্ভ আর কূটচালের জোরেই যে রতন সর্বদা পিছিয়ে ছিল। ওয়াদুদের সাথেও একটু বোঝাপড়া করতে হবে তার এই বেলা। মানুষ যদি মানুষের মনের কথা পড়তে পারত তাহলে বোধহয় অনেক অশান্তি বা জটিলতা মুখে না বলেও বুঝিয়ে দেয়া যেত। পুরোপুরি ভ্রান্ত ধারনা মনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রতন হয়তো নিমিষেই বুঝে যেত তার অগ্রজ বড় ভাইয়ের মাথায় এখন শুধুই নিজের ছেলে আর তার পরিবারের জন্যই চিন্তা ঘুরছে। সেখানে রতন, ওয়াদুদ বা আসলাম কোনভাবেই এখন জায়গা নিতে পারছেনা।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *