আশ্রয়

২য় শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাগ্নে আমার আশ্রয়। বড্ড অবুঝ ছেলে। তার মায়ের প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র সে, বার্ষিক পরীক্ষাতে দুজন শিক্ষার্থী যৌথভাবে প্রথম হওয়ায় লটারীতে ভাগ্নে আমার সেকেন্ড প্লেইসটা পায়। এতে তো তার মহা রাগ, দুঃখ এবং কষ্ট। সেসময় সে একা একা মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল,রেজাল্টের খবরে দুইদিন তার মা বাবার সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি! তার একটাই কথা কেন তাকে সেকেন্ড দেয়া হল।

ভাগ্নে আমার সমস্ত বৈশিষ্ট্য পেয়েছে তার বাবার। আচার আচরণ সবকিছুতেই তার বাবার ফটোকপি,যদিও তার বাবা এ কথাটা মেনে নিতে নারাজ। উনার ভাষ্যমতে ছেলের গোয়ার্তমি, রাগ জেদ তৈরি হয়েছে তার মায়ের প্রশ্রয়ে। তবে আমরা বলি ছেলেটা ভাল গুণগুলো রপ্ত করেছে মায়ের থেকে আর নেগেটিভ যা পেয়েছে সব তার বাবার অষ্টকাঠি।প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় তাকে টিফিনবাবদ বিশ টাকা দিতে হয়। দশটাকা সে নিজে খায় আর বাকি ১০টাকা দিয়ে সহোদর ছোট ভাইয়ের জন্য একটা চিপস বরাদ্দ। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ভাইয়ের হাতে চিপসের প্যাকেট তুলে দিলে ছোটভাই তো মহাখুশী, অতঃপর দাদাভাই কত ভালা!

কিছুদিন যেতেই খেয়াল করে দেখা গেল ভাগ্নে ছোট ভাইটার জন্য প্রতিদিন চিপস আনছেনা, বরং একটা ৫টাকার কেক কিনে আনছে আবার সে নিজেও কিছু খাচ্ছেনা। তাহলে সে বাকি টাকাটা কি করছে? তার মা একদিন জিজ্ঞেস করলে সে বিজ্ঞ বুড়োদের মত উত্তর দেয়,”তুমি চিন্তা করো না, টাকা দিয়া আমি কিছু করছিনা , টাকা আছে।”

শীতের সকাল। গায়ে বাবার এনে দেওয়া জ্যাকেট,পায়ে মোজা জুতা, মাথায় টুপি। সব শুধু শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। গলির মোড়ে তার বাবা যখন বাইক নিয়ে পৌঁছায়, আশ্রয় যথারীতি পাগল মহিলাটাকে কিছু খড় দিয়ে শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। একজন অর্ধবয়ষ্ক পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলাকে প্রায় একমাস ধরে এই ভাঙা টং ঘরের কাঁচামাটিতে বসে থাকতে দেখছে আশ্রয়। প্রচন্ড ঠান্ডাতে ওই মহিলার গায়ে একটা ছেঁড়া শাড়ি রয়েছে শুধু ওর লজ্জা নিবারণের জন্য। এ ঠান্ডাতে মহিলার গায়ে কোন শীতের কাপড় নেই।ভাগ্নেদের বাসস্থান পাহাড়ী অঞ্চলে বিধায় সেখানে শীতের প্রকোপ এমনিতেই বেশি তার উপরে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। স্কুলে যাওয়ার সময় মহিলাকে আশ্রয় খড়ের নিচে শুয়ে থাকতে দেখেছে, আবার বাড়ি ফেরার পথেও দেখে পাগল মহিলাটি শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে।

বাড়িতে ফিরে আশ্রয় তার বাবার কিনে দেয়া প্লাস্টিকের ব্যাংকটা বের করে আনে। ব্যাংকটা নিজের হাতে কাটলে বের হয় ১৭০ টাকা।
অবুঝ শিশুটি তার টিফিনের জমানো টাকাগুলো তার বাবার হাতে দিয়ে বলে পাগল মহিলাকে একটা কম্বল কিনে দেওয়ার জন্য। ছেলের এমন মহানুভবতায় তার বাবাটি সিক্ত হয়। তিনি নিজেই একটা কম্বল কিনে দিবেন বলে ছেলের কাছে প্রতিজ্ঞা করলে ভাগ্নে জানায় মহিলার এমন কষ্ট দেখেই সে না খেয়ে টাকাগুলো জমাতো উনাকে কম্বল কিনে দিবেন বলে।

সেদিনই বিকালে আশ্রয়ের বাবা আশ্রয়কে সাথে নিয়ে একটা সুন্দর কম্বল কিনে ওই মহিলার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আসেন। খুশিতে দুটি চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলাটির।

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাগ্নে দেখে মহিলাটি সেই খড় গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে।
গতকাল কিনে দেওয়া কম্বলটি মহিলাটির গায়ে নাই। পাশের চায়ের দোকানের রতন এগিয়ে এসে বলে,রাতে শোয়ার সময়ও পাগলীটার গায়ে কম্বলটা সে দেখেছে, কিন্তু সকালেই দেখে কম্বলটা নেই।

ভাগ্নের দুচোখে জল আসে যখন শোনে কম্বলটি কে যেন গতকাল রাতে নিয়ে গেছে। মহিলাটি আবার শীতে কষ্ট করবে। ভাগ্নের মনে কষ্ট কম্বলের দামের টাকা জমাতে আরও একমাস সময় লাগবে তার, এতদিন পাগলীটার কত কষ্টই না হবে এ ঠান্ডাতে!

-অরুন্ধতী অরু

ছবি কৃতজ্ঞতা– সাখাওয়াত তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *