আজ জোছনা রাতে (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

অতুল চৌধুরী বজরায় বসে আছেন৷ তার মন বিষন্ন৷ এমন বিষন্ন হলে তিনি বজরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন৷ হাওরের উথাল পাথাল জল দেখে মন শান্ত করেন৷ আজ হচ্ছে না৷ জীবন তার কাছে সম্ভোগের অপর নাম, আর খাজনার সময় হলে সেটা আদায়ে কঠোরতা! কি করবেন বেনিয়ার জাত পয়সা ছাড়া অন্য কিছুই ত বোঝে না৷ তাদের কথা খাজনা দিবেন ঝমিডারী ঠাকবে, খাজনা নাই ঝমিডারী নাই! আজ তার বাড়ীতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান ৷ তার স্ত্রী পরমা দেবী’র সাথে ন’বছরের যে মেয়েটা এসেছিল সতী, এখন তার বয়স পনের৷ বিবাহ যোগ্যা। বেশ বাড়বাড়ন্ত শরীর সতীর৷ দেখলেই লোভ জাগে৷ পরমাদেবী সতীকে তার সামনে আসতে দেন না এখন৷ তবুও অতুল বাবুর চোখ পড়েছে তার উপরে৷ বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে লোক দেখানো একটা ব্যাপার৷ জমিদার বাড়ীর কাজের লোক পেট বাঁধিয়ে ফেললে সেই দায় জমিদার বাবুর উপরেই পড়ে কি না! বিয়ে দিয়ে দিলে আর সমস্যা নাই৷ তিনি বজরায় সুরজবালা নামক নৃত্যপটিয়সী এক রমনীকে নিয়ে এসেছেন৷ নিয়ে এসেছেন গানের দল৷ আজ ভরা পুর্নিমা৷ তার ইচ্ছা রাতটা বজরায় কাটিয়ে ফিরে যাবেন৷

পরমাদেবী তার দ্বিতীয় স্ত্রী৷ প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক মেয়ে আছে নাম কনিকা ৷ বয়স ছয়৷ কনিকা মাতৃহারা৷ পরমাদেবী যথাসম্ভব চেষ্টা করেন ছেলেটাকে আগলে রাখতে৷ ছেলেটাও যথাবিহিত সন্মান আর শ্রদ্ধা করে পরমা দেবীকে৷

প্রথমে বন্ধীব আগুন পানি বাতাস মাটি
অযোদ্ধা মদীনা মক্কা মথুরার চৌকাঠি
তারপরে বন্ধনা করি মানুষেরই স্থান
যেথায় আসন পাইতাছেন গড খোদা ভগবান
সুর্য বন্দী চন্দ্র বন্দী আরও বন্দী তারা
সংকটে কান্ডারী হয়ো বাজায়ে এক তারা
সবারই বন্ধনা করি এ তিন ভুবনে
প্রাণের বন্ধু যেন একদিন দরা দেয় স্বপনে….

বাউলের কিন্নরী কন্ঠ হাওরের পানিতে আলোড়ন তুলে চলেছে যেনো৷ অস্তমিত সুর্যের আলোয় জলের রঙ আকাশী লাল কমলায় মিলেমিশে একাকার৷ বাতাস এসেছে৷ সেই জল সোনালী গরলের মতো উঠানামা করছে৷

বজরার ভেতরে নিজের ঘরে আরাম কেদারায় অতুল চৌধুরী বসে আছেন কপালে ঘামের দাগ৷ রোমশ বুকে ঘাম পাতলা পাঞ্জাবী ছাপিয়েও বেশ বুঝা যাচ্ছে৷ আলুথালু সুরজবালা বিছানায় উঠে বসলেন৷ নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে গ্লাসে তরল রঙীন ঢাললেন৷ তারপর সসন্মানে অতুল চৌধুরির সামনের টেবিলে রাখলেন৷ অতুল আনমনা৷ বাউলের গান শুনছেন৷ আহা কি কন্ঠ বাউলের৷ সোনায় মুড়ে রাখার মতোন৷

সুরজবালার কন্ঠে তার ঘোর ভাঙল৷ গড়গড়াটা সাইজে দিব বাবু! টানপেন?

তিনি সুরজের দিকে তাকালেন৷ টানা কাজল দেয়া চোখ লাল ঠোঁটের রঙ লেপ্টে গেছে গালে৷ একপ্যাঁচে পড়া শাড়ি৷ বুকের অধিকাংশই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে৷ বক্ষবন্ধনীটা এখনও বিছানার উপরে কুঁচকে পড়ে আছে৷ তুলে নেয়নি সুরজবালা৷ বাবুকে সন্তুষ্ট রাখাটা তার কর্তব্য৷ শরীরের বিনিময়ে তার সুখ সমৃদ্ধি কম হয়নি৷ অবশ্য এখন তার বয়স বাড়ন্ত৷ বাবু যদি ছাইড়ে দেন…

কার্তিক! ভগবান রক্ষে করো রক্ষে করো আমায় বলে মনে মনে করজোর করলেন সুরজবালা৷ পতিতরা সব সময় কার্তিককে ডাকে৷ কার্তিক পতিতদের দেবতা! কেন কে জানে?

বেশ কিছুক্ষণ পর৷ সুরজবালা তার বেশভুষা ঠিক করে নিয়েছে৷ দরোজায় টুকা পড়ল৷ গলাখাকড়ি দিয়ে বাইরে থেকে গম্ভীর স্বরে কেউ বলল কর্তা আমি গনি৷ নৌকা এসে গেছে৷

অতুল চৌধুরী বললেন ভেতরে আস ৷ উনাকে সুন্দর ভাবে নৌকায় তুইলে দিও৷ আর নৌকা ছাড়লে আমার কাছে আইসো৷ কথা আছে৷

সুরজবালা যেতে যেতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন৷ আগে বাবু নৌকো পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন৷ এখন গনিকে বলেন ৷ গেল দু’তিনবার এমনই হয়েছে৷ যাবার বেলায় বাবু আজ তার সাথে একটি কথাও বলেন নি৷ তার সময় বোধকরি…

গনি অতুল চৌধুরীর কাছে আসল৷ বলল কর্তা কিছু বলপেন?

কর্তা বললেন সুরজবালারে আর বজরায় আনার দরকার নাই৷

ঠিক আছে বাবু৷ আর কিছু?

হ্যাঁ৷ এরপরে বজরা নিয়ে বের হলে সতীরে তুলবা!

আজ যার বিয়ে হইতেছে বাবু?

অতুল প্রসাদ ঘুরে তাকালেন গনির দিকে৷ দাঁত চেপে বললেন ক্যান? তুমি জাননা! আমার বাপের সুমায় থাকি তো আছ৷ এখানে কি হয় কিভাবে হয় ভাল করেই তো জান৷ জাননা!

গনি মৃদু স্বরে বলল জানি কর্তা৷ আপনে যে ভাবে বলেন সেরকমই হপে!

এবার গনির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল৷ সতী তার মেয়ের বয়েসি৷ গনির মেয়ের বিয়ে হয়েছে৷ নাতিও আছে একটা৷ সতী কে দেখে তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়তো৷ বজরায় উঠলে আর পড়বে না!
বাইরে জোছনায় বান ডেকেছে৷ বাউল গাইছে৷ তার কিন্নরী কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র হাওর জুড়ে৷

আঠারো বছর পর৷ আজ সতীর মেয়ের বিয়ে

সতী আর তার মেয়ে অতুল চৌধুরির মেয়ের কনিকা চৌধুরীর সাথে চলে এসেছিল তার শ্বশুর বাড়িতে ৷ সতীর মেয়ের বয়স তখন ছিল পাঁচ৷ এখন পনের৷

আজ সতীর মেয়ের বিয়ে!

সতী জানে বিয়েটা লোক দেখানো৷ তারসাথেও এমন হয়েছিল৷ অনেক অনেক বছর আগে৷ এরপর বেশ কিছুদিন ঠাঁই হয়েছিল অতুল চৌধুরীর বজরায়৷ প্রথমদিন তার দেহ যখন বিছানায় লন্ডভন্ড করেছিলেন অতুল চৌধুরি সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল৷ শেষত্বক যন্ত্রনায় ক্ষোভে লাঞ্ছনায় মুর্ছা যায় সে৷ পরে ওটা অভ্যেসে পরিনত হয়৷ প্রথম প্রথম বজরার ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো মুর্তিবৎ৷ চোখে গড়াত জলের ধারা৷ এরপর জলও শুকিয়ে যায়৷ কপালের লিখন বলে মেনে নেয় সতী৷ এছাড়া তো আর উপায় ছিল না৷

কনিকার সাথে তার শ্বশুর বাড়ীতে এসেও সতী রেহাই পায়নি৷ এখানের কামার্ত জমিদারও ফায়দা লুটেছে৷ একসময় জমিদারের ছেলে৷

আজ তার মেয়েও একই পরিনতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে৷ অথচ করার কিছু নেই৷

জমিদাররা হলেন হাঁসের মতোন৷ তাদের পালকে জল লাগে না৷ বিবাহের মতো একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের ফোঁকর ধরে তারা এই অপকর্ম গুলোর সনদ নিয়ে নেন নিজেদের হাতে৷ সতীর মতো অসহায় মেয়েদের বিয়ে হয় একজায়গায় আর বিছানা গরম হয় অন্য কারও৷ বিয়ে করা স্বামী গুলো পয়সা গুনে চলে যায় আরেক জমিদার বাড়িতে বিয়ে করতে৷ জমিদারের আগ্রহ শেষ হলে ওরা আবার হায়েনার মতো আসে উচ্ছিষ্টে মুখ লাগাতে…

সতী জানে তার মেয়ের কপালেও হয়তো এই আছে৷ এইই থাকবে৷ করার কিছু নেই৷

সতী চোখ মুছে উঠে পড়ে৷ কিছু একটা করতে মন চায় তার৷ এই বাড়ীতে আসা অব্দি তিলতিল করে বেশ কিছু মোহর জমিয়েছে ও৷ ওগুলো দিয়ে যদি তার মেয়ের জীবনের একটা গতি করতে পারে৷
না হয় মেয়েটাকে তার ভাগ্যই বরণ করতে হবে ৷

গনি কাকা কে খবর দিয়েছে সতী৷ গনি কাকা নাও নিয়া আসবে বলছে৷ মেয়েটারে গনি কাকার সাথে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে! কৌতুহল বশত সতী জামাই দেখতে যায়৷

জামাই এর মুখটা দেখে সতী কিছু বলল না৷ তার মুখটা থমথম করে উঠল৷ কাছারী ঘরে একটা চৌকি আছে৷ ওটার নিচ থেকে একটা রাম দা বের করে নিয়ে আসে সতী৷

চিৎকার করে ডাক দেয় সে মেয়ের হবু জামাতাকে৷

সুবোধ! কুত্তার বাচ্চা৷ আমারে চিইনেছিস, হারামজাদা!

সুবোধ চন্দ্র দাস পরিচিত কন্ঠটা শুনে চমকে উঠে৷ চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সতী৷ অনেক অনেক পুর্বে অতুল চৌধুরীর ওখানে তার বিয়ে করা বউ!

সুবোধ বলে তুমি! তুমি তো অতুল কর্তার বাড়ি আছিলা৷ এইহানে ক্যামনে?

সতী প্রশ্নের জবাব দিল না! বলল হারামজাদা তুই জানস কারে বিয়া করতে আসছ! জানো! নিজের মাইয়ারে বিয়া করতে আসছোস রে শুয়োর!

সতী তার মেয়েকে গনির নৌকো পর্যন্ত পার করার বুদ্ধি খুঁজছিল৷ এখন হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেল তার৷ সে দাও হাতে সুবোধকে তাড়া করলো৷ ভয়ে দৌড় দিল সুবোধ৷ পায়ের পাতায় টান খেয়ে কোমর থেকে ধুতি ছুটে গেল৷ ঐ অবস্থায়ই দৌড়ালো সে৷ নিজের মেয়েকে আজ বিয়ে করতে এসেছে এ বিষয় তাকে যতটা না বিচলিত করেছে সতীর রুদ্র মূর্তি তার চেয়ে বেশি৷ সতীর পেছন পেছন মন্ডপ থেকে উঠে দৌড় দিল সতীর মেয়ে৷ মা কে চিৎকার করে ডাকছে!

তিনজনের দৌড়াদৌড়ি দেখে সবাই হাসছে৷ সতীর মতো দু’একজন অভাগী সেখানে ছিল৷ ওরা মুখে আঁচল চাপা দিল শুধু৷

সতীর আঁচল খসে পড়েছে৷ সুবোধ ধুতি ছাড়া দৌড়ে একটা এঁদো পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ সতীর মেয়ে সতীকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো৷ বিয়ে বাড়ি থেকে বেশ কিছুদূরে৷ সতী চিৎকার করে কেঁদে উঠল৷ তার মেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল—

“মা কি হয়েছে”? মেয়ের কথায় নিজেকে খুঁজে পেল সতী৷ চোখ মুছে চারপাশে তাকালো৷ কেউ নেই আসেপাশে৷ আসেনি কেউ৷

সতী মেয়েকে বলল মা কথা বাড়াসনে৷ হিজলের বনের পেছন ঘাটে গনি কাকা নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় আছে৷ তুই যা৷ সবাই আসলি আর যেতে পারবিনে৷ যা!

সতীর মেয়ে আবার প্রশ্ন করলো লোকটা কে মা?

সতী ডুকরে কেঁদে উঠে বলেছিল তোর বাপ তরে বিয়া করতে আইছিল রে মা! তোর বাপ!

….

আজ ফিনকি ফোঁটা জোছনা৷ হাওরে ছোট্ট একটা নৌকা৷ গনি আর সতীর মেয়ে সেই নৌকায়৷ আসেপাশে কেউ নেই৷ জোছনার আলো হাওরের পানিতে ঠিকরে যাচ্ছে৷ গনি হাতের বৈঠাটা পাটাতনে ফেলে দিল৷

সতীর মেয়ে বলল দাদু কি হয়েছে?
গনির চোখ চকচক করছে৷ সতীর মেয়ে সাবিত্রী ভয়ে কেঁপে উঠলো৷ এ চোখ তো মানুষের নয়৷ এ চোখ পশুর৷ রিরংশা সম্বলিত পশুর চোখ …

চাঁদের আলোয় নৌকোটা এলোমেলো ভাবে দুলছে৷ গন্তব্যহীন৷ বহু দূর থেকে বাউলের কিণ্নরী কন্ঠের গান ভেসে আসছে

” পাপ পুন্যের কথা আমি কারে বা শোধাই! এক দেশে যা পাপ গন্য অন্য দেশে পূন্য তাই….”

পাদটীকাঃ

১)ব্রিটিশ জমিদার আমলে এভাবে দাসী বা দাসীর মেয়েকে ভোগ করার রীতি ছিল
২) সে সময়ে একশ্রেনীর মানুষের পেশাই ছিল বিয়ে করা৷ ওরা হিসেব করে বিভিন্ন জমিদার বাড়ীতে বিয়ে করে বেড়াত৷ এতে জমিদারদের ভোগ লালসার পথ সুগম হত৷
৩)গল্পটা আগেও একবার লিখেছিলাম অন্যভাবে৷ পছন্দ হয় নি তাই আবার লিখলাম৷

-পলাশ পুরকায়স্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *