ক্যাবলা বর

বরাবরই চাইতাম আমার যে বর হবে তার অনেক রাগ থাকবে,নিজের সিদ্ধান্তে চলবে, আমাকে গুরুত্ব দিবে কিন্তু মাথায় চড়াবেনা। মুখে একটা গম্ভীরতার ছাপ থাকবে কিন্তু ইনওয়ার্ডলি বেশ রোমান্টিক হবে যে রোমান্টিকতা দেখে আমি অবাক হবো!
আমি ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে কল্পনা দেখতাম এমন একজন আমার সঙ্গী হবে যে কিনা কারনে অকারনে চেঁচামেচি করবে আমার সাথে, যতক্ষণ বাসায় থাকবে আমি ভয়ে ভয়ে পা ফেলবো আর মনে মনে চাইবো কতক্ষণে বাসা থেকে বের হবে আর আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিব! অামার বরের ব্যক্তিত্ব থাকবে বিশালাকৃতির, তার কথাই হবে শেষ কথা।
কিন্তু আমার পিতৃদেব বেছে বেছে কোথা থেকে এক ক্যাবলা কান্ত ধরে এনেছেন আমার জন্য যাকে দেখলেই মনের সব রস চুপসে যায়, আর আমি হয়ে উঠি রণচন্ডিনী। আমার রণচন্ডী রূপ দেখে সে ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকে।
যেদিন ক্যাবলটা তার বোনজামাইদের সাথে আমাকে দেখতে এসেছিল সেদিনই আমি বাবাকে জানিয়ে দিই এমন ক্যাবলা মার্কা ছেলে আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু বাবা আমার কোন কথা শুনেননি কারণ বাবা জানতেন আমার যে অাচরণ সেখানে এমন ক্যাবলা কান্তের কাছে বিয়ে না দিলে প্রতিদিনই বাবাকে আমার শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে ঝগড়া মিটানোর জন্য।
বাবা সেদিন আমার কোন কথাই শুনেননি, মা আমার হয়ে ওকালতি করতে গেলে বাবা মাকে ধমকে বলেন যেমন উগ্র স্বভাবের মেয়ে তৈরি করেছো তার জন্য এ পাত্রই উপযুক্ত নতুবা প্রতিদিন থানায় আমাদের হাজিরা দিতে যেতে হবে, থানার ওসি প্রতিদিনই আমাদের ডেকে পাঠাবে।
অগ্যতা বিয়ে করতে হল আদিত্য ক্যাবলাকে। ক্যাবলা বলে আমি কিন্তু কোন ভুল করছি না! সত্যিই একটা ক্যাবলা, গ্রামে যাকে বলে সাত চড়েও রা কাটেনা এমন ছেলে! যদি তাকে পাঁচটা জিনিসের জন্য পাঁচবারেও আমি বাজারে পাঠাই তবুও একবার মুখ তুলে বলবেনা কেন বারবার পাঠাচ্ছি। আমি কয়েকমাসে এ ক্যাবলার প্রতি রুষ্ট হতে হতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছি।
অাদিত্যর বাবা মা নেই। দুবোন আর পিসিমা তাকে মানুষ করেছে। পিসিমাও গতবছর মারা গেছেন ফলে একদম নির্ভেজাল সংসার। এমন শূন্য সংসারে সবই আমার একা হাতে করতে হবে ভেবে কত ভয়টাই না পেয়েছিলাম বিয়ের আগেই। কারণ বাবার ঘরে কখনোই কিছু করতে হয়নি আমাকে মায়ের বদৌলতে। কিন্তু আমার ভয়ের মোহ কাটিয়ে বিয়ের পরদিন থেকেই দেখি আদিত্য আগ বাড়িয়ে বাসার টুকটাক কাজ করে দেয়। আমি প্রথম প্রথম খুশিই হতে থাকলাম কিন্তু দিন যেতে যেতে দেখছি ক্যাবলাটা ঘরকন্নার কাজে ভীষণ এক্সপার্ট! সে দেখি আমার চাহিদার বরের পুরো উল্টোদিকে বিরাজ করে! যদিও বিয়ের পূর্বেই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম কিন্তু এতটা ক্যাবলা হবে সেটা ভাবতে পারিনি আমি।
যা বলি তাতেই সম্মতি দিয়ে দেয়, কোন অনুযোগ নেই কোন অভিযোগ নেই!
সে কখনোই আমার উপর রাগে না! যেটা আমি খুব বেশি চাইতাম সেটাই আদিত্যর মধ্যে নেই। মাঝে মাঝে অকারনে আদিত্যর সাথে চেঁচামেচি করি কিন্তু সে তখন একদম চুপচাপ হয়ে বসে থাকে, নয়ত যে বিষয়টা নিয়ে চেঁচাই সেটা ঝটপট সমাধান করে দেয়, কিন্তু সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনা। উফ্ চরম বিরক্তি এ ক্যাবলাটার উপর।
রোমান্টিকতার প্রশ্নে ক্যাবলা এক্সপার্ট কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক থেকে ওকে কত মার্ক দিব আমি নিজেই বুঝতে পারিনা।
আমি কল্পনা করতাম আমার বরের একগুয়েমি আর রাগী আচরণের জন্য সবসময় চাইবো সে কখন বাসা থেকে বের হবে আর আমি স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলবো! কিন্তু আদিত্য তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, এ ক্যাবলা বাসা থেকে বের হলে আমি স্বস্তি পাই, ওর নিস্তব্ধতা অার নির্লিপ্ততা আমার বড্ড বিরক্তি লাগে। কিন্তু এ বিরক্তিতে তার মনে হয় কিছু যায় আসেনা!
বিয়ের জন্য স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম ৭ দিনের। পরদিন থেকেই স্কুলে যেতে হবে,সকালে একা হাতে সব কাজ শেষ করে দুজনে বের হবো এটা ভেবে রাতে একটা কষ্ট অনুভব হচ্ছিল। সকাল সাতটায় ফোনের এলার্মে সজাগ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি ক্যাবলাকান্ত রান্না শেষ করে দুইটা টিফিন বক্স রেডি করছে! আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! ভিতরে ভীষণ বিরক্ত লাগছে কেন সে এসব কাজ করবে! এগুলো পুরুষ ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না ওটা সে কেন বুঝেনা?
আমি তখন থেকেই তাকে আমার স্বপ্নের সেই বরের মত করে গড়ে নিবো বলে মনস্থির করলাম। তাকে নানানভাবে আমি আমার মনের মত করতে চেষ্টা করতে থাকলাম কিন্তু সে তার মেরুতেই বিরাজ করে সদাসর্বদা।
পাশের ফ্ল্যাটের এক আন্টি নতুন বউ দেখতে এসেছে, সারা সপ্তাহ আমরা দুজনেই ব্যস্ত তাই আমাদের দেখা পাওয়া দায়। শুক্রবার, আমি রান্না সেরে বিছানায় একটু শুইলাম, খুবই ক্লান্তি লাগছিল তাই রান্নাঘরটা আর গুছাইনি। এরই মধ্যে আদিত্য কোন ফাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে যে রান্নাঘর পরিষ্কারে লেগেছে আমি খেয়ালই করিনি। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করেই আন্টিটার কিচেনের দিকে চোখ গেল, দেখে আদিত্য কিচেনের ফ্লোর মুছতেছে। আন্টিটা এক গাল হেসে বললো,”অাদি কি আজও ঘরকন্নার কাজ করে? ”
আমার তখন রাগে শরীরে অাগুন ধরে যাচ্ছিল, আর আদিত্য তখন খিলখিলিয়ে হেসে বলে, “আন্টি অরু তো সবসময়ই করে , তাকে একটু হেল্প করে দিচ্ছি। সারা সপ্তাহ তো দুজনেই বাহিরে ছুটতে থাকি। ছুটির দিনে সে একা কেন পরিশ্রম করবে বলেন! ”
এইতো সেদিন আমি স্নান করে কাপড়গুলো বালতিতে রেখে সিঁদুর পড়তে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি, তখনই আদিত্য আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে রুমে ফিরে মুচকি হেসে বলতেছে, “জানো অরু! ছাদে তোমার কাপড়গুলো মেলতে গেলাম নিচতলার আন্টিটা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে দুতলার তনিমার সাথে! আমি নাকি বউয়ের কাপড় ধুইয়ে দিই । আচ্ছা এটা কি অপরাধ বল তো!” ক্যাবলার কথা শুনে কার উপর রাগ দেখাবো ভেবে পাচ্ছি না! ওই আন্টিটার উপর নাকি এ ক্যাবলাটার উপর! তাকে কে বলেছিল আমার কাপড় রোদে দিতে যেতে? আর ওই আন্টিটারই কি কোন খেয়েদেয়ে কাজ নেই? বউয়ের কাপড় ধুলে কি মহাভারত অশুচি হয়ে যাবে?
আবার ভাবলাম আন্টিটার এমন কথাতেও যদি ক্যাবলার একটু চেইঞ্জ হয়! কিন্তু নাহ্ সে গুড়ে বালি!
আমার কল্পনা ছিল আমার বর রাত করে বাসায় ফিরবে আর সেজন্য বাসায় ফিরতেই আমি তুলকালাম কান্ড বাঁধাবো , রাগ করে না খেয়ে ঘুমাতে যাবো তখন তার ধমকে উঠে খেতে বসবো। কিন্তু বিধি বাম! ক্যাবলা তো অফিস শেষে বাসায় ফিরে আর কোথাও বের হয়না, ঘরে বসে টিভি দেখে, পেপার পড়ে, ফেইসবুক চালায়। তো সেদিন তার এক কলেজ জীবনের বন্ধু ফোন করে ডাকলো, আমি ভাবলাম এই যে সুযোগ আদিত্য দেরি করে ফিরবে আর আমি রাগ দেখাবো, কিন্তু হায়! আমি দরজা লাগিয়ে সোফায় বসে রিমোট টা হাতে নিতেই কলিংবেল বেজে উঠলো, দরজা খুলে দেখি ক্যাবলাটা মুখে হাসিরেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো রাগে গজগজ করে জিজ্ঞেস করলাম, “বন্ধুর সাথে গল্প শেষ? ”
সে উত্তর দিল, “অরু বন্ধুকে টয়লেট ধরেছে বলে বিদায় করে দিয়েছি , পরে ফোনে কথা বলে নিব।” মেজাজটা দেখি আমার পুরাই নষ্ট হয়ে গেছে তখন।
রমজানের ছুটি তাই স্কুল বন্ধ, বাসায় শুয়ে টিভি দেখা আমার কাজ এখন। আচমকা এক দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল, যেই ভাবা সেই কাজ। রাতে আদিত্য বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তার ফোনটা হাতে নিয়ে রিংটোন চেঞ্জ করে রেখে দিলাম । আদিত্যর ফোনে খুব একটা কল আসেনা বললেই চলে আমি আর অফিসের কল মাঝেমধ্যে। আদিত্য আজ সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে মিটিং আছে তার বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে ১০-১২টা পর্যন্ত। অফিসে মিটিংয়ের মধ্যেই আমি তাকে কল দিলাম আর তার ফোনে বেজে উঠলো সানি লিয়নের গান, “মে সুপার গার্ল ফ্রম চায়না। ” তার এ গানের রিংটোন শুনে সব ক্লায়েন্টরা নাকি হেসে উঠেছিল। আদিত্য তাতে লজ্জা পেয়েছিল অনেক। কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়েই অাদি আমাকে ফোন করে, সে নিশ্চিত ছিল কাজটা আমি ছাড়া কেউ করেনি। ফোন করে রাগে গজগজ করে আমাকে দুচারটা ধমকও দিয়ে দেয় ক্যাবলাটা! আমি তো অবাক বনে যাচ্ছি আর আনন্দে লাফাচ্ছি যাক অবশেষে আমি পারলাম তবে। বিকালে অফিস থেকে ফিরে সে আমার উপর রেগে থাকবে, কথা বলবে না, আমি ভয়ে ভয়ে তার কাছে যাবো কিন্তু সে আমার কোন হেল্প নিবেনা। রাতে অালাদা রুমে ঘুমাতে যাবে।
এসব বসে বসে আইডিয়ালাইজড করছিলাম। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল,ক্যাবলাটার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবছি হয়ত রাগটা আজ জোরালো হয়েছে! আদিত্য বাসায় ফিরেছে কিন্তু পোড়াকপাল আমার! মুখে সেই একগাল হাসি নিয়ে তার অনুপ্রবেশ,আর বলে রিংটোনের গানটা কিন্তু বেশ জোশ ছিল।

আমি তো বেহুঁশ!

 -অরুন্ধতী অরু 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *