ঠিক তোমার মত কেউ ( ২য় এবং শেষ পর্ব )

সেদিন মিরার শিফট একটু দেরিতে শুরু হবার কথা। এসে দেখে আজ রডরিগোর সামনে কোনো ল্যাপটপ নেই, নেই কোনো নোটবুক। অস্থির ভঙ্গিতে টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে টকটক শব্দ করছে বসে বসে। শরীরের ভাষা বলে দিচ্ছে উন্মুখ হয়ে আছে মিরার অপেক্ষায়। মিরার গল্পের পরবর্তী অংশে কী হলো, তাকে জানতেই হবে।

দু’ঘন্টা টানা কাজ করে একটু সুযোগ পেয়ে রডরিগোর সামনে বসলো মিরা। বলতে শুরু করলো, “লুকাস আমাকে কাঁদতে দেখে চিন্তিত হয়ে গেলো। বারবার জানতে চাইলো এখানে আমার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা, কেউ কিছু বলেছে কিনা। আমি ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কিছুই হয়নি, আমার হোমসিক লাগছে। এই মিউজিক ফেস্টে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছি না।

লুকাস আমার সামনে বসলো। ও সম্ভবত তাঁবুতে রাখা বিয়ারের ক্যানগুলো নিতে এসেছিলো। আমাকে এই অবস্থায় রেখে বেচারা যেতেও পারছিলো না। ও আমার সামনে রাখা স্লিপিং ব্যাগের ওপর বসে বললো, ‘তোমার কেন এত মন খারাপ আমাকে বলো’। বললাম, এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসার কথা, বাংলাদেশের কথা, আমার বাবা মায়ের কথা। একটা অচেনা ছেলের সাথে তখন কেন এত কথা বললাম, জানি না। হয়তো লুকাস খুব মনোযোগ দিয়ে আমার গল্প শুনছিলো বলে। অথবা আমার কাউকে নিজের সব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো বলে। তারপর লুকাস বললো ওর জীবনের গল্প।

“কী গল্প?” জানতে চাইলো রডরিগো।

“লুকাস নরওয়ের ছেলে। বাবাকে ও কখনো দেখেনি। মায়ের কাছে চার বছর বয়স পর্যন্ত ছিলো। মায়ের চরম অবহেলার কারণে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ফস্টার পরিবারে। এভাবে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবার বদল করে কাটিয়েছে বেশ অনেক বছর। শেষ পর্যন্ত আঠারো বছর বয়সে এক ফস্টার পরিবার থেকে স্টকহোমে একটা টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রথমে নাকি আমার মতো ওরও মনে হয়েছিলো এই ভিনদেশে থাকতে পারবে না। লুকাসের জীবন বদলে যায় এক সুইডিশ শিক্ষকের সংস্পর্শে। অতীতের সব বঞ্চনা ভুলে নিজেকে ধীরে ধীরে একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। রিকসগার্সেন স্কি রিসোর্টে একজন টেকনেশিয়ান হিসাবে যোগ দেয়। ধীরে ধীরে স্কি করার আগ্রহ জেগে ওঠে ওর মধ্যে। শুভ্র বরফের উপর তীব্র গতিতে ধেঁয়ে যাওয়ার নাকি একধরণের আলাদা নেশা আছে। দুবছরের মাথায় একজন দক্ষ স্কি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করে সেই রিজোর্টে।

নিজের জীবনের গল্প বলতে বলতে লুকাসের মুখটা কেমন মায়াময় হয়ে ওঠে। আমরা দুজনই এমনভাবে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো বহুদিন ধরে বুকের ভেতর চেপে রাখা কথাগুলো আজ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করছি। ও বলে, আমার তো বাবা মা আছেন অথচ ওর পরিবার বলে কিছু নেই। এই দেশে ওর কেউ ছিলো না, তবু ও প্রতি মুহূর্তে নিজের জন্য যুদ্ধ করে গেছে, হার মানেনি। নিজেকে ভালবেসে সব প্রতিবন্ধকতা কাটাতে শিখিয়েছিলো তার সেই শিক্ষক। এখন কিছুতেই ভয় লাগে না ওর। লুকাস বললো, ‘মিরা, হয়তো তুমি এমন কাউকে খুঁজে পাবে যে তোমাকে হার না মেনে নিতে শেখাবে।’

গল্প করতে করতে কখন যে গভীর রাত হয়ে গেছে বুঝিনি। আমার ঘুম পাচ্ছিলো, কিন্তু ঘুমাতে পারছিলাম না কারণ আমার স্লিপিং ব্যাগটা খুব ভালো মানের ছিলো না, ওটাতে তীব্র শীত থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। কম দামে কিনেছিলাম -সস্তার তিন অবস্থা আরকি! লুকাস বুঝে ফেললো, ওর ভারী ব্ল্যাঙ্কেট আমার দিকে এগিয়ে দিলো। অন্য মানুষের ব্যবহার করা কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানোর মানুষ আমি নই। অথচ সেদিন এতই ঠান্ডা ছিলো যে আমি কোন কথা না বলে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? লুকাসের কম্বলে খুব চেনা একটা গন্ধ ছিলো, লেবু পাতার মতো। আমি এক মুহূর্তে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন সকালে উঠে দেখি আনিতা, লুকাস আর ওর গার্ল-ফ্রেন্ড বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওরা কখন ফিরেছে, কখন ঘুমিয়েছে – কে জানে। আমার খুব লজ্জা লাগছিলো ভেবে যে একটা অচেনা ভিনদেশি ছেলেকে কী সব ছেলেমানুষি কথা বলেছি! ছেলেটা আমাকে কত দুর্বল ভেবেছে!

সেদিন দুপুরেই আমাদের ফেরার কথা কিন্তু আনিতা যেভাবে ঘুমাচ্ছিলো তাতে তো মনে হচ্ছিলো না ও তাড়াতাড়ি উঠবে। আমি ওঠে তৈরী হয়ে নিজেদের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। তাঁবুর বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম সময় কাটানোর জন্য। কেউ ধারনা করতে পারবে না গতকাল রাতে এখানে কতটা উন্মাদনা ছিলো, সকালে সবকিছু শান্ত। সবাই যার যার তাঁবুতে ঘুমাচ্ছে।

ক্যাম্পিং-এর জায়গাটার এক পাশে লেক। এত সুন্দর টলমলে স্বচ্ছ পানি কখনও দেখিনি। লেকের উল্টো দিকে বেশ উঁচু পাহাড়, চূড়ায় সাদা বরফ। কী যে অপার্থিব সুন্দর! এত সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি। আমি হা করে দেখছিলাম। সে নির্বাক মুহূর্তে নির্মল প্রকৃতি তার সব সৌন্দর্য মেলে ধরেছিলো আমার সামনে। বুকের ভেতর কি একটা শক্তি জন্ম নিলো, লুকাসের কঠিন জীবনের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করে ভাবছিলাম, আমিও এখানে সফল হতে পারবো।

ফেরার সময় হয়ে গেলো। লুকাসের সাথে কুশল বিনিময় ছাড়া আর কোন কথা হলো না, আসলে আমি ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। বসে ওঠার আগে আমাদের তাঁবুর চার বাসিন্দা ছবি তুললাম। তারপর ফিরে এলাম ডর্মে।

তারপর প্রায় চার মাস পার হয়ে গেলো। লুকাসের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হটাৎ একদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের অফিসে আমার নামে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা পাঠিয়েছে লুকাস! এই ডিজিটাল যুগে কেউ এভাবে চিঠি পাঠাতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। “

“কী লেখা ছিলো সে চিঠিতে?” ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় রডরিগো।

মিরার মুখে দুষ্টু হাসি। বললো, “বাকিটা আবার কাল বলবো। “

“এটা কিন্তু ঠিক না , এমন জায়গায় ঝুলিয়ে রাখো তুমি।” রডরিগো বিরক্তি লুকাতে পারে না।

মিরা হাসতে হাসতে উঠে যায়। কাজ শেষে ছুটতে হবে গেরস্থালি সদাইপাতি কিনতে।

রডরিগো অস্থিরতায় ঘুমাতে পারে না। মিরার গল্প শুনতে শুনতে ওর মনে হতে থাকে এই ভালোবাসার গল্পটা আসলে ওর। মিরা লুকাসকে নয়, ওকে ভালোবাসে। লুকাসের হাত ধরে হাঁটে না, ওর হাত ধরে হাঁটে। সে রাতে তাঁবুতে মিরার সাথে ও ছিলো। মিরার মুগ্ধতা শুধু ওর জন্য। পৃথিবীতে লুকাস বলে কেউ নেই।

পরদিন একই আকুলতা নিয়ে আবার মিরার অপেক্ষা। মিরা সেদিন আর কাজের ফাঁকে গল্প করার সুযোগ পেলো না। শনিবার , ক্যাফেতে কাজ বেশী। রডরিগোর অপেক্ষা শেষ হতে চায় না।

কাজ শেষে রডরিগোকে আবার বলতে শুরু করে মিরা ,” খামের উপর তারিখ দেখে বুঝলাম তিন মাস আগে এসেছে চিঠিটা, মিরা নামে পাঠানো বলে হয়তো ডিপার্টমেন্টে কেউ বুঝতে পারেনি চিঠিটা আমার, মিরা আমার ডাক নাম। খাম খুলে দেখি লুকাস সেদিন তোলা আমাদের একটা ছবি প্রিন্ট করে দিয়েছে। ছবির পেছনে লেখা, ‘আমার কম্বল কি ফেরত পেতে পারি?’ নিচে একটা ফোন নাম্বার দেয়া।”

ভীষণ লজ্জায় পড়লাম। সেদিন নিজেদের সব জিনিসপত্রের সাথে কম্বলটাও নিয়ে এসেছি। ফেরার পর সবকিছু স্টোরেজে ফেলে রেখেছি, জানিই না যে জিনিসটা আসলে আমার কাছে।

সেদিন ডর্মে ফিরে প্রথমে স্টোরেজ থেকে কম্বলটা খুঁজে বের করলাম। তারপর ফোন নাম্বারে ফোন করে লুকাসের সাথে কথা বললাম। লুকাস খুব মজা পেলো আমাকে বারবার সরি বলতে দেখে। ওর ঠিকানা দিয়ে বললো যেকোনো কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

অমন ভারী একটা কম্বল কুরিয়ারে পাঠানোর মতো বড়লোক আমি না, বুঝতেই পারছো। ম্যাপ থেকে ঠিকানা বের করে বাসে যাওয়া বরং সস্তা হয়। তাই এক ছুটির দিন বিকেলে লুকাসের ঠিকানায় উপস্থিত হলাম। লুকাসের ঠিকানা আমার ডর্ম থেকে বাসে আধ ঘন্টার পথ। বেশ পুরোনো ধরণের দোতালা বাড়ির নিচ তলার ফ্ল্যাটে লুকাসের বসবাস। বেল চেপে বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম,কেউ দরজা খুলছে না। প্রায় দশ মিনিট পর লুকাস দরজা খুললো। কিন্তু ওকে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।”

মীরার মুখটা বিষন্ন দেখায়। চোখ নামিয়ে কী যেন ভাবে কিছুক্ষন। রডরিগো একটু অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন? কী হয়েছিল?”

“ও ক্রাচে ভর করে হেঁটে এসেছিলো। বা পায়ের হাঁটু থেকে কাটা ছিলো। দেখে এতটাই মন খারাপ হলো আমার যে কিছুক্ষন কথাই বলতে পারলাম না। কয়েক মাস আগেই যে ছেলেটা সুস্থ ছিলো, আজ সে পঙ্গু।”

আমাকে এমন হতবুদ্ধি অবস্থায় দেখে লুকাস হাসতে হাসতে বললো, “তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার না, তোমার পা কাটা গেছে। প্লিজ ভেতরে এসো। সরি, তোমাকে আসতে হলো, আসলে আমার এই অবস্থায় তোমারে ওখানে যাওয়া সম্ভব না বলে পাঠিয়ে দিতে বলেছি। এই কম্বলটা আমার শেষ ফস্টার মায়ের দেয়া, তাই হারাতে চাইনি।”

আমি জানতে চাইলাম কী হয়েছে ওর। বললো, মিউজিক ফেস্ট থেকে ফেরার একমাস পর ভয়ংকর কার একসিডেন্ট হয় ওর। বা পায়ের হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি। পরবর্তীতে প্রসথেটিক পা সংযোগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করবে। রডরিগো জানো, আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো। একটা দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাসী ছেলে এমন অচল হয়ে ঘরে পড়ে আছে, মানতেই পারছিলাম না। আমার দুঃখী দুঃখী চেহারা দেখে লুকাস হেসে ফেললো। বললো, তুমি কী ভেবেছো আমি অসহায় হয়ে গেছি? একদমই না। আমাদের প্রত্যেকের জীবন আসলে আলাদা আলাদা ছকে করা একেকটা পরীক্ষা। কারো পরীক্ষা একটু বেশি কঠিন, যেমন আমার। আবার কঠিন পরীক্ষার পুরস্কারও অনেক বড়। আমি আবার স্কিইং করবো, বরফে না গেলে আমার চলবেই না, দেখো।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। ছেলেটার মনোবল দেখে সত্যি অবাক হতে হয়। ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না এত বড় একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। যেন তেমন কিছুই হয়নি। ওর পরিস্থিতিতে আমি থাকলে ভাবতাম জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। সেদিন তেমন কোনো কথা হলো না। আমি ফিরে এলাম কিন্তু লুকাসকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। পরের ছুটির দিন আবার হাজির হলাম লুকাসের বাসায়।

ও জানালো এক্সিডেন্টের পর ওর গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে। লুকাসের চিকিৎসার সময়টায় এত মানসিক চাপ নাকি তার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। লুকাস ওকে আটকায়নি। ধীরে ধীরে ও সেরে উঠছিলো, আমিও ওর বাসার নিয়মিত আগন্তুক হয়ে উঠলাম। ওর কাজে টুকটাক সাহায্য করতাম, ওর প্রাণবন্ত কথা শুনতাম। লুকাস কখনও জিজ্ঞেস করতো না কেন আমি ওর কাছে যাই, ফোন করে ওর খোঁজ নেই। কেমন করে যেন আমরা খুব আপন হয়ে গেলাম। লুকাসের ফিজিও থেরাপি চলছিল, ওর থেরাপি সেশনগুলোতে আমি থাকার চেষ্টা করতাম, মাঝে মাঝে ওর সাথে হাসপাতালে যেতাম। একবারও হতাশা দেখতাম না ওর মধ্যে। ওর মনের জোর কেমন করে যেন আমার মাঝেও বিস্তারিত হয়ে গেলো। ওর সাথে সাথে আমিও যেনো একজন দৃঢ়চেতা মানুষ হয়ে গেলাম।

ডাক্তার যেদিন বললো এবার ওর হাঁটুর সাথে নকল পা জুড়ে দেয়ার সময় এসেছে, লুকাস আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘জানো তুমি ছিলে বলে আমি এত জোর পেয়েছি। তুমি আমার পাওয়ার হাউজ।’

তখনই ঠিক করে ফেললাম এই ছেলেটার সাথে আমি সব সময় থাকবো।

রডরিগো জানো, গত এক বছর প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করেছে লুকাস, আবার স্কিইং করার জন্য। একটু একটু করে তৈরী হয়েছে আবার স্কি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিজেকে প্রমান করার জন্য। ওর এই যুদ্ধে আমি ছিলাম সাথে। আমি জানি, ও পারবে। কিন্তু প্রস্থেটিক পা নিয়ে স্কি করার অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। একবার যদি কেউ পরীক্ষামূলক ভাবে কেউ ওর সাথে স্কি করতো, তাহলেই ও প্রমান করতে পারতো স্কি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে ও পুরোপুরি উপযুক্ত। আমার বাবা মা মোটেই খুশি হবে না লুকাসের সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানলে, তার উপর ওর পায়ের এই অবস্থা, বেকার ………..”

মিরা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তা ওর মুখে স্পষ্ট। রডরিগো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিরাকে দেখে। ও নিশ্চিত, মীরার ভালোবাসার গল্পটা ওর নিজের, একান্তই ওর। লুকাস নামে কেউ ছিল না, মীরার বিশুদ্ধ প্রেম শুধু ওর জন্য। ও যে ব্যক্তিকে এতো ভালোবাসে , শ্রদ্ধা করে, সে ব্যক্তি রডরিগো নিজেই।

রডরিগোর নীরবতা ভেঙে মিরা ম্লান হেসে বলে, “শুনলে তো আমার গল্প, এবার বলো, এই গল্পটা লিখবে তুমি? মানুষ পছন্দ করবে?”

ধূর্ত ভঙ্গিতে হাসে রডরিগো। অদ্ভুত ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে, “আমি যদি লুকাসের সাথে স্কি করতে যাই, তাহলে কি প্রমান করতে পারবে যে ও স্কি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে এখনও উপযুক্ত?”

মিরা প্রায় লাফিয়ে বলে, “সত্যি তুমি করবে? আগে করেছো স্কিইং?”
“ওমা! স্কিইং না করলে এই স্কি রিজোর্টে এসেছি কেনো?”

উত্তেজিত মিরা লুকাসকে ফোন করে পরের শনিবার সকালে টেস্ট সেশনের সময় ঠিক করে নেয়।

রডরিগোর মাথার ভেতর নানান সম্ভাবনা জট পাকায়। পৃথিবীতে তার মতো একা আর শক্ত মানুষ আর কে হতে পারে? জীবনে কতরকম যন্ত্রনাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। লেখক হিসেবে কত গঞ্জনা, ব্যর্থতা আর দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে, তবেই না আজকের এই অবস্থান। মিরার সব শক্তির উৎস লুকাস কেনো হবে? রডরিগো হবে ওর একমাত্র অবলম্বন, একমাত্র ভালোবাসার মানুষ। মিরার ভালোবাসার গল্প হবে শুধুমাত্র রডরিগোকে ঘিরে। এই ভালোবাসা শুধু ওর প্রাপ্য।

শনিবার সকালে লাপ্পিস ক্যাফেতে একটু আগেভাগে আসে মিরা। ক্যাফেতেই রডরিগোর সাথে লুকাসের পরিচয় করিয়ে দেয়। রডরিগোকে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে ওরা দুজন বেরিয়ে যায় রিকসগার্সেন স্কি সেন্টারের দিকে।

প্রতিদিনের মতো ত্রস্ত হাতে কাজ করতে থাকে মিরা। লাপ্পিসের মালিক বুড়ো লিয়াম ফিরেছে গতকাল। আজকে ক্যাফেতে এসে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে, যথারীতি স্পোর্টস নিউজ। মিরাকে দেখে হাসিমুখে দুষ্টুমি করে বললো, “কী ব্যাপার? নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছো নাকি? লোকটা কে ছিলো ?”

মিরা লিয়ামকে বাধা দিয়ে বললো, “উনি মোটেই আমার বয়ফ্রেন্ড নয় লিয়াম। ও পর্তুগিজ লেখক , রডরিগো কস্তা। এখানে এসেছে নিরিবিলিতে গল্প লেখার জন্য। আর দেখো, আমার সাথে কেমন বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। “

“কী নাম বললে? রডরিগো কস্তা? নামটা পরিচিতি লাগছে। কয়দিন আগে পত্রিকায় একটা খবর দেখেছিলাম, রডরিগো কস্তা খুন হয়েছে।”

একটু চমকে ওঠে মিরা। লিয়াম কী বলছে? হতেই পারে ভুল দেখেছে। মিরা বললো, “কী বলছো এসব? ও তো এখানে এসেছে। খুন হবে কেনো?”

পকেট থেকে ফোন বের করে রডরিগোর নাম দিয়ে একটা সার্চ দিলো। গুগলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দেখে বুক কেঁপে উঠলো মিরার। পর্তুগিজ লেখক রডরিগো কস্তা হিসেবে যার ছবি দেয়া আছে, তার সাথে এই রডরিগোর কোনো মিল নেই।

পর্তুগিজ লেখক রডরিগো কস্তার বিকৃত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে আলভরের একটা হলিডে হোম থেকে। দুমাস আগে এক বন্ধুর সাথে রিজোর্টে যান তিনি। বন্ধুটি কে, জানা যায়নি। এই বন্ধুর সাথে রডরিগোর পরিচয় খুব অল্পদিনের , তার পরিবারের লোকজনও এই বন্ধুকে চিনতো না। এত অল্পদিনের পরিচয়ে একজনকে নিয়ে কেন ছুটি কাটাতে গেলেন রডরিগো, সেটা এখনো রহস্যাবৃত।

পোস্টমর্টেমে দেখা গেছে প্রায় একমাস আগে রডরিগোকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে তার সঙ্গী তাকে হত্যা করে রডরিগোর সাথে থাকা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন রডরিগোর ফোন বন্ধ থাকলেও ইমেইলে সবার সাথে যোগাযোগ করেছেন, ফলে কেউ সন্দেহ করেনি যে তার কোনো বিপদ হয়েছে। দীর্ঘদিন হলিডে হোম থেকে বের হননি বলে শেষ পর্যন্ত এক কেয়ারটেকারের ফোন পেয়ে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে। পাশের হলিডে হোমে অবস্থান করা এক দম্পতির বর্ণনা অনুযারী পলাতক
সম্ভাব্য হত্যাকারী অজ্ঞাত বন্ধুর ফরেনসিক ছবি তৈরী করা হয়েছে।

কম্পিউটার জেনারেটেড ফরেনসিক ইমেজটার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে ওঠে মিরার। যে ব্যক্তি নিজেকে এতদিন ধরে রডরিগো বলে পরিচয় দিচ্ছিলো, তার সাথে অনেক মিল! সেই একই নীল চোখের পাশে ভাঁজ, মাথায় সোনালী ঘন চুল, দৃঢ় কাঁধ!

আর ভাবতে পারছে না মিরা। পর্তুগালে একজন লেখককে খুন করে কি মৃত লেখকেরই পরিচয় নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে লোকটা? কয়েকবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে মিরা। রডরিগো নামে তো অসংখ্য মানুষ থাকতে পারে। নামের মিল দেখে হয়তো অযথাই দুঃশ্চিন্তা করছে। কিন্তু এই ফরেনসিক ছবি? রডরিগো তার জীবনের যেসব গল্প বলেছে তার সাথে মৃত পর্তুগিজ লেখকের জীবনের গল্প পুরোপুরি মিলে যায় কেমন করে?

কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না মিরা। কাঁপতে কাঁপতে ফোন করে লুকাসকে। ওকে বলবে রডরিগোর সাথে কোনো স্কিইং করার করার কোনো দরকার নেই, এক্ষুনি যেনো ফেরত আসে।


বরফে ঢাকা পাহাড়ের উপত্যকায় স্কি করতে গিয়ে রডরিগো পিছলে পড়েছে। ওর হেলমেট ছিটকে পড়েছে, স্কি বাইন্ডিং পা থেকে খুলে এসেছে প্রায় আর স্কি পোল ছিটকে পড়েছে কোথায় যেন।

রডরিগোর চোখে মুখে লজ্জা আর হতাশা। সে বললো, “আমি খুবই দুঃখিত লুকাস, কী বিশ্রী ভাবে পড়লাম দেখো তো! তোমাকে বিপদে ফেলেছি। হয়তো তোমাকে স্কি ইন্সট্রাক্টর করতে সাহায্য করতে পারলাম না।”

লুকাস কাঁধ ঝাকিয়ে বললো, “এত চিন্তা করো না, তুমি ঠিক আছো কিনা সেটা আগে দেখো। ব্যাথা পাওনি তো ? আর তোমার পোল কোথায় ছিটকে পড়েছে খুঁজে বের করতে হবে।”

এই জায়গাটা ভীষণ নির্জন। জুনের শেষ দিকে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে, থেকে থেকে তুষারপাত হচ্ছে। আকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। লুকাস এগিয়ে গিয়ে এদিক ওদিক রডরিগোর স্কি পোল খুঁজতে থাকে। একটু সামনেই গভীর খাদ, রডরিগো দেখে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, সময় খুব বেশি নেই, এই মোক্ষম সুযোগ মিরার ভালোবাসার গল্পটাকে একান্ত নিজের করে নেয়ার, নিজেকে মীরার ভালোবাসার মানুষ লুকাসে রূপান্তরিত করার, যেমনটা করেছিলো রডরিগো কস্তার ক্ষেত্রে। ওই লোকটা ছিলো প্রবল ভাবে সফল লেখক। দারুন করে অনুভূতিগুলোকে গল্পে ফুটিয়ে তুলতো লোকটা। অথচ কত গভীর একাকিত্ব ছিলো লোকটার! একাকী মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করা খুব সহজ। সুন্দর করে কথা বলতো রডরিগো, মুগ্ধ হয়ে শুনতে গিয়ে সারাদিন পার হয়ে যেতো। একসময় ওর মনে হলো ও নিজেই রডরিগো হতে পারে, হয়েছেও তাই।

লুকাস এগিয়ে যাচ্ছে খাদের ধারে , পেছনে বেড়ালের মতো অনুসরণ করছে রডরিগো। গাছের বেশ কিছু ডাল পড়ে আছে বরফের ওপর। বরফ ঝেড়ে ক্ষিপ্র হাতে একটা ডাল তুলে নিলো রডরিগো। ঠিক সেই মুহূর্তে লুকাসের ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখছে লুকাস, অন্যমনস্কতায় বুঝতে পারে না আততায়ী পেছনে অপেক্ষমান। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়, লুকাসের মাথার পেছনে সজোরে একটা আঘাত। কিছু বোঝার আগেই লুকাস মাথার পেছনে হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়লো খাদ বেয়ে। ওপর থেকে দেখলো রডরিগো, বরফের গায়ে ছিটকে পড়েছে লুকাসের রক্ত। খাদের গভীরে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা ছেলেটা।

লুকাসের লাশ পাওয়া গেছে ছয়দিন পর, প্রবল তুষারপাতের জন্য উদ্ধারকাজ ধীর গতিতে চলেছে, তাছাড়া পুরো স্কি জোনে ঠিক কোথায় লুকাস হারিয়েছে সেটাও
শনাক্ত করা কঠিন ছিলো। লুকাসকে পাওয়া গেছে স্কি জোনের বাইরে এক গভীর খাঁদে। রডরিগোকে খুঁজছে পুলিশ।

মিরার মানসিক অবস্থা সঙ্গিন, লুকাসের মৃত্যুর জন্য বারবার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে ওর। শোকে বিবশ মেয়েটা বারবার পুলিশকে রডরিগোর বর্ণনা দিচ্ছে। লোকটার আসল পরিচয় কেউ জানে না।

ঠিক যে সময় মিরা লুকাসের জন্য এক বুক হাহাকার নিয়ে কাঁদছে, সে সময় অস্ট্রিয়ার সোলডেনের স্কি রিজোর্টে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চাকরির আবেদন করেছে লুকাস হানসেন নামে পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে চাকরিটা তার হবে না। যদিও নিজেকে অভিজ্ঞ স্কি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে পরিচয় দিয়েছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই অভিজ্ঞতার প্রমান স্বরূপ কোনো কাগজপত্র দেখতে পারেনি।

লোকটা লাউঞ্জে বসে আছে। অল্প বয়সী ছাত্র ছাত্রীদের অনেকেই কম পয়সায় তার সাথে স্কি করতে নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যাবে। এমন একটা কম বয়সী দল খুঁজছে লোকটা।

দুপুরের দিকে একটা ছেলে আর মেয়ে এলো হাত ধরাধরি করে। পোশাক অবাক দেখে বোঝা যায়, তাদের পকেট হালকা। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে দয়ালু। ওদের লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় লোকটা। হাত বাড়িয়ে সুন্দর করে হয়েছে বলে, “হ্যালো, আমার নাম লুকাস হানসেন, একজন অভিজ্ঞ স্কি ইন্সট্রাকটর। তোমাদের যদি আমার সাহায্য লাগে বলতে পারো আমি খুব কম দামে স্কি করিয়ে দেব।”

মায়াবতী মেয়েটা এগিয়ে আসে লোকটার দিকে,তার সাথে স্কি করতে কত খরচ হবে জানতে চায়। লোকটা বিনয়ী ভঙ্গিতে খরচের পরিমান জানায়। তারপর অতিশয় ভদ্র ভাবে বলে, “আসলে আমার গার্ল-ফ্রেন্ড মিরার সাথে বিয়ে হবে কিছুদিন পরে, হাতে একেবারেই টাকা নেই। কোনো ক্লায়েন্ট পাচ্ছি না। মিরার ছবি দেখবে?”

লোকটা মানিব্যাগ বের করে মিরার সাথে তোলা একটা ছবি দেখায়, লাপ্পিস ক্যাফেতে গল্প করার ফাঁকে কখন যেন ছবিটা তুলেছিলো লোকটা।

-সালমা সিদ্দিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *