“একজন বীরাঙ্গনা” (প্রথম খন্ড)

১.

গাড়ির ডিকিতে উঁকি দিয়ে মালিহা হতভম্ব। সে আগুন চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকাল, ‘ইয়াকুব, তুমি লাল ব্যাগটা গাড়িতে ওঠাওনি?’

‘কুন ব্যাগ?’

‘যেটা তোমার হাতে দিলাম আমি। বললাম সোজা ভাবে রাখবা,কাত যেন না হয়! কী করেছ ব্যাগটা?’ মালিহা গলা তুলতেই খালিদ আহমেদ দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হলেন, ‘কী হয়েছে মলি, চেঁচাচ্ছ কেন?’

স্বামীর দিকে তাকালেন মালিহা, ‘বেতন দিয়ে তো কতগুলি অপদার্থ রাখ। গ্রামের বাড়ির লোক শুনলেই হয়েছে! আর কথা নেই। কী করেছে সে দেখ! নাশতার ব্যাগটাই ফেলে এসেছে। এখন কী খাবে সবাই?’

খালিদ সাহেব বুঝতে পারছেন না এই পরিস্থিতি ঠিক কীভাবে সামাল দেবেন। তিনি ইয়াকুবের দিকে তাকালেন, ‘তুমি কি গাধা, মাথায় কিছু নাই?’ সরি বল ম্যাডামরে!’

ইয়াকুব দাঁত বের করে বলল, ‘সরি ম্যাডাম।’

মালিহা ক্রুদ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন, ‘ওরে বলবা দাঁত ব্রাশ করতে। নোংরা দাঁত নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সব সময়।’

হৈচৈ শুনে নিতু বাবার পাশে এসে দাঁড়াল, ‘কাহিনী কী, বাবা?’ ‘আর বলিস না! ইয়াকুব গাধাটা ব্রেকফাস্টের ব্যাগটা ফেলে এসেছে বাসায়। এখন বোঝ পরিস্থিতি। তোর মা পারলে ইয়াকুবকে খেয়ে ফেলে।’

নিতু মালিহার দিকে এগোলো, ‘বাদ দাও না, মা! সামনের একটা দোকান থেকে চা বিস্কুট খেয়ে ফেলি, চল। ফেলে যখন এসেছে তখন তো আর কিছু করার নেই।’

‘তুমি চুপ কর, শুধু আমরা হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে একজন গেস্ট আছে। সে কী ভাববে, বলতো?’

‘মা, আমার মনে হয় না এই ভদ্রলোক খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী। ঐ দেখ সে নদীর কাছে চলে গেছে ছবি তুলতে। এই সব মানুষ সাধু-সন্ন্যাসী টাইপের হয়। খিদে পায় না, বুঝলা?’ নিতুর কথা শুনে খালিদ সাহেব হাসলেন, ‘চল, সবাই মিলে ঐ দোকানে চা খাই। তারপর ধীরে সুস্থে নদী পার হই। দাঁড়াও, জামিকে ডাকি। ওর সঙ্গে তো পরিচয়ই হয়নি তোমাদের।’

‘আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বাবা। খুবই ফাজিল টাইপের লোক। সকালবেলা আমি দোতলা থেকে নেমে দেখি, বাগানে ছবি তুলছে। আমি সালাম দিয়ে বললাম, আমি নিতু, ভালো আছেন? সে আমাকে বলে, হ্যাঁ ভালো। তুমি স্যারের মেয়ে? আমি জেমস বন্ড! কী পরিমাণ ফাজিল চিন্তা কর! এইসব ফাজিল লোক আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।’

খালিদ সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন, ‘এইসব বলেছে নাকি? ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে। অনেক ব্রিলিয়ান্ট। আমার ছাত্র ছিল। ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকে এখন। ওখানে বেশ নামডাক ওর, ফটোগ্রাফির বই বেরিয়েছে দুইটা। বাংলাদেশে এসেছে অনেক ভালো একটা উদ্দেশ্যে। দেশের ইতিহাস আর বৈচিত্রের ওপর একটা ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন করতে চায়। তাই নিয়া আসছি ওরে। আমাদের সঙ্গে গেলে ওর কাজ এগুবে।’

সামনে এগিয়ে ইয়াকুবকে ডাকলেন খালিদ সাহেব, ‘শোনো, গাড়ি নিয়ে সোজা বাসায় যাবে। গাড়ি রেখে গ্যারেজ তালাবন্ধ করে দেবে, আর ফোন খোলা রাখবে সব সময়। বুঝেছো?’

ইয়াকুব হাসল, ‘জি স্যার।’

খালেদ তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, ইয়াকুবের দাঁতগুলি আসলেই নোংরা। মালিহা ভুল বলে নাই।

একটা ট্রলার রিজার্ভ করা হয়েছে। বছরের এই সময়টাতে খালিদ সাহেব পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যান। নিজের বেড়ে ওঠার অতি পরিচিত পরিবেশ। স্কুল, কলেজ, বন্ধু বান্ধব তাকে প্রচন্ড টানে। মলি প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও এখন আর কিছু বলে না। নিতুও অনেক আনন্দ পায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির বেশ নামকরা শিক্ষক খালিদ আহমেদ। গ্রামের মানুষ তাকে অনেক সম্মান করে। একটা বিশেষ বয়সের পর মানুষ তার প্রাপ্ত সম্মান উপভোগ করতে খুব ভালোবাসে।

২.
বাড়ির দরজায় পা রাখতেই জমির মিয়া ছুটে এল, ‘ছোট সাব আসছে, ছোট সাব আসছে’ বলে পুরা বাড়িতে হইচই বাঁধিয়ে দিলো।

মায়ের ঘরে ঢুকলেন খালিদ সাহেব। সালাম করলেন,‘কেমন আছেন আম্মা?’

‘ভালো আছি।’ জয়নব বেগম ফুলিকে ডাকলেন, ‘ওদের ব্যাগগুলান নিয়া যা ওদের ঘরে। হাত মুখ ধোয়ার পানি দে। আর আবুর মারে বল খাবার ঘরে নাশতা দিতে। খালিদ আয়, কাছে বস। দাড়িওয়ালা ঐ পোলাডা কেডা তর লগে?’

‘আম্মা আমার ছাত্র। ও ফটোগ্রাফার, মানে ছবি তোলে। বিদেশে অনেক নাম ডাক।’

‘কয়দিন থাকবি এবার?’

মালিহা ঘরে ঢুকলো, ‘আম্মা, ভালো আছেন?’

জয়নাব বেগম মালিহার হাতের দিকে তাকালেন, ‘হাতে এইডা কী? শোনো বৌমা, প্রতিবারই আসার সময় তুমি আমার জন্য এইটা ওইটা নিয়া আস, এইডা আমি পছন্দ করি না। নিয়ম করে উপহার আনতে হবে কেন? তোমরা আসো তাতেই আমি খুশি হই। আর আনবা না এসব।’

‘জ্বী আম্মা, আনব না।’

‘নিতু কই, তারে তো দেখলাম না। আর তোমাদের সঙ্গে যে ছেলেটা আসছে ওর থাকা খাওয়ার ব্যাপারে খেয়াল রাইখ, সে এ বাড়ির মেহমান।’

‘বড় আম্মা, খাবার দেয়া হইছে টেবিলে।’

‘যাও, খাইয়া নেও তোমরা।’ জয়নব বেগম ফুলির দিকে তাকালেন, ‘তুই ঠোঁটে এগুলা কী মাখছস? থাপড়াইয়া তোর দাঁত ফালাইয়া দিব আমি। মোছ, এক্ষন মোছ। বজ্জাত মাইয়া!’ ফুলি কাঁদো কাঁদো মুখে ওড়না দিয়ে লিপস্টিক মুছে ফেলল।

মালিহা খুব কষ্ট করে হাসি চাপিয়ে রেখেছে, তার শ্বাশুড়ির বয়স নব্বইয়ের কোঠায়। এখনও তার ব্যক্তিত্ব আভিজাত্য চোখে লাগার মতো। এই মহিলাকে সে অসম্ভব পছন্দ করে।

‘কই ছিলি তুই এতক্ষণ। আইসাই চড়াইতে নামছিস। দাড়িওয়ালা পোলাটা খাইছে?’

নিতু হাসতে লাগলো। কী ভাষা! দাড়িওয়ালা পোলা! ‘শোনো দাদি, আমি গতবছর পুকুরপাড়ে একটা বকুলগাছ লাগিয়ে ছিলাম। কত বড় হয়েছে গাছটা! আমি গাছটারে গিয়ে বললাম, হ্যালো, আপনার কি আমার কথা মনে আছে? হি হি হি।’

‘হুম। গাছটায় কী কইল?’

‘গাছটায় কী কইল মানে? গাছ কি কথা বলতে পারে নাকি? সেতো বাতাসে দুলছে।’

জয়নব বেগম হাসলেন, ‘তাইলে সে তরে সালাম দিছে।’

নিতু ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল, ‘তাই? আমি তো সেটা বুঝতে পারিনি, সোফিয়া লরেন।’

‘হ্যায় কেডা?’

নিতু হাসতে লাগল, ‘তোমার নাম দিলাম। সুন্দর না?’

‘ফাজিল। এদিক আয় তরে একটু জড়াইয়া ধরি।’ গভীর স্নেহে নিতুকে জড়িয়ে ধরলেন জয়নব বেগম।

৩.
বাড়ির পুবদিকের একটা রাস্তা সোজা গিয়ে বড় রাস্তায় মিলেছে। এই রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে নিতুর অনেক ভালো লাগে। কেমন নীরব। রাস্তাটা পিছল, সাবধানে পা ফেলল নিতু।

‘তুমি কি রেগে আছে আমার ওপর?’

চমকে উঠল নিতু। হাতে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবার ফটোগ্রাফার ছাত্র।

‘সকালবেলা একটু ফ্লার্ট করেছিলাম। রেগে আছ বোধহয়, সরি। আমি জামশেদ। জামি ডাকতে পারো।’

‘আপনি কি আমাকে ফলো করছেন? আশ্চর্য! প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি আপনার মধ্যে একটা গায়েপড়া ভাব আছে। শুনুন, বিদেশে থাকা লোকজন আমি একদম পছন্দ করি না। সারাবছর বিদেশে বাঁদরামি করে দেশে এসে এরা মহান সাজে। এই যে দেশ নিয়ে আপনি এত মাতামাতি করছেন, এক্সিবিশন-ফেক্সিবিশন করতে চাইছেন, এগুলি সব ফাজলামি। বাবা বোঝেন না কিন্তু আমি বুঝি। সো, আমার ধারে কাছে আসবেন না আপনি। আর আপনি বাবার লুঙ্গি পরেছেন কেন?’

জামি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার এত উত্তেজনার কারণ ঠিক বুঝতে পারছেনা সে। এই বয়সের মেয়েগুলিই কেমন অদ্ভুত হয়।

বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত চলে এল নিতু। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে তার। দুপুরবেলা খাবার পর শুয়ে বই পড়ছিল, ফুলি এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে আঁতকে উঠল নিতু। কটকটে হলুদ রঙের জামা গায়ে লাল রঙের লিপিস্টিক দিয়ে দাঁত সব বের করে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলির গায়ের রং কালো। রীতিমতো ভয়াবহ লাগছিল তাকে। ‘কী ব্যাপার, এত সেজেগুঁজে কই যাস তুই?’ বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস করল নিতু। ‘দুলাভাই কইছে আমার ছবি তুইলা দিব।’ লিপস্টিক লাগা দাঁত বের করে হাসতে লাগলো সে।

‘দুলাভাই কে?’ নিতু অবাক।

ফুলি হাসতে লাগলো। নিতুর বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। বই রেখে দাড়িয়ে ঠাস করে ফুলির গালে চড় দিলো সে, ‘চোখের সামনে দিয়ে এক্ষণ চলে যা।’

চড় খাওয়া গালে হাত রেখে ফুলি হাসতে লাগলো,‘আমার কী দোষ? আবুর মায়েই না কইছে, দাড়িয়ালা ভাইজানের লগে আফনের বিয়া হইব।’

মেজাজটা সেই থেকেই বিগড়ে ছিল।
লোকটাকে দেখে আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বোধ হয়।

‘নিতু না! কবে আসছ?’

চমকে উঠল নিতু। তার চোখ উজ্জ্বল হলো, ‘ভালো আছেন, ফুপু? আজই এলাম সকালে।’

যেবু হাত ধরল, ‘আসো ঘরে আস, একটু বসবা।’

‘মা চিন্তা করবে। বলে আসিনি তো।’

‘একটু বসো। তারপর চলে যাইয়ো।’

এত ভালোবাসার অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না, একটুখানি বসেই নিতু উঠে দাঁড়াল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যার আজান কানে আসছিল। উঠোনে পা দিতেই মায়ের সামনে পড়ল নিতু, ‘আমি আসলে বুঝলাম না। এখানে এলেই তোমার আর তোমার বাবার কী হয়? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কাউকে কিছু বলে যাওনি, ফাজিল মেয়ে। আমি দুশ্চিন্তায় শেষ।’

আড়চোখে বারান্দায় তাকাল নিতু। বাবার ছাত্র তাকিয়ে আছে। অসম্ভব লজ্জা পেল সে। লোকটার সামনে মা সমানে বকে যাচ্ছে তাকে।

‘সরো। পুরো খাট নিয়ে শুয়ে আছ, আমি শোব কোথায়?’

জয়নব বেগম হাসলেন, ‘আমার সঙ্গে রাগ দেখাস ক্যান? আমি কি কিছু কইছি তোরে?’

বালিশ কোলে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল নিতু।

‘কই গেছিলি তুই? ফুলি কইল পিছনের রাস্তায় যাইতে দেখছে তোরে। যেবুর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলি?

নিতু উঠে বসল, ‘আমি এমনি হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। পথে দেখা হল ফুপুর সঙ্গে। উনি খুব করে বসতে বললেন, না করতে পারলাম না। তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।’

‘তুই প্রতিবার আসলেই যেবুর বাড়ি যাস, জানি আমি।’

‘দাদি উনি আমারে অনেক আদর করেন। আমি যতক্ষণ বসি, হাত ধরে থাকেন। কেমন মায়া লাগে।’

‘তুই আর যাবিনা। কক্ষনো যাবি না।’

‘কেন যাব না, গেলে কী হয়?’

প্রচন্ড জোরে ধমক দিলেন জয়নব বেগম, ‘যাইতে না করছি. যাবি না। এত কথা কস ক্যান?’

দাদির এই প্রতিক্রিয়ায় সাংঘাতিক অবাক হলো নিতু।

৪.
বেশ কুয়াশা পড়েছে। সামনে এগিয়ে যেতেই জামিকে দেখতে পেল সে। গভীর মনোযোগে ছবি তুলছে। ‘আপনি কি প্রতিদিন এত সকালে ওঠেন?’

জামি হাসল, ‘হুম। আমি আরলি রাইজার। দিনের শুরু দেখতে আমার অনেক ভালো লাগে।’

‘আমার একটা ছবি তুলে দেবেন?’

জামি শব্দ করে হাসল, ‘তুমি অনেক বুদ্ধিমতী, কাল বিকেলে কোথায় গিয়েছিলে? আন্টি খুব টেনশনে করছিলেন।’

নিতু চুপ করে রইল। কালরাতে দাদির কথা মনে হলো তার, “চলেন হাঁটি।” পুকুরঘাটে মতির মাকে দেখতে পেল। উঁবু হয়ে বাসন মাজছে। অনেকটা পথ হাঁটায় হাফ ধরে গেল, আম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল নিতু।

‘আর যাবে না?’

‘না। চলেন, ফিরি। মা আবার চিন্তা করবেন।’

ফিরতে ফিরতে সূর্য উঠে গেল।পুরো সকালটা গেল হৈচৈ আর ঝামেলার মধ্যে দিয়ে। খালিদ সাহেব লোকজন ডেকে পুকুর থেকে মাছ ধরালেন। প্রকান্ড সাইজের একটা রুইমাছ নিয়ে জমির মিয়া উঠোনে রাখল। ধরে আনল জামিকে, ‘ভাইজান এই মাছের লগে আমার একটা ফটো তুইলা দেন।’ মাছটাকে দুহাতে জাপটে ধরল জমির, ‘এত বড় মাছ অনেক দিন বাদে পাইলাম ভাইজান। দেখেন কানের ধার ডা কেমন লাল! এই মাছের স্বাদই আলাদা! কাইটা ফেলনের আগে একখান ছবি তুলতাম চাই এর লগে ভাইজান!’

মানুষের নির্ভেজাল উচ্ছ্বাস আর আনন্দের দৃশ্য খুবই দুর্লভ, জামি খুব যত্ন করে ফ্রেমে বন্দি করল এই সময়টুকুকে। দুপুরে খুব আয়োজন করে মাছ রান্না হলো। জয়নব বেগম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রান্না করালেন। খাওয়া দাওয়া শেষে নিতু দাদির ঘরে গেল, ‘একটু পান খাওয়াবে, দাদি?’

যত্ন করে পান বানালেন জয়নব বেগম, ‘মাঝে মাঝে একটুআধটু পান খাইলে ক্ষতি নাই।’

মুখভর্তি পান নিয়ে বেরোতেই মালিহা ডাকলেন, ‘মুখে কী নিতু, পান খেয়েছ তুমি? এসব কী শুরু করেছ? তোমার বাবাকে দেখলাম হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে পুকুরপাড়ে বসে আছে! অদ্ভুত! এইসব গাইয়া স্বভাব তুমি আসলে তোমার বাবার কাছে থেকে পেয়েছ।’

নিতু হাসতে গিয়ে পানের পিক ফেলে দিলো কাপড়ে। মালিহা তীব্র বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। নিতু খুব মজা পাচ্ছে, কিছু বলতে পারছে না। কারণ পানের রসে তার মুখ ভর্তি হয়ে আছে। সে পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

‘নিতু আফা, একটা জরুরী কথা কইতে চাই আপনারে।’

আবুর মাকে দেখতে পেল নিতু। পানের পিক ফেলে দিলো সে, ‘কী কথা?’

‘এইখানে না, আপনে রান্নাঘরে চলেন। আসেন আমার সঙ্গে।’ আবুর মা নিতুকে হাত ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেল, ‘শোনেন আফা, পুবদিকের আমগাছওয়ালা বাড়িডায় আর যাইয়েন না। গ্রামের কেউ ঐ বাড়িতে যায় না। বড় আম্মা জানলে খুব রাগ হইব।’

মেজাজ খারাপ হলো নিতুর, ‘আমি যে গ্রামে এলেই ঐ বাড়িতে যাই এই খবর কে দেয় দাদিকে, নিশ্চয়ই তুমি?’

‘আল্লাহর কসম, আফা। আমি বলি নাই, মসজিদের ইমাম সাব বলছে। আজ সকালেও আপনে দাড়িওয়ালা ভাইজানরে নিয়া ঐখানে দাঁড়াইয়া ছিলেন। ইমাম সাব বলে গেছে এই কথা।’

নিতুর এবার অবাক হবার পালা, ‘যেবু ফুপু তো অনেকভালো মানুষ। আমাকে কত আদর করে! গ্রামের মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে কেন? আবুর মা, আমাকে বল প্লিজ কী করেছে তারা। আমি কথা দিচ্ছি কাউকে কিছু বলবনা, প্লিজ।’ আবুর মায়ের হাত ধরল সে।

আবুর মা চুপ করে রইল কতক্ষণ, ‘অনেক কথা, আফা। আমি এই বাড়িতে আছি প্রায় ত্রিশ বছর। আপনার দাদা গ্রামের খুব মানি লোক ছিলেন। তিনি আমারে নিয়া আইছিলেন চর থেইক্যা। ৭০ সনের বন্যায় আমার বাপ-মা ঘরবাড়ি সব ভাইসা যায়। এতিম আমারে বড় আম্মার কাছে দিয়া বড়সাব কইলেন, ‘এই মাইয়াডারে রাইখা দাও।’ আমি এইখানেই বড় হইছি। দেইখা শুইনা বিয়া দেন তারা। আবুর বাপ ফালাইয়া চইলা গেলে আমারে আবার নিয়া আসেন বড় আম্মা। এই বাড়ির সব ঘটনার সাক্ষী আমি।
প্রথম যখন আসলাম, ছোটসাব মানে আপনার আব্বা তখন কলেজে পড়েন ঢাকায়। মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসতেন। আসলেই আমারে বলতেন, আমগাছওয়ালা বাড়িটায় গিয়া এই খামটা যেবুরে দিবি। আমি ছোট হইলেও সব বুঝতাম। মাঝে মাঝে পুবদিকের বাগানে বইসা তারা কথা বলতেন। আমি পাহারা দিতাম। দুজন দুজনরে কী যে ভালোবাসতেন! কিছুদিন পরে যুদ্ধ শুরু হইল। চারদিকে ভয়ানক অবস্থা! ছোটসাব গ্রামে চইলা আসলেন। গ্রাম ভইরা গেল পাকিস্তানি সেনায়। বড়সাব ছাগল, মুরগি, চালের বস্তা আরও অনেক কিছু নিয়া দেখা করতে গেলেন পাকিস্তানি ক্যাম্পে। এই নিয়া বড়সাবের লগে ছোটসাবের অনেক ঝগড়া হইল। ছোটসাব রাগ কইরা বাড়ি ছাইড়া চইলা গেলেন। পাকিস্তানি অফিসারগুলা প্রায়ই আসত এই বাড়িতে। আর বড়সাব তাগোরে সম্মান দিয়া মেহমানদারি করতেন। একরাতে হঠাৎ যেবু খালার মা আসলেন কানতে কানতে, বড়সাবের পা দুইটা ধইরা কইলেন, ‘ভাইজান, আমার মেয়েডারে ওরা তুইলা নিয়া গেছে। আপনি আমার মেয়েডারে বাঁচান। আপনি বললেই ওরা ছেড়ে দেবে যেবুরে।’ বড়সাব চুপ কইরা রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর কইলেন, ‘বাড়ি যাও যেবুর মা, মনে কর তোমার মেয়েরে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিছ।’ আমার মনে আছে যেবু খালার মা যায় নাই। সারাটা রাত উঠানে বইসা কানছে।’ চোখ মুছল আবুর মা।

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? যুদ্ধ শেষ হইল। ক্যাম্প থেইক্যা যেবু খালা ছাড়া পাইল। তার সঙ্গে গ্রামের আরও কয়েকটা মাইয়া ছিল। দুঃখের বিষয় কী জানেন? গ্রামের সবাই তাগোরে এমনভাবে দেখত যেন তারা বিরাট কোনো অন্যায় করছে। কেউ কথা কইত না তাগো সঙ্গে। শালিস বসল গ্রামে, সিদ্ধান্ত হইল এই সব মাইয়ারা গ্রামে থাকতে পারব না। এরা হইল-অপয়া, অলক্ষ্মী। জানেন আফা, কেউ কিছু কইল না। সবাই মাইনা নিল চুপচাপ।’

‘এই সিদ্ধান্ত কে দিয়েছিল, আমার দাদা?’ মাথা নিচু করে রইল আবুর মা। ‘তারপর?’

‘তারপর এই মেয়েগুলারে নিয়া তাদের পরিবার গ্রাম ছাড়া হইল। গেল না শুধু যেবু খালা। মনে হয়, সে ভাইজানের জন্য অপেক্ষা করতে ছিল। কিন্তু ভাইজান তখনও গ্রামে ফেরে নাই। তার কিছুদিন বাদে একদিন সকালবেলা শুনলাম যেবু খালারে পাওয়া যাইতেছে না। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না। সে ফেরত আসে প্রায় দুইবছর পর।’

‘কোথায় গিয়েছিল যেবু ফুপু?’

‘কেউ জানে না। কাউরে কিছু কয় নাই সে। বাড়ি থিকা খুব একটা বের হয় না। মাঝেসাঝে আমার সঙ্গে দেখা হলে বলে, ‘তোমার বড় আম্মা ভালো আছে?’

‘যুদ্ধের পর বাবা গ্রামে ফিরেছিলেন কখন?’

‘ছোটসাব অনেকদিন পর আসেন। যেবু খালা তখন নিরুদ্দেশ। ভাইজান অনেক জায়গায় খোঁজ করেন তারে। কিন্তু কোনো হদিস পান নাই। তারপর ঢাকায় চইলা যান আবার। বড়সাব যে কয়দিন বাইচা ছিলেন। তিনি কোনোদিন এই বাড়িতে আসেন নাই।’

সন্ধ্যার আজান পড়ছে। অন্ধকার নেমে আসছে ক্রমশ। নিতু স্তব্ধ হয়ে রইল, নিজেকে কেমন অশরীরী মনে হচ্ছে…..৷

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *