অনুধাবন ( ৬ ষ্ঠ পর্ব )

( রাসেলের বড় বোন, রেহানার সংসার)

‘রুটির চেহারা এমন কেন? একটা আমেরিকা তো একটা জাপানের মানচিত্রের মতো? বাপের বাড়ি থেকে কি শিখে আসছো? এতোদিনে একটা রুটি ঠিক করে বানাইতে পারোনা। অবশ্য কি আর শিখবা ঐ বাড়ি থেইকা, লাফাঙাগিরি ছাড়া। এতোদিন রাস্তায় লোকে কইতো আমার শালারে মদ গাঁজা খাইয়া পইড়া থাকতে দেখছে। এখন কয় কোন কোন খারাপ পাড়ায় দেখছে। আমার ইজ্জতের দফারফা করে ছাড়লো।’

গত কয়েক মাসের প্রতিদিন সকাল শুরু হয় রেহানার এসব কথা বা এ ধরনের কথা শুনে। বিয়ের পর থেকেই দেখেছে ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এমনকি তার স্বামীও সুযোগ পেলেই কিভাবে রেহানার বাপের বাড়ি থেকে কিছু কুক্ষিগত করা যায় এ ধরনের চিন্তায় বিভোর থাকতো। মানুষ নয় যেন লোভের ডিপো। কিন্তু রাসেলের দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে কথার হুলে নিত্য জর্জরিত হওয়া যেন একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। হয় তার স্বামী নয়তো শ্বশুরবাড়ির বাকী লোকেরা, যে যখন পায় দুকথা শুনিয়ে যায়। অনেকটা রাগ কমানোর মেশিনের মতো অবস্থা। যার যখন রাগ হয় দুকথা রেহানাকে শুনিয়ে যেন সেটা মিটিয়ে যায়। অথচ পুরো ব্যাপারটাতে শুধু রাসেলের বোন এই সম্পর্কটুকু ছাড়া রেহানার কোন দোষই নেই। এক আধবার মুখ ফিরিয়ে হয়তো কথা বলেছে তার বিনিময়ে আরো কিছু অকথ্য কথা সাথে কিছু চড় চাপড় জুটেছে। মা বাবা জানলে কষ্ট পাবে ভেবে চুপ করেই থাকে রেহানা যতটা সম্ভব। তারা ও যে এ ব্যাপার নিয়ে নানা কথা শুনছে সেটাতো সহজেই অনুমেয়।

আজকের সকালটাও ছিল তেমন ধরনের, অর্থাৎ কথার খোঁচায় জর্জরিত হওয়ার দিন। রেহানার স্বামী আসলাম ভেবেছিল, রেহানাকে এভাবে কথার জোরে ঘায়েল করে রেখে বেশ দুচার পয়সা বিত্তবান শ্বশুরের পকেট থেকে খসানো যাবে। যদিও যখনই আসলাম যা চেয়েছে শ্বশুর সাহেব কখনোই না বলেননি। হয়তো আড়েঠাড়ে কিছু কথা শুনিয়েছেন কিন্তু জামাইয়ের মন যোগানোর চেষ্টাটুকু অতি অবশ্যই ছিল। তবে সুযোগমত কিছু ফাও পেলে মন্দ কি? নিজেও যে সে খুব সাধুপুরুষ তা তো আর না। কিন্তু রেহানা অন্যদিন চুপ করে থাকলেও আজ যেন কি হয় হঠাৎ করে। চিৎকার করে প্রতিক্রিয়া জানায়।

– আমারে যা বলার বলো, আমার ভাই বিয়ে করসে দেখে আমরা সবাই লাফাঙ্গা এই কথা আর কখনো বলবা না। তোমার নিজের মুরোদ থাকলে আমাকেও সতীনের ঘরই করতে হইতো। আমার কেন আর বাচ্চা হয়না বলে রোজ অন্য মেয়ের দিকে আড়েঠাড়ে যে তাকাও সেটা আমি বুঝিনা ভাবসো? তুমি আসলে সুযোগের অভাবে ভালো মানুষ সেজে থাকার চেষ্টা কর। তোমার ভিতরে যে একটা শয়তান থাকে সেইটা আমি জানিনা মনে করসো?

এই কথার জেরে ঘরে বোধহয় একটা খন্ড প্রলয় হয়ে গেলো। আসলাম তেড়ে এসে রেহানার চুলের মুঠি ধরে বেশ ক’ঘা বসিয়ে দিল পিঠের পরে। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরের প্রতিপত্তির কাছে মাথা নামিয়েই রাখতে হয়েছে আসলামকে। মেয়ের বাপের মাথা উঁচা এটা বোধহয় মেয়ের জামাইদের নিতে কষ্টই হয়। আর তাই শ্বশুরের খারাপ অবস্থার সুযোগে মনের ঝাল একটু তার মেয়ের ওপর মেটানোর এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করেনি আসলাম।
প্রতিদিনের কথা আর শরীরের অত্যাচারে অতিষ্ট রেহানা নিজের ছেলেদের ফেলেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। বাবার কাছে একটা জবাব তার চাই। এই নিত্যদিনের অত্যাচারে সয়ে থেকে মরে যাওয়া যে ঢের ভালো।

রেহানার গায়ে প্রথম যেবার আসলাম হাত তুলে তার পরবর্তী এক সপ্তাহ তার খুব ভয়ে ভয়ে কাটে। রেহানা যদি বাসায় কিছু জানিয়ে দেয়? বিত্তবান তালুকদার সাহেবের আপাত ভদ্র মুখোশের আড়ালে যে একটা ভয়ংকর রূপ ও আছে তা যারা বাজার ও শহরের আশেপাশে ঘোরে বা কাজে যায় তারা সবাই খুব পরিষ্কার না জানলেও আবছাভাবে জানে। এক আধটা মানুষ দুনিয়া থেকে সরে গেলেও পুলিশ তাকে ঘাটাবে না।কিন্তু আসলাম দেখলো তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা পরবর্তী দু সপ্তাহে তো ঘটেইনি বরং আরো কিছু ফল পাকুড়ের ডালা এসেছে ও বাড়ি থেকে। অর্থাৎ হয় রেহানা কিছুই বলেনি, নয়তো বললেও ও বাড়ি থেকে জামাইয়ের মেজাজ শান্ত রাখার একটা উপায় ভেবেই উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে।

কথায় বলে লোভী লোকের লোভের কোন সীমা থাকেনা। হাত থেকে নিতে নিতে শেষে যদি হাতের উপহার ফুরায় শেষে লোভী লোক সেই হাতটাও পারলে কেটে নেয়। আরো কয়েক বার কথা কাটাকাটির জেরে গায়ে হাত তোলা ধরনের ব্যাপার হওয়া ও পরবর্তীতে ঘরে কিছু না কিছু আসায় আসলামের সাহস বুঝি দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছিল। আজ সকালে তাই রেহানা যখন মেয়েদের ছাড়াই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, তখন কি করবে বুঝতে না পেরে আসলাম বোকার মত নিজের ঘরের দরজা দিয়েই বসে রইলো। মনে কি খানিক আশা ছিল রেহানা ফিরে এলো বলে? তাছাড়া ছেলেদের ফেলে রেহানা সাধারণত কোথাও একা যায়না।

বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ী বা জামাইয়ের লোভী দৃষ্টি তালুকদার সাহেব মেয়ের বিয়ের বছর না ঘুরতেই টের পেয়েছেন। সে হিসাবে ছোট মেয়ের চেয়ে বড় মেয়ের বাড়িতে উপহার যেন নিয়মিত যায় সেদিকে উনি খেয়াল রেখেছেন। রেহানা কখনো তেমন কিছু বলে না দেখে ভেবেছেন হয়তো ভালোই আছে। এক আধবার কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া ফ্যাসাদের কথা যে শোনেননি তা কিন্তু না। আসমা বেগমের ওপর এসব সাংসারিক ফ্যাসাদ সামলানোর ভার অনেক আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া আগ বাড়িয়ে মেয়ের সংসারের হাঁড়ির খোঁজখবর নেয়া ওনার চিন্তাভাবনার পরিপন্থী দেখেই বুঝিবা আসলামের সাহস পর্দার অন্তরালে দিন দিন বেড়েই গেছে।

(রাসেলের ছোট বোন শাহানার সংসার)

প্রবাসী ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছে না থাকলেও শাহানার স্বামী ইকবালের বাড়ি থেকে রোজদিন বিয়ের খবর নেয়া আর তাদের অতিরিক্ত আগ্রহে তালুকদার সাহেব রাজী হয়ে যান। আরো একটা কারণ অবশ্য ছিল তা হচ্ছে ওয়াদুদ অর্থাৎ তালুকদার সাহেবের অঘোষিত ডানহাত। সম্পর্কে ইকবাল ওয়াদুদ সাহেবের দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে হয়। চেনা পরিচিতের মধ্যে হলেও তালুকদার সাহেবের নানা কীর্তির একমাত্র সাক্ষী আবার ঐ ওয়াদুদ এতোসব দোটানায় অনেক ভেবেচিন্তে তাই ছোট মেয়ের বিয়ে এখানে দিতে রাজী হন তিনি। শাহানা ছোট বেলা থেকেই একটু বোকাসোকা নরম ধরনের ছিল। পরিচিতদের মধ্যে বিয়ে হলে মেয়েটা স্বস্তিতে থাকবে বলেই ভেবেছিলেন উনি।

ছেলে আগে বিদেশ থাকলেও বিয়ে পরবর্তী বিদেশ যাত্রার খরচ থেকে শুরু করে মেয়ে থাকার ঘর সাজানো সবই তালুকদার সাহেব করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া ইকবালের সংসারে এক বোন আর মা ছাড়া আর কেউ নেই দেখে মেয়ের ঝামেলা কম হবে ভেবেছিলেন। কিন্তু পর্দার পেছনে হয়ে যাওয়া নাটক বুঝি যার যার সংসারের বড় নিজস্ব। আগল না খুলে দিলে অন্য লোকে শুধু বাইরের আলতো থমথমে ভাবটাই টের পায় কিন্তু ভেতরের গভীর ক্ষত বুঝতে পারেনা সেভাবে। সপ্তাহে একদিন ফোনে শাহানার সাথে দুবাইবাসী ইকবালের কথা হয়। বেশীর ভাগ সময় দেখা যায় শাহানার দোষ ধরেই কেটে যায় ইকবালের সময়। সুদূর প্রবাসে থেকেও শাহানার এতো দোষের নাগাল যে কিভাবে ইকবাল পায় সেটাই শাহানা ভেবে পায়না। ফোনের সময় ও তার পরবর্তী কিছুক্ষণ তাই শাহানার খানিক মন খারাপ থাকে। তবে যেহেতু ইকবাল কাছে থাকেনা তার মন খারাপ ভাব খুব একটা লম্বা হয়না কখনোই। অল্প সময় পরেই ছেলের যত্ন আর সংসারের নানা কাজের চাপে শাহানা ভুলে যায় সবকিছু।

কিন্তু গত দুমাসের হিসেব ভিন্ন। দুতিনদিন পরপরই ফোন আসে ইকবালের কাছ থেকে। প্রসঙ্গ একটাই, ভাইয়ার দ্বিতীয় বিয়ে। ফোনে ইকবাল, বাইরে শ্বাশুড়ী থেকে শুরু করে প্রতিবেশী। এমনকি সেদিন ননদ এসে শুনিয়ে গেলো তার শ্বশুরবাড়িতেও তাকে এসব নিয়ে কথা শুনতে হচ্ছে। অথচ একটা সময় বড় গলা করে শ্বশুরবাড়ির লোকদের শুনিয়েছে তালুকদার সাহেবের মেয়ে তার ভাবী। তার ভাইয়ের কর্মফলের জের কেন তাকে ভোগ করতে হবে এটাই ভেবে পায়না শাহানা। তবে এতোদিন সংসার করে লোকের সাথে মিশে এতটুকু সে এখন বোঝে সবার চোখ তার বাবার সম্পত্তির দিকে। ভাইয়ের দু বৌয়ের সুবাদে সম্পত্তির মালিকানা দুভাগ হয়ে গেলে তাদের ভাগে যদি কম পরে যায়। হায়রে মানুষ নিজের উপার্জনেরটা ভোগ করার চেয়ে বিনামূল্যে পেতে পারবে এমন সম্পদের জন্য কেন যে মুখিয়ে থাকে বুঝে পায়না শাহানা।

বাজারে আসা যাওয়ার পথে কার যেন গাওয়া ক্যাসেটে বাজতে থাকা একটা গান আজকাল শাহানার খুব মাথায় ঘোরে। ছোটবেলা থেকেই সবাই তাকে ভাবে বেশ বোকাসোকা, বৈষয়িক ব্যাপারে বোঝে কম। কিন্তু আসলেই কি তাই?

‘এক পুরুষে গড়ে ঘর
এক পুরুষে খায়
আরেক পুরুষ আইসা দেখে
খাওয়ার কিছু নাই।
আমার তিন পুরুষ।’

বাবার করে দেয়া সম্পত্তি তার ভাই যেভাবে ওড়াচ্ছে, তার পরের প্রজন্মে কি তাহলে তালুকদার পরিবারের নাম কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে?

এক প্রজন্ম তার সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্পদ আর সম্পত্তির যত্ন আর রক্ষনাবেক্ষন করে যায় পরের প্রজন্মের ভোগের জন্য। কিন্তু পরের প্রজন্ম কি আসলেই তার মূল্যায়ন সেভাবে করে? যে সম্পদ তৈরীতে নিজের শ্রম ঘাম মেশানো নেই সে সম্পদ দিয়ে শরীরের সুখ মেটে হয়তো কিন্তু মনের তৃপ্তি তাতে আদৌ কতোটা থাকে তা কয়জনেই বোঝে? আর তাই বুঝি রেহানা বা শাহানার স্বামীদের মতো কিছু লোকে নিজের অর্জন বাদ দিয়ে মুফতে পাওয়া জিনিসের জন্যই একটা জীবন হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকে।

চলবে…..

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *