গহীনের শব্দ(১ম পর্ব)

হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিলির । গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে । প্রথমে ভেবেছিল সে স্বপ্ন দেখছে বুঝি ! কিন্তু একটু পর তার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে আবারও সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে । মনে হচ্ছে বাড়ির আশেপাশের কোথাও থেকে শব্দটা ভেসে আসছে । মিলি চট করে বিছানায় উঠে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কান্নার শব্দটা কিছুক্ষণ শুনল । যতই সে ঐ শব্দটা শুনতে পেল ততই কি এক অজানা কারণে ভীষণ অস্থিরতা বোধ করতে লাগলো । কিছুতেই সে আর স্বাভাবিক হতে পারছে না । অবশেষে সে আর থাকতে না পেরে পাশে ঘুমিয়ে থাকা শাহেদকে ডাকতে লাগলো ।

গভীর রাতে মিলির ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠে শাহেদ একটা হাই তুলে জড়ানো গলায় বলে উঠল , ‘ এত রাতে আবার কি হলো তোমার মনি ? ডাকছো কেন ? কি হয়েছে ? শরীর খারাপ লাগছে ? ‘

‘ নাহ্ ! আমার কিছু হয়নি ! ‘ তাড়াতাড়ি উত্তর দিল মিলি ।

মিলির কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত মাখা গলায় শাহেদ বলে উঠল , ‘ তাহলে মিছেমিছি ঘুম থেকে ডাকছো কেন ? ‘

‘ তুমি কি কোন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ ? ‘

শাহেদ আবারও বিরক্ত হয়ে বলল , ‘ কিসের শব্দ ? কই আমিতো কোন কিছুরই শব্দ শুনতে পাচ্ছি না ! মনেহয় তুমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছো ! ঘুমাও মনা , এখন অনেক রাত । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে । ‘ কথাগুলো বলেই শাহেদ আবারও পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।

সারারাত মিলির আর ঘুমই হলোনা । কি এক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সে বাকি রাতটুকু পার করলো ।

সকালবেলা শাহেদ ও দুই বাচ্চাকে রেডি করিয়ে নাস্তা খেতে দিল মিলি । প্রতিদিনের মতো শাহেদের সাথে মিলি আজকেও অভি ও মুমুকে সাথে করে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল । বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে এসে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে মিলি খুব ভাল করে বাড়ির চারপাশে চোখ বুলালো । নাহ্ সেইরকম কোনকিছুই তার চোখে পড়ল না।

দুপুরে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করে মিলি বাথরুমে ঢুকলো গোসলের জন্য । শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে একমনে পানিতে ভিজতে লাগলো সে । হঠাৎ পানির শব্দ ছাপিয়ে শাওয়ারের ভিতর থেকে আবারও শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে সে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল ।

জ্ঞান ফিরে পেতেই নিজেকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো মিলি । বাড়ির সবাইকে ভীষণ উদ্বিগ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল । মাথার কাছে বসে কাজের বুয়া আসমা একমনে মিলির মাথায় তেল দিয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ।

শাহেদ খুব নরম স্বরে মিলিকে প্রশ্ন করলো ,
‘এখন কেমন বোধ করছ ? ‘

‘ ভাল ‘ বলেই মিলি চারপাশে কি যেন খুঁজতে লাগলো ।

‘ কি খুঁজছ মা ? ‘ বড় মেয়ে জিজ্ঞেস করলো ।

‘ আমি এখানে কেমন করে এলাম ? আর সে কোথায় ? ‘ বলে উঠল মিলি ।

শাহেদ এগিয়ে এসে মিলির একটা হাত ধরে মৃদু চাপ দিয়ে বলল , ‘ কি হলো তোমার ? কি খুঁজছ ওমন করে ? কার কথা বলছো ? ‘

‘ ঐ সেই বাচ্চার কান্না আবারও শুনতে পেয়েছিলাম । তুমিতো কাল রাতে আমার কথা বিশ্বাসই করলে না । আমি গোসল করতে গিয়ে আজও শুনেছি । ‘ ঐ বাচ্চাটা আশেপাশেই কোথাও আছে ! ‘

‘ তুমি গোসল করতে গিয়ে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলে । অনেকক্ষণ ধরে বাথরুম থেকে বের হচ্ছো না দেখে বুয়া অনেক ডাকাডাকি করে । পরে সে আমাকে ফোনে জানায় । আমি জলদি করে অফিস থেকে এসে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় বের করে নিয়ে আসি।
তুমি এসব কি বলছো ? ডাক্তার এসে তোমাকে দেখে গেছে । কোন চিন্তা করতে তিনি নিষেধ করেছেন । রাতে মনেহয় ঠিকমত ঘুম হয়না তোমার । ‘

‘ বুয়া , আজকে তুমি কোন শিশুর কান্না শুনতে পেয়েছিলে ? ‘ জিজ্ঞেস করলো শাহেদ

‘ বাচ্চা আইবো কইথন ? আমি কুনু বাচ্চারের ডাক হুনি নাই ! আপনে এইগুলান কি কন আফা ? ‘ বুয়া বলে উঠল ।

‘ থাক ! তোমাকে এই নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না । তুমি বরং খেয়েদেয়ে অভি আর মুমুকে সাথে করে শুয়ে পড় । আজ রাতেও ওদের সাথে ঘুমাও । আমি বরং বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি । ‘ বলেই শাহেদ বেরিয়ে গেল ।

গভীর রাত । অভি ও মুমুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে মিলি । ডাক্তারের দেয়া ঘুমের ঔষধ খেয়ে গভীর ঘুমে অচেতন সে । ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতেই তীক্ষ্ণ স্বরে শিশুর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার । আবারও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই কানে বালিশ চাপা দিল মিলি । নাহ্ কিছুতেই কিছু হলো না । এদিকে ঘুমের ঔষধের কারণে ঠিকমতো চোখও মেলতে পারছে না সে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কান্নার উৎস লক্ষ্য করে কি এক অমোঘ আকর্ষণে বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরের দরজা খুলে আধ ঘুম আধ জাগরণে সে টলতে টলতে এক এক করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে লাগলো । যতই সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো ততই কান্নার তীব্রতা বাড়তে লাগলো । এক সময় সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তেই জ্ঞান হারালো সে ।

শাহেদ বিকেলবেলায় মিলিকে সাথে করে বিখ্যাত মনোবিদ ডাঃ হাবিবের গুলশানের চেম্বারে এসে উপস্থিত হয় । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মিলির ডাক পড়তেই তাকে সাথে করে ডাক্তারের রুমে ঢুকলো শাহেদ ।তাদেরকে ভিতরে ঢুকতে দেখে ডাঃ হাবিব একটু হেসে বলে উঠলেন , ‘ বসুন প্লিজ । ‘

শাহেদ বৌকে সহ চেয়ারে বসলো । ডাঃ হাবিব টেবিলের উপর টেপরেকর্ডার অন করে জিজ্ঞেস করলেন , ‘ এখন বলেন আপনারা কি কারণে এসেছেন ? ‘

শাহেদ উত্তর দিল , ‘ আজ দুইদিন হলো সে মানে আমার স্ত্রী , ওর নাম মিলি , কোন এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে । রাতে ঠিকমত ঘুমোতেও পারছেনা । গতকাল দুপুরে গোসল করতে গিয়ে ঐরকম আওয়াজ শুনতে পেয়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল । গতকাল রাতেও বাচ্চার ঐ কান্নার আওয়াজ পেয়ে ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে আবারও জ্ঞান হারায় । আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে দৌঁড়ে গিয়ে সিঁড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসি । পর পর দুই রাতেই একই রকম শিশুর আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠছে । সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা হলো , এই ধরনের কান্নার শব্দ সে ছাড়া আমরা আর কেউ শুনতে পাচ্ছি না । ‘

‘ এধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেছিল ? ‘

‘ নাহ্ ! আগে কোনদিন ঘটেনি । এবারই প্রথম । ‘

‘ আপনাদের পরিবার সম্বন্ধে আমার সবকিছু জানা দরকার । যেমন ধরুন , আপনাদের দুইজনের পরিচয় কতদিন ধরে ? আপনাদের লাভ ম্যারেজ না এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ , বিবাহিত জীবন কতদিনের , বাড়িতে আর কে কে আছে সবকিছুই বিস্তারিত খুলে বলুন । খুঁটিনাটি কোনকিছুই বাদ দিবেন না । ‘

শাহেদ ধীরে ধীরে সব বলে গেল । তার বলা শেষ হতেই ডাঃ হাবিব বললেন , ‘ আপনাদের তাহলে এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ । বিয়ের বয়স পাঁচ বছর । বিয়ের আগে আপনারা কেউ কাউকেই চিনতেন না , এইতো বলছেন ! ‘

শাহেদ ছোট্ট করে উত্তর দিল , ‘ জ্বী ! ‘

টেপরেকর্ডার অফ করে ডাঃ হাবিব বললেন ,
‘ আপনি এখন প্লিজ একটু বাইরে অপেক্ষা করুন । আমি আপনার স্ত্রীর সাথে আলাদা ভাবে একটু কথা বলতে চাই ! ‘

শাহেদ ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ডাঃ হাবিব আবারও টেপরেকর্ডারের সুইচটা অন করে দিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন , ‘ আপনার বিয়ের আগে আর কাউকে আপনি ভালবাসতেন ? ‘

হঠাৎ করে ডাক্তারের এধরনের প্রশ্নে একটু নার্ভাস হয়ে জোরে শ্বাস টেনে মিলি ছোট্ট করে উত্তর দিল , ‘ নাহ্ ! ‘

মিলির অস্বস্তি ভাবটা নজর এড়ালো না ডাঃ হাবিবের । গতকাল রাতেই তো আপনি প্রথম বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পান , তাই না ! ‘

‘ জ্বী গতকালই প্রথম শুনি ! ‘

‘ এখন বলুন , ‘ কাল সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত কি কি করেছেন বা দেখেছেন সব খুলে বলেন । ‘

‘ কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে বাচ্চা ও তাদের বাবাকে রেডি করিয়ে দিয়ে রোজকার মতো স্কুলে দিয়ে এসে বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম , দুপুরের রান্না করি । তারপর আবার স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের বাড়িতে নিয়ে এসে দুপুরে খেয়ে টিভি দেখতে দেখতে একটু ঘুমাই । বিকেলে শাহেদ ফিরে আসলে সবাই মিলে সন্ধ্যাবেলা একটু চা নাস্তা খাই । এর এক ফাঁকে বাচ্চাদের পড়াশুনাও দেখি । তারপর টিভি দেখে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই । ‘

‘ কাল টিভিতে কি কি অনুষ্ঠান দেখেছিলেন ? ‘

মিলি টিভিতে দেখা সিরিয়াল গুলোর নাম বলে গেল ।

‘ রাতে কোন খবরের কাগজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন ?

‘ প্রথম আলো পত্রিকা ‘

ডাঃ হাবিব টেপরেকর্ডারটা অফ করে দিয়ে বললেন , ‘ আপনি কোন চিন্তা করবেন না । আপনার কিছুই হয়নি । আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ্য ও স্বাভাবিক আছেন । এখন আপনি বাইরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করুন আর শাহেদ সাহেবকে ভিতরে পাঠিয়ে দিন । ‘

মিলি বেরিয়ে যেতেই ডাঃ হাবিব গতকালকের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটা বের করে ভালো করে তাতে চোখ বুলালো । শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ একটা খবর দেখে ভাল করে সংবাদটা পড়ল । শাহেদ রুমে ঢুকতেই ডাঃ হাবিব বলে উঠলেন ,
‘ আমি আপনার স্ত্রীর মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছুই দেখতে পেলাম না । তবে কিছুতো একটা কারণ আছেই । জানেনতো একটা প্রবাদ বাক্য আছে , ‘ ‘ কারণ বিনা কার্য হয়না । ‘ ‘

‘ আমি একটু আপনার শ্বাশুড়ীর সাথে কথা বলতে চাই । কাল তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন । আর আপনার স্ত্রী যেন এটা জানতে না পারে । আপনি এখন আসুন । ‘

শাহেদ ডাক্তারকে একটা সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ॥

( আগামী পর্বে সমাপ্ত )

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *