গন্তব্য (২য় পর্ব)

রেললাইন থেকে বেশ খানিকটা দূর দিয়ে সেই মেঠোপথটা গ্রামের বুক দিয়ে বয়ে গেছে, দিশার ধারণা রাস্তাটার শেষপ্রান্তে কোন একটা আমবাগান থাকবে,তারপাশে কোন পুরাতন ভাঙা জমিদার বাড়ি! আর সে বাড়িটার সামনে এক বিশাল শান বাঁধানো ঘাটওয়ালা পুকুর।
দিশা জানে তার কল্পনার চিত্র বাস্তবে সফল হওয়ার নয়। বাস্তব যেমন কল্পনায় মিলে না ঠিক তেমন
— চলো যাওয়া যাক,
অরণ্যের প্রস্তাবে দিশা তার ভাবনা থেকে নেমে আসে
—“হুঁ, কোথায় যাবে?

ঐ স্বপ্নকে ছুঁতে, ——তোমার ইচ্ছেকে পূরণ করতে! ”

— অরণ্য,ঘড়ির দিকে তাকিয়েছো? কিংবা ঐ দূরের পথটার দিকে?
— হ্যাঁ, তাকিয়েছি তো!
— এখন ভরদুপুর! দেখ বৃষ্টি শেষে কেমন ঝিলিক দিয়ে রোদ উঠেছে, গা পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। আমি তো কখনো এমন আগুনঝরা কাঠ ফাঁটা রোদে কোন সবুজ শ্যামলিমা ছড়ানো গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতে চাইনি! আমি বরাবরই চাইতাম কোন শরতের পড়ন্ত বিকেলে যখন সাদা মেঘ তার ভেলা ভাসিয়ে উড়ে যাবে নীল দিগন্তে, উড়তে উড়তে এসে কাশফুলের আড়ালে লুকাবে আর আমি সে সৌন্দর্যে বিভোর হবো।
— দিশু, তুমি ঠিক সেই আগের মতই সৌন্দর্যপিপাসুই রয়ে গেলে।
— অরণ্য, তুমি ও কম কিসে?
—- ছাড়ো ওসব, ওঠো
— কোথায় যাব?
— ভয় নেই, আজ তুমি আমার রেসপনসিবিলিটি।
অরণ্য রিক্সা ডাকে। রিক্সাওয়ালাকে সামনের লেইকের পাশে যেতে বলে।
অটোরিক্সায় এখন পর্যাপ্ত জায়গা,সিটটা অনেক বড় তাই দুজনের শরীর দুজন থেকে কিছুটা অালাদা, অাগের রিক্সার সিটগুলো ছিল ছোট, দুজন ঠাসাঠাসি করে বসতো তারা। দিশা রিক্সার হুড তোলার জন্য ঝগড়া করতো অরণ্য সেটা কখনোই এলাও করেনি,তার মতে রিক্সার হুড তুলে দুজন ছেলেমেয়ে রাস্তায় চলাচল করলে লোকে খারাপ ভাববে।
রিক্সায় চড়ে তারা একে অন্যের হাত ধরে বসে থাকতো।
দিশার পাশে বসে অরণ্য নিজেকে হারিয়ে ফেলে দিশার কন্ডিশনিং করা সুবাসিত কেশে।প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয় তার, দিশা মাইন্ড করতে পারে ভেবে নিজেকে সংযত করে নেয় অরণ্য। আজকের দিশা আর সাত বছর আগের দিশা একই রকম থাকলেও পাল্টেছে তার আচরণ, চিন্তা ভাবনায় আগের চেয়ে অনেক মেচুউরিটি আছে।
ঈদের পরে লেকটার ধারে মানুষের অানাগোনাটা বেশ বেড়েছে। অরণ্য একটা নির্জন জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়লো দুজনে।
ছায়াঘেরা লেকের পাড়ে অরণ্য আর দিশা বসে,দুজনেরই খুব পছন্দের জায়গা এটা।
লেকে অগণিত লাল শাপলা ফুুঁটে আছে। শাপলার এক মোহিত সুঘ্রাণ লেকপাড়ে বিরাজমান।
অগণিত প্রেমিক প্রেমিকারা এসেছে একটু সময় কাটাতে। দিশা মাঝে মাঝে তাদের কে দেখছে আর ভাবছে এ লেকের ধারে অরণ্য আর সে কত সময় কাটিয়েছে! তাদের কাছে কত খুঁনসুঁটি, ঝগড়া মারামারির স্থান ছিল এটা।
দিশা লেকের অনেকগুলো ছবি তোলে,অরণ্যও বাদ যায়নি।
গোলাপগুচ্ছটা এখনো দিশার হাতেই রয়ে গেছে।
দিশার আচমকা মনে হল,ফুলের তোড়াটা তো এখনও দেয়া হয়নি!
নিজেকে ভুলভাল লাগছে একদম।
—অরণ্য
— হ্যাঁ বলো
— এটা তোমার জন্য এনেছিলাম,দিতেই ভুলে গেছি।
— এতদিনের ব্যবধানে মনে আর থাকবেই বা কি করে!
গোলাপগুচ্ছটা হাতে নিয়ে অরণ্য সেই পুরনো অভ্যাসে নাকে গন্ধ নেয়। দিশা অভিভূত হয়।
এরই মাঝে অরণ্যের কল আসে,কলটা আসার পরেই অরণ্য একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে,কিছু সময় কথা বলে ফোনটা পকেটে রেখে একটু রিলাক্সের মুড নিয়ে দিশার কাছে আসে।
— চটপটি খাবে?
দিশার পছন্দের খাবার চটপটি আর ফুচকা সেটা অরণ্যের অজানা নয়। দিশার উত্তরের আগেই অরণ্য চটপটিওয়ালাকে ফুচকা আর চটপটির অর্ডার দেয়।
দিশা অবাক হয় অরণ্যের এমন বিহেভে! দিশার কাছে মনে হচ্ছে মাঝের সাতটি বছর যেন একটা দুঃস্বপ্ন ছিল যে স্বপ্নটা সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছিল। ঘুম ভাঙার পর সে স্বপ্নের দৃশ্যগুলো যেন মলিন হয়ে যেতে লেগেছে। দিশার মনে হচ্ছে অরণ্য সেই অাগের অরণ্যই রয়ে গেছে, শুধু শুধু মাঝের দিনগুলোতে তারা দূরে সরে ছিল!
— ধরো,
চটপটির বাটিটা দিশার দিকে বাড়িয়ে ধরে অরণ্য।
দিশার হাতে ময়ূরকন্ঠী আর হলুদের মিশ্রণে বাহারি চুড়িগুলো অরণ্যের উপহার ছিল। শাড়িটা গিফট করার পর দিশা হন্যে হয়ে ম্যাচিং চুড়ি খুঁজতে লাগলো, পায়নি বলে তার সেকি মন খারাপ!
তার পরের সপ্তাহেই অরণ্য অফিসের কাজে ঢাকা যায়। সেখান থেকে অনেক খুঁজে খুঁজে এ চুড়ির সেটটা তাকে উপহার দিয়েছিল! অনার্স পড়ুয়া দিশা তখন বাচ্চাদের মত আনন্দে লাফাচ্ছিল। কিন্তু ওই শাড়ি চুড়ি পড়ে দিশাকে কেমন লাগে সেটা অরণ্যের আর দেখা হয়নি।
চটপটি খেতে খেতে বারবার অরণ্য দিশাকে দেখছে। এতটুকুও বদলে যায়নি মেয়েটা। শুধু দুজন দুজনকে ছেড়ে গিয়েছিলো মাত্র।
অরণ্যের বারবার ফোন আসছে,দূরে গিয়ে কথা বলছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা গরমিল হয়েছে।
কাছে আসলে দিশা জিজ্ঞেস করে,”এনিথিং রং?? ”
— নো,ইটস কমন ফর মি।
— ওকে।
— দিশু বিকেল তো হয়ে এসেছে, চল একটু হাঁটি।
— চল
রেললাইন ধরে হাঁটছে অরণ্য আর দিশা, মাঝে মাঝে দিশা রেলের স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। পাছে পড়ে যায়,সে ভয়ে অরণ্য হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
একবার প্রায় পড়েই যাচ্ছিল দিশা,অরণ্য হাতটা ধরে তাল সামলিয়ে দেয়। দিশা অরন্যের চোখে চোখ রাখে,সেই একই রকম উৎকন্ঠা দুচোখে বয়ে চলেছে।
এ রেললাইনেই অরণ্যের সাথে দিশার প্রথম দেখা হয়েছিল। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে অরণ্য আর দিশা তখন ক্লাস টেনে। ইমমেচিউরড দিশার কিশোরীকাল তখন। বড়ভাইয়ার বন্ধু অরণ্য বাসায় আসার প্রথমদিনই তাদের চোখাচোখি। অরণ্য স্মরণ করে নেয় রেললাইনে সেদিন যে মেয়েটাকে দেখেছিলাম, এতো সেই মেয়েটা! দিশার মুচকি হাসি সাথে ভাইয়ার বন্ধুকে অাতিথেয়তার কোন কমতি রাখেনি সে।
ধীরে ধীরে পরিচয়, আলাপ,গল্প,বাসায় ছোটখাটো আড্ডা আর অবশেষে প্রেম নিবেদন । সে প্রেম গড়ায় ৫টি বছর।
অরণ্য অনার্স শেষ করে চাকরি খুঁজতে থাকে দিশা তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে।
ঠিক এ সময়টাতে এসে থেমে গেল দুজনের গতিপথ।কেটে গেল তাদের সম্পর্কের তাল। দুটি রাস্তা ভাগ হয়ে গেল,ভিন্ন হয়ে গেল তাদের জীবনের পথ চলা।
সে দুটি ভিন্ন পথের মানুষ আজ আবার মুখোমুখি, সেই পুরনো দিনের মতই তারা দিনটা অর্থাৎ আজকের সময়টা উপভোগ করছে! কে বলবে এ দুটি মানব মানবী শীতল, নীরব? কে বলবে তারা একে অন্যকে ছেড়ে গেছে দীর্ঘসময় আগেই!
এর মাঝেই মনিরা ভাবী ফোন করে দিশাকে,
— হ্যাঁ ভাবী বল,
— কোথায় আছিস, দিশা
— আছি কাছেই,কেন বল তো?
— তোর মামা শ্বশুর এসেছিলেন।
— কেন?
— তোকে দেখতে। যাক সেসব ভেবে তোর কাজ নেই। অরণ্যের সাথে একটু ভাল সময় পার কর। আমার জন্য তোর যে ক্ষতি হয়েছে তা আমিই পুষিয়ে দিব।
— ভাবী?
— রাখছি, অল দা বেস্ট
বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। সুনীল আকাশ সেজেছে তার অপরূপ সাজে,ঠিক দিশার মনের মত করে।
দিশা আর অরণ্য পাশাপাশি হাঁটছে। দিশার দীর্ঘদিনের ইচ্ছাটা আজ পূরণ হতে চলেছে।
— দিশু,
— হুম বলো
— দেখেছো, আজ আকাশটাও ঠিক তোমার মনের মত করে সেজেছে।
— শুধু আমাদের জীবনটাই আমাদের মনের মত হয়নি, তাই না অরণ্য!
— এভাবে কেন বলছো? হয়ত স্রষ্টার এটাই ইচ্ছে ছিল।
— স্রষ্টা…..
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিশা।
—-অরণ্য, কেন ভাইয়া সেদিন…?
—-থাক না দিশু, মন খারাপের গল্পগুলি নাহয় আমরা অন্যদিন বলব!
— জীবনটা কি আবার স্বাভাবিক হবে, অরণ্য?
— চাইলেই স্বাভাবিক হবে!
অবাক হয় দিশা! কিভাবে সম্ভব? অরণ্য যতটা স্বাভাবিকভাবে বলছে ততটা স্বাভাবিকভাবে তারা কি ফিরে পাবে তাদের হারানো সম্পর্কটাকে?
মনিরা ভাবী বাসায় সব কাজ একা হাতে সামলেও বারবার দিশাকে নিয়ে ভেবে মনের মধ্যে এক আনন্দের ঝড় তুলছেন। তাঁর বিশ্বাস আজকের পর অরণ্য আর দিশা নতুন জীবন সাজানোর কল্পনায় ব্যস্ত হবে।
ঈদের পর বাড়িতে অনেক মেহমানের অানাগোনা। যারা আসছেন সবাই দিশার খোঁজ করছেন, সাত বছর পর দিশা এখানে ঈদ করছে কিনা! তাকে একনজর দেখার জন্যও অনেক প্রতিবেশিরা ঢুঁ মারছে। গত সাতবছরে একটিবারও দিশা কেন এ বাসায় আসেনি সে গল্প আবার প্রতিবেশি মহলে অনেকেরই অজানা নয়। তারা মনিরাকে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেসও করে নিচ্ছে, “ননদিনী আজ কোথায় গেল সেজেগুজে? ”
স্কুল লাইফের বান্ধবীরা মিলে ঘুরতে গেছে বলে মনিরা ভাবী পাশ কাটিয়ে নিয়েছেন প্রশ্নটা।
সবকিছু শেষে উনার মনের স্বস্তি এটা ভেবেই যে দিশা এখন তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কাছে আছে।
কি দুর্বিষহ জীবনটাই না কাটিয়েছে মেয়েটা! যদি একটু সুখের দেখা পায়!
দিশা প্রতিদিন অরণ্যের জন্য একটা গোলাপ নিয়ে যেত আর অরণ্য দিশার জন্য নিয়ে আসতো চকলেট। কিটক্যাট, পিনাট কিংবা ক্যাডভেরি না আনতে পারলেও একটা কফি ক্যান্ডি হলেও অরণ্য পকেটে করে নিয়ে আসতো। প্রতিবার ফুলটা অরণ্যের হাতে দেয়ার পর দিশা চকলেটের জন্য অপেক্ষায় থাকতো।
দিশা ভাবছে অরণ্য হয়ত তাকে চকলেট গিফটের অভ্যেসটা ভুলে গেছে।
অরণ্যের ফোন আসে,ফোনটা নিয়ে একটু এগিয়ে যায় সে। দিশা ভাবে কে এতবার ফোন করছে ওকে? তার বউ?

চলবে……

-অরুন্ধতী অরু

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *