একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ও আমাদের সমাজ

সুমি ম্যাডাম, আমি ইন্সপেক্টর রাশেদ। আপনাকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করবো। আপনার মনের অবস্থা পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা অনুধাবন করতে পারছি। কিন্তু আমি নিরুপায়, বুঝতেই পারছেন।

– জ্বী বলুন। আমি চেষ্টা করবো জবাব দিতে যা যা জানি।

আপনাদের মধ্যে কি কোনরকম বাদানুবাদ চলছিলো, গত কয়েকদিন? কোন ঝগড়াঝাটি বা হাতাহাতির মতো কোন ব্যাপার?

– দিপু খুবই অন্যরকম মানুষ। আমার দশ বছরের বিবাহীত জীবনে ও কখনো উঁচু গলায় কোন কথা বলেনি। খুবই সংসারী আর ঘরোয়া ধরনের ও। অফিস থেকে সরাসরি বাসায় আসতো। কোথাও আটকে গেলে সাথে সাথে ফোন দিয়ে আমাকে জানাতো।

ওনার কোন ধরনের মানসিক সমস্যা ছিল? বা কোন ধরনের ড্রাগস বা নেশার কিছু?

– বিয়ের কয়েক বছর পর আমি জানতে পারি ওর মানসিক সমস্যার কথা। ও কাউকে দেখতে পেতো মাঝে মাঝে। কিন্তু ওদের পারিবারিক সাইকিয়াট্রিস্ট ছিল যে কিনা ওকে রেগুলার চেকাপে রাখতো। ও নিয়মিত ওষুধ খেতো। সপ্তাহ দুয়েক পরপর ওনার চেম্বার যেয়ে দেখিয়ে আসতো। খুব ঝামেলার কিছু কখনোই হয়নি। ও নিজেই নিজের যত্ন নিত তাই আমার খুব একটা খেয়াল না রাখলেও হতো। আর গত তিন সপ্তাহ তো আমি বাবার বাসায় ছিলাম। দিহান, মানে আমাদের মেয়েটার স্কুল ছুটিতে গিয়েছিলাম। ও আমাদের আনতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরে ফোন করে জানিয়েছে ওর কাজ আছে, যেতে পারবেনা।

আমরা ওনার কল লিস্ট দেখেছি। রাতে শেষ কথা হয় আপনার সাথে আনুমানিক দশটা নাগাদ। মৃত্যুর সময় ধারনা করা হচ্ছে রাত দুটো। শেষ কথা বলার সময় কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন?

– আমি একটু মন খারাপ করেছিলাম, ও নিতে আসবেনা বলাতে। ও কে অবশ্য একটু ক্লান্ত শোনাচ্ছিল।

ঠিক আছে ম্যাডাম আজ এই পর্যন্তই। আপনি ওনার ময়নাতদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাসায় থাকবেন আশা করি। আমরা দরকার পরলে এসে কথা বলে যাব। আপনি তো বোধহয় একটা সরকারী কলেজে আছেন?

– জ্বী। কাল থেকে আমার কাজ আছে।

চাইলে কাজ শুরু করতে পারেন। আমার কার্ড রইলো। কোন কিছু মনে পরলে বা বলার মতো মনে হলে জানাবেন প্লিজ।

…………..

মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ভাবছিলাম আমার জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঝড়ের কথা। দিপুর মৃত্যু আমাকে এমন একটা জীবনের মুখোমুখি করে দেবে স্বপ্নেও ভাবিনি। একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু কি এতোই মুখরোচক খবর; যার যা মনে চায় যেভাবে ইচ্ছে গল্প বানিয়ে যাবে। শুধু গল্প বানিয়ে থামলেও হতো সেটা আমাকে বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বুঝি স্বস্তি নেই কারো। ইনিয়ে বিনিয়ে লোকে কি বলেছে, নিজে কি ভেবেছে, আমার কি করা উচিত; সব সব পরামর্শ বাকী সবাই জানে শুধু আমি ছাড়া। অথচ বিস্ময়কর হলেও কঠিন সত্য হচ্ছে জীবনটা আমার, এটা বয়ে বেড়াবার দায়িত্ব ও আমার; এটা যেন সবাই বেমালুম ভুলে বসে আছে।

…………

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এসেছে মাত্রাতিরিক্ত এন্টি সাইকোটিক ড্রাগের প্রভাব, সাথে হাতের একটা বড় রক্তনালী কেটে গিয়ে দীর্ঘসময় রক্তক্ষরনে মৃত্যু। দিপুকে কবর দিয়ে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঘরে ফিরেছি কয়েকদিন হলো।
এই এপার্টমেন্টে আমরা আছি প্রায় পাঁচ বছর। কমবেশী সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু দিপুর মৃত্যুর পর আমি যেন নতুন করে সবাইকে চিনলাম আবার। রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত আমার, দিপুর চরিত্র থেকে শুরু করে জীবন যাত্রার যাবতীয় ইতিহাস ছিল সবার মুখে মুখে। সামনে সামনে আহা কি সুন্দর কাপল ছিল আর পিছু ফিরতেই ভোল পাল্টে বাজে কথার মহড়া শুরু হতো। যেন আমার কারণেই দিপু মারা গেছে। রিপোর্ট জানার পরও কেউ খুশী না। আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো গেলোনা সেভাবে। আর দিপুকে কেন স্বাভাবিক কবর দেয়া হলো তা নিয়ে তো জোর সমালোচনা। সাথে আছে কিছু পুরুষ মানুষের অকারণ অযাচিত দুঃখ দেখানো সাথে অন্যরকম দৃষ্টি।

কলেজে গিয়েছিলাম ছুটির দরখাস্ত দিতে। রেহাই মেলেনি কথার চাবুক থেকে। কি দপ্তরী কি প্রিন্সিপাল, সবাই যেন হা করে ছিল কিভাবে আরেকটি নতুন ডালপালা গজানো গল্প বানানো যায়। একা ভয় পাব ভেবে বাবা মা চেয়েছিলেন তাদের কাছে যেয়ে থাকি। থেকেছিলাম ও। কিন্তু ভাইয়ের ঘরের বদ্ধ দরজার ওপাশে হওয়া আলোচনা টুকু ছিল আমাদের নিয়ে। আমাদের থাকাটা যে বোঝার মতো হয়ে যাবে বাবার বাড়িতেও ঐ কথার সুরটুকুতে বুঝে গেলাম বেশ। বাবা মা রাখতে চাইলেও আর থাকার সাহসটুকু করিনি। দিপুদের বাড়িতে এখনো মনে করে আমি আমার বাবার বাড়ি না গেলে দিপু এভাবে মারা যেতোনা। আমার অবহেলাই ওর মৃত্যুর কারণ।

কত কি জবাব দেওয়া যেত এই কথাগুলোর। কিন্তু কয়জনকে জবাব দেব? কতজনের মুখ আমি বন্ধ করবো?
কেউ যদি সত্য জেনেও মিথ্যার পরিচর্যা করতে চায়, চুপ করে থাকা ছাড়া সেখানে আর কি ই বা করার থাকে?

………….

সিদ্ধান্ত নিয়েছি মেয়েকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। মেয়েটা আজ কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে ফিরেছে। স্কুলে নাকী ওর বাবাকে নিয়ে বাকী ছেলেমেয়েরা বাজে কথা বলেছে। অফিসে কাল বদলির জন্য দরখাস্ত করবো। অন্য কোন শহরে আমরা মা মেয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করি।

জীবনে যার উপস্হিতিতে সুখী দম্পতি হিসাবে অন্যের ঈর্ষার কারণ হতাম, তারই অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন আমাদের মা মেয়েকে মূকাভিনয়ের নাট্যমঞ্চে তুলে দিল, যেখানে সবার কথা বলার অধিকার আছে শুধু আমাদের ছাড়া।

মনে একটাই প্রশ্ন থেকে থেকে আসছে, আমি যদি ওভাবে মারা যেতাম তাহলে দিপু ও কি এরকম কিছুর মুখোমুখি হতো? নাকী আমি মেয়ে বলে আমার ভাগেই কথা শোনার পরিমাণটুকু বেশী থাকছে? অথবা যদি ও স্বাভাবিকভাবেই মারা যেতো, তাহলেও কি লোকে এভাবেই আমার পিছু নিত। বড় অদ্ভুত এক সমাজে বাস করি আমরা যেখানে একলা মেয়েকে অপদস্ত করার মাঝে বুঝি লোকে অন্যরকম সুখ খুঁজে পায়।

‘আমাদের দিন কাটে অন্যের
লাভক্ষতি গুনে,
আমাদের শেকড়টা খেয়ে যায়
পরশ্রীকাতরতার ঘুনে।’
(সাদাত হোসাইন)

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *