ঈদরঙ্গ: মতিয়ার

ইংরেজি স্যারের ক্লাসে আমাদের মস্তকখানা বরাবরই লাটিমের মতো ঘুরপাক খেত। পলান একদিন সত্যি সত্যি ইংলিশ প্যান্টের টেঁকের ভেতর থেকে একটি দড়ি টেনে বের করে বলল- নে, লাটিমের আলের সাথে দড়ি পেঁচিয়ে যেমন করে মারে, আমাকেও তেমন করে মেরে দে। তবুও বোধহয় ঘেটু স্যারের ক্লাসের চেয়ে কম ঘুরবে মাথা।
অমনি বদি হাঁ হাঁ করে এগিয়ে এলো- দে দে। দড়িটা দে। তোর আলের সাথে পেঁচিয়ে ছুঁড়ে মারি। বলে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগল। পলান প্রথম ধাপে বদির ইঙ্গিতটা বুঝতে না পারলেও খানিকবাদেই ইংলিশ প্যান্টের চেইনের ওপর দিয়ে নিজের আল সমেত জায়গাটা চেপে ধরে গাঁইগুই আরম্ভ করল।
এরই মধ্যে ঘেটু স্যার কয়েক লাখ বছর হয় না মাজা কুচকুচে কালো পান খাওয়া দাঁতের মুখে গন্ধ ছোটাতে ছোটাতে বেত হাতে ক্লাসে এন্ট্রি মারলেন। দাঁতের ছিড়ি অমন হলে কি হবে, ঘেটু স্যার ইংলিশে বড় শক্ত। শুনেছি একবার এক ইংলিশ সাহেবকে পর্যন্ত ঘায়েল করে ফেলেছিলেন তার ইংরেজির তীরে। ইংলিশ সাহেব নাকি এমনই কুপোকাত হয়েছিল যে, ইংরেজি ছেড়ে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করে দিয়েছিল।
ঘেটু স্যার এসেই বেতের আগা থেকে একটা চলটা খসিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে তার কালোর কালো জম কালো দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া সুপারির কুচি উদ্ধারে লেগে গেলেন। আমি পলান বদি বসেছি পেছনের সিটে। পলান ঠিক করেছে আজ অমন বেতের বাড়ির সাথে কেলো মুখের দূর্গন্ধ ভক্ষণ করার চেয়ে পলানটুক মারবে।
পেছনের দরজা ঠেলেঠুলে দেখা হয়েছে এরই মধ্যে। তেমন শক্ত না। ধাক্কা জোড়েসোড়ে একটা দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে পড়বে। পলান যদি কোনো গন্ডগোল না পাকিয়ে ভালোয় ভালোয় পগাড় পার দিতে পারে, তার পেছনে পেছনে ওই ফাঁক গলিয়ে কুড়ালের মত সেঁধিয়ে যাব আমরাও। যদিও এখন ক্লাসে ঘেটু স্যারের সামনে সুঁইয়ের মতো সরু হয়ে বসে আছি পাছায় গাবের আঠা লাগিয়ে।
ঘেটু স্যার খানিকক্ষণ তার দন্ত খোঁচানো কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে মুখখানা জুতো পলিশের মতো করে ডাস্টার দিয়ে মুছে, ঘাড়খানা কাত করে সাক্ষাত ষাঁড়ের গলার আওয়াজে চেঁচিয়ে বললেন- আজ তোদের ইংরেজি বানান ধরার কথা। মনে আছে রে হতচ্ছাড়া হারে হারামজাদার দল? লেখাপড়ার তো কোনো নাম নাই! খালি হাঙ্কিপাঙ্কি।
ঘেটু স্যারের ঘরঘরে ষাঁড়ের গলায় আওয়াজ বের হতেই আমাদের সবার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। আমার মনে হলো এই বুঝি পেচ্ছাব করে ক্লাস রুমের ভেতর গঙ্গা বইয়ে দিই। সেই গঙ্গার জলে হাতমুখ ধুয়ে আমাদের কেলো ঘেটু স্যার একটু তার দন্তমুখ ফসসা টসসা করুক। মনে মনে সবাই অদৃশষ্ট জপতে লাগলাম। এই বুঝি ধরে, এই বুঝি ধরে। আর না পারলে, অমনি কলার চেপে ধরে ধাই ধাই করে বেত বাগিয়ে পাছার মাংস ইঞ্চি তিনেক করে ফুলিয়ে তোলে। ওই বাড়িটারি তাও না হয় সহ্য করা গেল, তার মুখের ওই ইঁদুরপঁচা গন্ধ সহ্য করা হবে কেমন করে? আমাদের অবস্থা বারোটার জায়গায় রীতিমত তিনটা বেজে যাওয়ার যোগাড়।
ঘেটু স্যার চশমাটা নাকের বদনার ওপর জায়গামত সেট করে যোঁয়ালটানা বলদের গলায় হেঁকে উঠলেন- বদি!
এ্যাই সেড়েছে! আজকের পয়লা কোপ এসে পড়ল আমাদের বদির ঘাড়ে। আহা বেচারা। আজ নিশ্চয়ই তার আমাশা ধরে যাবে। অথচ পাছার ব্যাথায় ঠিকমত যে টাট্টিখানায় বসে থাকবে তারও উপায় থাকবে না। ইহ্, বেচারা! আজ কার মুখ দেখে যে ঘরনির্গত হয়েছিল!
বদির প্যান্ট যেন বেঞ্চের সাথে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে দিয়েছে কেউ গতরাতে। সারারাত ধরে টানাটানি করেছে, তাও ছাড়েনি। এখন ঘেটু স্যারের ডাকে কি করে ছাড়বে! তবু না দাঁড়ালে উপায় নেই। বদি অনেকক্ষণ বেঞ্চের সাথে পাছা ডলাডলি করে অলরেডি নুনছাল খানিকটা তুলে রাম নাম মুখে নিয়ে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল।
পড়েছিস? ঘেটু স্যার চেঁচালেন। অমনি ঘরময় একটা প্রচন্ড দূর্গন্ধের ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। নেহায়েতই মুখে হাত দেওয়া গেল না। বসে বসে গন্ধ গিলতে হলো ক্লাস ভর্তি সবাইকে। বদি মুখটা রুটিভাজা তাওয়ার তলার মতো কালো করে বলল- জ্বি স্যার।
ঘেটু স্যার দ্বিগুণ ফোর্সে চেঁচিয়ে উঠল- কি পড়েছিস বল?
পুঁটিমাছ ধরে পাতিলের অল্প পানিতে ছেড়ে দিলে যেমন খাবি খায়, বদি ওইরকম খাবি খেতে খেতে বলল- আজ্ঞে বইয়ের পড়া পড়তে পারিনি। জামা কাপড় পরে এয়েচি!
বদি আমাদের বাদল চ্যাটাজ্জি। দশ বছর বয়সতক কলকাতায় মামার বাড়ি থেকে এসেছে। এখনো ওপারের উচ্চারণের ধারাটা ছাড়তে পারেনি। এখনো এয়েচি, গিয়েচি, খেয়েচি এইসব করে।
জামা কাপড় পরে আসার কথাটা বদি কোনোকালেই বলতে চায় নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে তার। ক্লাসে ঢোকার আগে আমিই ঠাট্টা করে বদি আর পলানকে বলেছিলাম- আজ যদি স্যার জিজ্ঞেস করে কি পড়েছিস। জামা কাপড় পরে এসেছি ছাড়া আর কিছু বলার থাকবে না।
বদি কথা বলার সময় কি বলবে না বলবে বুঝতে পেলো না। আমার তখন বলা কথাটাই বিদ্যুতের হাজার পাওয়ারের বাতির মতো ঝলক দিয়ে উঠল তার মাথায়। অমনি ঝেড়ে দিল। বদির মুখে অমন কথা শুনে আমাদের পেটের পানি যা ছিল সব গিয়ে জায়গা মতো জমা হয়ে গেল। এখন খালি বেরিয়ে আসা বাকি। আজ আর বদির স্বয়ং কেষ্টঠাকুরও বাঁচাতে পারবে না।
ঘেটু স্যার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গুরুম গারুম করে চেঁচিয়ে উঠলেন- তা আর পরার দরকার কি ছিল? এদিকে আয়। আয় বলছি। পেঁদিয়ে তোর জামা কাপড় পরে আসা বের করছি। বদি না চাইলেও উঠে ঘেটু স্যারের কাছে যেতেই হলো। ঘেটু স্যার বেতের আগা দিয়ে ঝপাং ঝপাং ঝপাৎ করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন বদির পশ্চাতদেশে। বদি ক্যাঁক ক্যাঁক করে উঠল। আহা বেচারা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফুলে ঢোল হয়ে গেছে রে!
বদি পাছা মালিশ করতে করতে জায়গায় ফিরে এলো। তবে বসতে পারল না। ব্যাথা টনটন করছে। সে দাঁড়িয়ে রইল মুখটা আলুর মতো গোল করে।
ঘেটু স্যার বদিকে বেদম পেষা পিষে অন্য একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করল- এ্যাই হারামজাদা! বল, মাদার বানান বল!
ছেলেটা বার কয়েক এম এম করে করে ফিউজ হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে আর একটা বর্ণও বেরোলো না। মনে হলো কেউ যেন তার মুখের ভেতর তুলো সেঁটে দিয়েছে। সেই তুলে ভেদ করে কথা তো দূরের কথা, নি:শ্বাস আসা যাওয়া করাই দায়।
এই ফাঁকে আমি মনে মনে আউরে নিলাম। এম ও টি এইচ ই আর। এম ও টি এইচ ই আর। বার কয় আউরে একটু হালকা লাগলো নিজেকে। যাক বাবা। এ যাত্রায় বেঁচে যাব মনে হয়। ক্লাসের ছেলেপেলের যা অবস্থা তাতে আজ এই মাদার বানানের বাইরে ঘেটু স্যার যেতেই পারবেন না। একখানা স্বস্তির নি:শ্বাস বাউকুড়ালির মত পাক দিয়ে বেড়িয়ে গেল আমার বুকের ভেতর থেকে।
ঘেটুস্যার আমার দিকে তাকালেন। অমনি মাথার ভেতরটা মুহুর্তেই একেবারে শূন্য কেশবপুরের মাঠ হয়ে গেল। ‘এম’ মনে পড়ছে ‘আর’ মনে পড়ছে। মাঝখানে যে গোটা চারেক আর কি বর্ণ আছে তার তলই খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝখানের চার বর্ণ খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখলাম ঘেটু স্যারের দৃষ্টি আমার থেকে সড়ে গেছে। ও মা গো। আজ কপাল আমারই। কি পূণ্য যে করেছিলাম আগের জন্মে।
আমার দিক থেকে ঘেটু স্যারের চোখ সড়ল তো বটে, সেটা গিয়ে পড়ল পলানের ওপর। বেচারা পলান! তাকে এখন সাক্ষাত ভেড়ুয়া লাগছে। ঘেটু স্যারের স্থীর দৃষ্টি। পলান পালাবে কী সে চোখ সড়িয়ে দরজার দিকে তাকানোর টাইমই পেল না। তার আগেই স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন- এই যে চাঁদু! বল দেখি মাদার বানান।
পলান মৃগী রোগির মতন একটা ঝাঁকি দিয়ে বেবিট্যাক্সির মতন স্টার্ট নিয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল। এর আগে অবশ্য ‘এম’ ‘ও’ পর্যন্ত বলেছে কষেমষে। আমি হাই বেঞ্চের তলার দিকে মাথা ছুপিয়ে বলতে লাগলাম- এম ও টি এইচ ই আর। এম ও টি এইচ ই আর। পলান থেমে থেমে আমার থেকে শুনে শুনে একটা একটা বর্ণ বলল মুখে। প্রত্যেক বর্ণ উচ্চারণের সময়ই মনে হলো, এই বুঝি পেন্টুলুনটা ভিজে যায়। অবশেষে সব বর্ণই পলান বলে শেষ করে ফেলল। এইবার স্যার জিজ্ঞেস করলেন- তাহলে হলো কি? এম ও টি এইচ ই আর? সবগুলো একসাথে টাইট করলে কি দাঁড়াল?
পলান খানিক পেড়েছে সেই উৎসাহে বেশ জোড় গলায় বলে ফেলল- ‘মতিয়ার’ স্যার। এম ও টি এইচ ই আর ‘মতিয়ার’। অমনি ঘেটু স্যার বেত ছুঁড়ে মারলেন। কেবল বেত ছুঁড়ে মেরেই ক্ষ্যান্ত হলেন না টেবিল চেয়ার ছেড়ে কেলো ষাঁড়ের মত গর্জন করতে করতে তেড়ে আসতে লাগলেন। ক্লাসের কেউ আর পলানকে দেখতে পেলো না। তারা দেখল পেছনের দরজাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। সেই ফাঁক গলিয়ে পলান বিদ্যুতেরও আগে পলানটুক মেরেছে।
-রবিউল করিম মৃদুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *