উত্তরাধিকার ( ১৭ তম পর্ব)

রাতের খাবার শেষে সবাই খাবার টেবিলে বসেই অলস আড্ডায় মেতে উঠে। বাচ্চারা এ সময় নিজেদের মতো করে নিজেরা ব্যস্ত। রিশার ছেলে হলো লিডার, বাকি দু’জন তার যোগ্য সহচর। উৎস ড্রয়িং রুমের ওয়াল টিভিতে গেম চালিয়ে দিয়েছে। হোম থিয়েটারের সাউন্ডে খাবার টেবিলে বসা অসম্ভব। তাদেরকে কিছু বলার উপায় নেই। তাদের মূল লিডার হলো সুপয়া। সুপয়া সবাইকে ড্রয়িং রুম ছেড়ে তার রুমে চলে যেতে বলে। সুপয়ার কথার অবাধ্য হবার সাহস এ বাসায় কারো নেই। রিশা তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– তুমি কিন্তু এ গুলোকে বানর বানানোর চেষ্টা করছো।
তার কথা কিভাবে যেন দীপ্তের কানে চলে যায়। দীপ্ত দৌঁড়ে ফুপির সামনে এসে একটি ভেংচি কেটে চলে যায়। সুপয়া হো হো করে হেসে উঠে।
– বানর বলার মজা হাতে নাতে পেলে। এবার যাও তোমরা দোতলায় গিয়ে আড্ডা দাও। ড্রয়িং রুম এখন আমাদের দখলে থাকবে।
সবাই মিলে ড্রয়িং রুম ছেড়ে দোতলায় মায়ের রুমে জমায়েত হয়।

দোতলার সবচেয়ে বড় রুমটি রিয়াদ মায়ের জন্য বরাদ্দ করেছে। এর পেছনে তার যুক্তি হলো, পারিবারিক মিটিংগুলো মায়ের রুমে হবে। সে মায়ের রুমে অতিরিক্ত একসেট সোফা ফেলে দিয়েছে। সুপয়া নানা প্রকার ডেজার্ট নিয়ে হাজির হয়। শোভন এবার হায় হায় করে উঠে,
– আম্মা আপনি আমাকে একদিনে মোটা বানিয়ে দিবেন।
রিয়া ফোঁড়ন কাটতে ছাড়ে না।
– ভাইয়া, দশ বছরে যখন মোটা হলেন না, তাহলে আজকে কিছু হবে না।
শোভন সুযোগটা কাজে লাগায়,
– একমাত্র শালার বউ নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ালে একটু আধটু মোটা হওয়ার রিস্ক নেয়া যায়। আম্মার হাতের খাবার তো নিয়মিত খাচ্ছি।
– ভাইয়া, সে সুযোগ আপনার কপালে নেই। আমি আসার আগেই সব রান্না শেষ হয়ে গিয়েছে। জামাই আসার খবর পাওয়ায় মা আমাকে রান্নাঘরের কাছেও ঘেষতে দেন নি।
রিশা এবার মাকে কিছুটা শাসন করার সুযোগ পায়।
– মা, তোমাকে কতবার বলেছি, তুমি রান্নাঘরে যাবে না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে?
– ধুর পাগলি, আমি তো সারাক্ষণ বসেই থাকি। এতো বসে থাকলে আমি কি সুস্থ থাকতে পারব?
এবার রিয়াদ বাগে পায়,
– কেন, তোমার ব্যায়ামাগার আছে সেখানে সময় দাও। তারপরও সময় পেলে লাইব্রেরীতে সময় কাটাও। না হলে ইউটিউবে তোমার যা মন চায় দেখতে পার। এরপর থেকে ভাইয়া এলেও তুমি রান্নাঘরে যেতে পারবে না।
– বাবারে, আমি যে নিজের হাতে কিছু না করলে শান্তি পাই না।
– বাড়িতে রান্না করার লোক আছে। তাদেরকে বসে থেকে রান্না শিখিয়ে দাও।
– আচ্ছা ঠিক আছে তোদের কথা মেনে নেব। রিয়া, শোভনকে মিষ্টি দাও।
– মা, আমি দিচ্ছি, তুমি তোমার চেয়ারে বসো।
– আমি নিচে যাই, দেখি ওরা কি করে?
রিয়াদ এবার বলে,
– মা, বসো কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।

সুপয়া তার চেয়ারে বসার পর রিয়াদ আলোচনা শুরু করে।
– মা, রহিমউল্লা আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস যেভাবেই হোক নুরা বুঝতে পেরেছে আমরা তাকে খবর দিয়ে আনিয়েছি।
– রহিম কি বলেছে?
– তেমন কিছু না, শুধু খোঁজখবর নিল। নুরাই তাকে দিয়ে ফোন করিয়েছে এতে কিান সন্দেহ নেই।
– তাহলে, রহিম এবার আমাকে ফোন দেবে।
রিয়া মনে মনে মায়ের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে। মুখে বলে,
– মা, একদম ঠিক বলেছেন। মায়ের সাথে রহিমের যোগাযোগটা কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে নুরা।
– আমার মনে হয়, নুরা জানে না রহিম মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দেয়।
হঠাৎ সুপয়ার ফোনটা বেজে উঠে। তিনি হাতে নিয়ে দেখেন রহিমের কল। সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করে কল রিসিভ করেন। ওপাশ থেকে রহিম বলে ওঠে,
– আস সালামু আলাইকুম আম্মা, কেমুন আছেন?
– জী, আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– জী আম্মা, আমরা ভালা আছি, আমার ভাই বইনেরা কিমুন আছেন?
– আল্লাহ সবাইকে ভালো রেখেছে। আমার বাড়িটা কেমন আছে? দেখেশুনে রাখছেন তো?
– কি যে কন আম্মা, আপনের একদল সমর্থক থাকতে আপনের বাড়ির কথা চিন্তা করন লাগে। হগলতে মিল্লা দেইখ্খা হুইন্না রাখে।
– হ্যা, তা অবশ্য ঠিক। ওরা আমাকে খুব ভালো বাসে।
– আম্মা, আপনেরা এইবার ঈদেও আইলেন না যে?
– আপনার ভাইয়ের একটু ব্যস্ততা ছিল।
– ঈদে আইলে এট্টু দেহা সাইক্ষাত অয়। কুরবানি ত বাইতই করবেন ইনশাল্লাহ।
– আশা রাখি, দেখি আল্লাহ কি করেন?
– আইয়েন আম্মা, আইলে বালা লাগব আমগো।
– ঠিক আছে, আপনি ভালো থাকবেন।
– আইচ্ছা আম্মা, অহন রাহি, পরে আবার ফোন দিমুনে।
– ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।

সুপয়া মোবাইল টেবিলের উপর রেখে সবার দিকে তাকায়। সুপয়া বলেন,
– রহিম আমাকে মাঝে মাঝেই ফোন করে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন বিশেষ করে ঈদে বাড়ি যাব কিনা জানতে চাওয়াটার মধ্যে রহস্য রয়েছে।
রিশা মাকে প্রশ্ন করে,
– আচ্ছা মা, বলো তো রিয়াদের গুলশানের বাড়ির কথা কে কে জানে?
– আমি কিভাবে বলি? আমি তো কাউকে বলি নি।
– তুমি না বললে কারো জানার কথা নয়। তাহলে বলা যায়, নুরা এখনো সঠিকভাবে কোন কিছু জানে না। সে বড় জোর সন্দেহ করতে পারে। শোভন, তুমি তো নুরাকে দেখেছ। তোমার কেমন মনে হয়েছে তাকে?
শোভন উত্তর দেয়,
আমার সামনে যখন সে আসে তখন সে স্বাভাবিক ছিল না। যে কোন কারণেই হোক সে খুব ভয় পাচ্ছিল। তার উপর সে জানতো না আমি তার আত্মীয়। তাকে শুধুমাত্র একজন গ্রাম্য টাউট হিসেবে বিবেচনা করতে পার।
রিয়াদ হৈ হৈ করে উঠে।
– তোমরা সবাই আমাকে এখনো খোকা ভাব। ভাইয়ার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। নুরা একটা সামান্য টাউট। সর্বোপরি সে শক্তের ভক্ত নরমের যম। তোমরা কিছু ভেব না আমি একাই একে সামলাতে পারব।
রিশা তাকে থামিয়ে দেয়,
– তোমার এতো তাপড়ানোর কিছু নেই। যা কিছু করার সব আলোচনা করে করব।
রিয়াদ মাকে উকিল ধরে,
– মা, তোমার মেয়ে কিন্তু আমাকে আমার বউয়ের সামনে অপমান করলো মনে রেখ।
রিয়া মজা করে বলে,
– আপু, তুমি কিছু বলেছ? আমি কিছু শুনতে পেলাম না কেন?
– বলেছি, গাধাটাকে মাঝে মাঝে কাঁচা ছোলা খাইতে দিও। তাহলে মাথায় একটু বুদ্ধি শুদ্ধি হবে।
রিয়াদ ক্ষেপে যায়,
– তোমরা কিন্তু আমাকে সত্যি অপমান করছো।
শোভন তার পক্ষ নেয়।
– তোমরা বেশি বাড়াবড়ি করছো। রিয়াদ এতোবড় ব্যবসা চালাচ্ছে কি তোমাদের বুদ্ধিতে।
– এদের একটু বোঝান ভাইয়া, এরা আমাকে মানুষ মনে করে না।

তাদের আলোচনায় ছেদ পড়ে বাচ্চাদের হৈহৈ করে রুমে প্রবেশ করাতে। সুপয়ার অতি আদরের নাতনি গাল ফুলিয়ে নানির কাছে বিচার দেয়,
– নানু, ওরা শুধু দু’জনে খেলে আমকে খেলতে দেয় না।
সুপয়া প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
– তাহলে আমরা দু’বোন খেলব, ভাইয়াদের খেলায় নেব না।
সাথে সাথে দীপ্ত বলে উঠে,
– দীদা, আমি ওকে নেব। ভাইয়া তুমি নেবে না?
উৎস মাথা নাড়লে সবাই রুম থেকে বের হয়ে যায়।
শোভন বলে,
– রিয়াদ, তুমি নুরাকে কয়দিন পর আসতে বলেছ?
– ভাইয়া, সাতদিন।
– এক কাজ করলে কেমন হয়, তার পূর্বে রিয়া লোকাল পুলিশকে দিয়ে ডেকে নিয়ে হালকা থ্রেট দিয়ে দিক। আমি যতদূর জানি তার নামে ছোটখাটো অনেক অভিযোগ আছে।
রিয়া সায় দেয়।
– মন্দ বলেন নি ভাইয়া। সে নাকি পুলিশকে অসম্ভব ভয় পায়। তার সাগরেদ বদুর মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
– তাহলে তো আরো ভালো হবে। তার সাহস দপ করে নিভে যাবে। এরপর রিয়াদের কাছে এলে ওর কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।

রিয়াদ বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বলে,
– আমি একটু চোর পুলিশ খেলতে চেয়েছিলাম তা হলো না।
রিশা বলে,
– আরো গাধা, তোর খেলা আরো জমবে।
– জমবে না ছাই। নুরা আমার কাছে এসে হাতজোর করে বসে থাকবে। তাহলে কি খেলে মজা পাব।
এবার রিয়া তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে,
– তুমি বুঝতে পারছো না, এরা শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। তুমি আগামী ঈদে বাড়ি যাবে বলেছ। সে যদি আগে থেকে না জানে তাহলে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তার চেয়ে আমরা সবাই যা চাই তা যদি ঈদের আগে হয়ে যায় তাহলে তোমার ঈদটা কেমন জমবে চিন্তা করেছ?
সুপয়া এবার রিয়াকে সাপোর্ট করে বলে উঠে,
– রিয়া একেবারে ঠিক বলেছে, তুই কি ঝামেলা চাস নাকি তোর বাবার স্বপ্নপূরণ চাস?
– মা, তুমি কি বলো, আমি ঝামেলা চাইব কেন? আমি বাবার স্বপ্নপূরণের সাথে সাথে ক্ষতিপূরণ চাই।
– ক্ষতিপূরণ দিয়ে কি করবি বাবা? আল্লাহ তোকে অনেক দিয়েছে।
শোভন বলে,
– আম্মা, কখনো কখনো ক্ষতিপূরণটা নিতে হয় কাউকে শিক্ষা দেবার জন্য। এক্ষেত্রে আলোচনা সাপেক্ষে আমরা অনেক কিছু ছাড় দেব কিন্তু শুরুতে নয়। তারা আগে এগিয়ে আসুক। দেখা যাক তারা কতদূর করতে রাজি হয়।
রিশা বলে,
– মা, তুমি কিন্তু আবার আগে থেকেই সব কিছু মাফ করে দেবার ব্যবস্থা করে রেখ না।
– ঠিক আছে, তোদের যেভাবে ভালো মনে হয় কর।
– মা, তুমি রাগ করো না। তারা কিন্তু বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে হিসেব করলে তাদের ভিটে মাটি কিছুই রক্ষা পাবে না। তারা কিন্তু তোমার স্বামীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এটুকু ভুলো না।
– নারে মা, সে দিনগুলোর কথা কখনো আমি ভুলতে পারব না। তোর বাবা যে কি পরিমাণ পরিশ্রম করেছে।
সুপয়ার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বের হতে থাকে। রিয়া রিশা দু’জনেই মাকে দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।
– মা, তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য বলিনি। রিয়াদের কিছু মনে নেই কিন্তু আমারতো সেই কষ্ট অনেকটাই মনে আছে। আমি তো কিছুতেই ওদের মন থেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার মন চায় তাদের তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে বুঝিয়ে দিই সম্পদ অপহরণ করলে কেমন লাগে। রিয়াদকে কখনো দোষ দিও না মা। ওর মনটা অনেক বেশি সেনসেটিভ। সে নুরাকে নিয়ে খেলতে চাচ্ছে, এতে তার কোন দোষ নেই।

রিয়াদ আপুকে এক সাথে এতো কথা বলতে শুনে নি কখনো। সে শুধু জানে আপু তাকে অনেক ভালোবাসে। সে নিজেও রিশাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আজ থেকে সে ভালোবাসা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেল। রিয়াদ এতোদিন আপুকে ভুল বুঝেছে। দুলাভাই যখন তাদের জেলার ডিসি ছিলেন তখন রিয়াদ আবেগের তাড়নায় কিছু করতে চেয়েছে। রিশা বারবার তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। সে আজ বুঝতে পারছে রিশাও চায় বাবার উপর অন্যায় করার প্রতিশোধ নিতে। রিয়াদ রিশার হাতদুটো ধরে বলে,
– আপু, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি তোকে মনে মনে ভুল বুঝেছিলাম। তুই দেরি করছিলি দেখে আমি তোর উপর রাগ করছিলাম।
– ধুর গাধা, তুই গাধাই রয়ে গেলি। আমি কি কখনো তোর উপর রাগ করতে পারি? তুই আমার একমাত্র ভাই। তোকে আমার চেয়ে কে বেশি চিনে বল? শোভনের কথা মতো রিয়া কাজ করতে থাকুক। তোর কোন আপত্তি নেই তো?
– আপু, আমার আপত্তির প্রশ্নই আসে না। তোমাকে না জানিয়ে আমি আর কিছু করব না।
– মারব এক থাপ্পর, বল রিয়াকে না জানিয়ে কিছু করবি না।
– তোমাকে আগে জানাব, তারপর তুমি যেভাবে বলবে আমি তাই করব।
গোঁয়ারের মতো রিয়াদ উত্তর দেয়।
– মা যতদিন আছে, আগে মার পরামর্শ নিবি, দেখবি সব কিছু পরিষ্কার।
– আমি তো মার কথা মতই চলি।
– ঠিক আছে, তবে বউয়ের পরামর্শ নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হলো বাবার মতো খাবার টেবিলে সব আলোচনা করবি, দেখবি ভুল খুব কম হবে। আমি বাবার এ কাজটি সব সময় অনুসরণ করি।
সুপয়া বলে ওঠে,
– তোদের আলোচনা প্রায় শেষ। আমি ওদের শোয়ানোর ব্যবস্থা করি আর তোদের চা দিতে বলি।
রিয়া বাঁধা দেয়,
– না মা, তুমি তোমার নাতি নাতনিদের দেখ, আমি সবার জন্য চা নিয়ে আসি। দুলাভাইয়ের একটু সেবা করার সুযোগ নেই। সামনে ঈদ আসছে। নচেৎ দেখা যাবে আমার সালামীর প্যাকেটের স্বাস্থ্য কমে যাবে।
রিয়া ও সুপয়া বের হয়ে যাবার পর শুরু হয় ভাই বোনের খুনসুটি। শোভন চুপচাপ তাদের ভালোবাসার উত্তাপ পেতে থাকে।

চলবে——-

-বাউল সাজু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *