ডিনার ফর টু ( ৩য় পর্ব )

হাসান দেখল বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—রুবেল। হাসানের সমস্ত উচ্ছ্বাস উবে গেল নিমিষেই—চূড়ান্ত রকমের মেজাজ খারাপ হলো তার। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিল সে। মুখ কালো করে বলল, ‘ও তুমি। আমিতো ভাবলাম… আচ্ছা, তোমাকে না বললাম আসার দরকার নেই। অপলা যে কোন মুহূর্তে চলে আসবে। তুমি এখন যাও।’ রুবেল বলল, ‘হাসান ভাই, আমি এইখানে আসার একটু আগেই তো দেখলাম কে যেন আপনার বাসার সামনে থেকে চইলা গেল। মনে হয় অনেকক্ষণ দাঁড়ায় ছিল।’ রুবেলের কথা হাসান ঠিক বুঝতে পারল না। সে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।রুবেল আবার বলল, ‘আপনে তো মিয়া সারাদিন লাগায়ে দিলেন। দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? ছিলেন কোথায়?’ হাসান কিছু বলার আগেই রুবেল আবার বলল, ‘তারপর কি আয়োজন করতেছেন? এতদিন পর আপনার… হে হে হে’ বলতে বলতে হাসানকে পাশ কাঁটিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। হাসান ঘুরে বলল, ‘তুমি কি সত্যি সত্যি কাউকে চলে যেতে দেখেছ?’ ‘রিল্যাক্স ম্যান, আই ওয়াজ জাস্ট প্লেয়িং উইথ ইউ!’ ‘ধূর মিয়া, দিয়েছিলে তো হার্টের মধ্যে একটা পেরেক ঢুকিয়ে। সব সময় ফাজলামো করা ঠিক না।’ কপালের ঘাম মুছে হাসান বলল, ‘তো কোন মতলবে এখানে হাজির হয়েছো বলো, বিসাইডস টর্চারিং মি?’ ‘হাসান ভাই, আপনারতো ব্যবসা আর টাকা বানানোর চিন্তা ছাড়া আর কোন ধান্দা নাই—সময়ও নাই। তাই ভাবলাম, আপনার জন্যে কয়েকটা জিনিস নিয়া আসি।’ রুবেল দুষ্টুমির হাসি দিয়ে পকেট থেকে একটা ব্রাউন প্যাকেট বের হাসানের দিকে এগিয়ে দিল। ‘কী জিনিস?’ রুবেলের হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল হাসান। ‘আরে বুঝলেন না? আরে ঐ জিনিস! ইউ নো হোয়াট আই মিন…’ ‘নো আই ডোন্ট নো হোয়াট ইউ মিন.. তাছাড়া আমার কিছুই লাগবে না। তুমি এখন যাওতো ভাই। পরে এসো।’ ‘হাসান ভাই, আপনি বয়সে আমার বড় হইলে কী হবে—এই ব্যাপারে আপনার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা একটু বেশীই আছে। রাইখা দেন কাজে লাগবে। গরীবের একটা কথা, বাসী বানায়ে লাভ কী?’ ‘শোন রুবেল, তুমি বেশী কথা বলো। বেশী কথা বলা মানুষ আমার মাঝে মাঝে পছন্দ—তবে সব সময় না। যন্ত্রণা করবে না। এখন যাও, পরে এসো।’ রুবেল নাছোড়বান্দা। সে আবারো প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বিপদের সঙ্গী। সব সময় দু’একটা হাতের কাছে রাখতে হয়। কখন কাজে লাগে বলা যায় না।’ বলেই সে প্যাকেট খুলে বের করতে উধ্যত হতেই হাসান থামিয়ে দিল। ‘থাক খুলতে হবে না। এমনিই দাও, দিয়ে বিদেয় হও। তুমিতো দেখছি নাছোড়বান্দা।’ হাসান প্যাকেটটা রুবেলের হাত থেকে নিয়ে প্রায় জোর করেই ওকে বিদায় জানাল। রুবেল দরজা পর্যন্ত যেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘হাসান ভাই…’ হাসান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আবার কী? রুবেল, দয়া করে তুমি এখন যাও। অপলা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে। প্লিজ তুমি যাও—আমি পরে সব তোমাকে বলব। ওকে?’

‘যা যা ঘটবে সব?’

হাসান চোখ বড় করে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ যা যা ঘটবে সব।’

‘ঠিক আছে যাইতেছি। বাট আই উইল বি ব্যাক সুন।’ বলেই দরজা খুলে বের হয়ে গেল সে।

হাসান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। সে দরজাটা আটকাতে যাবে, রুবেল দরজা ধরে বলল, ‘আপনি এতো নার্ভাস হয়ে আছেন কেন?’

‘উফ!’ বলেই রুবেলের মুখের উপর সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল হাসান।

শিকাগোর হাইওয়ে ধরে অপলার ক্যাব ছুটে চলেছে। উদাস দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে বাইরে—স্মৃতির সব কটি জানালা খুলে। এতদিন পর আবার মনে পড়ে যাচ্ছে পেছনের কথাগুলো একটি একটি করে—বিক্ষিপ্ত ভাবে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করল নিজের মনের কত অব্যক্ত অনুভূতির কথা। জীবনের ক্যানভাসে এমন কিছু স্মৃতির ছবি আঁকা হয়ে যায়, যা ভোলা যায় না কখনোই।

হাসানের ফিরতে বেশ দেরি হলো।

সে ঘরে ঢুকে দেখল অপলা উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে আছে। হাসান আলতো করে অপলার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?’

অপলা কিছুই বলল না। নিঃশব্দে পড়ে আছে সে। ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।

হাসান ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যরি, আজও একটু দেরী হয়ে গেল।’

অপলা এবারো কিছু বলল না।

‘আই’ম রিয়েলি স্যরি।’

অপলা যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রইল। তারপর ঠাণ্ডা কিন্তু কঠিন স্বরে বলল, ‘আমার টিকিটের ব্যবস্থা করো। আমি বাংলাদেশে যাব।’

‘আর মাত্র কয়েকটা মাস। বিজনেসটা একটু গুছিয়ে নেই, তারপর দেখো আর দেরী হবে না।’

‘সে কথা গত তিন বছর ধরেই শুনছি।’ একটু থেমে অপলা অভিমানী কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কি একবারো আমার কথা ভাবো?’ তার গলা ধরে এলো। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘বিয়ের পরে তুমি আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছ বলো? দেশে গিয়ে বিয়ে করে রেখে এলে। কি অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে এক একটি দিন আমাকে কাটাতে হয়েছে!’

‘এখনতো তুমি চলেই এসেছ।’

অপলা উঠে বসল। ঘুরে মুখোমুখি হলো হাসানের। গলার স্বর উঁচু না করেই বলল, ‘হ্যাঁ, চলে এসেছি, কিন্তু কার কাছে? যার জন্যে এতো অপেক্ষা, তার কাছে এসেও যদি তাকে না পাই, তাহলে এ আসার কী মানে?’

হাসান চুপ করে রইল।

‘আমাকে যদি সময় নাই দেবে তাহলে বিয়ে করে এনেছিলে কেন? শুধু রান্না, ঘর গোছানো, লণ্ড্রী করা আর মাঝে মাঝে তোমার শরীরের ক্ষুধা মেটানোর জন্যে? আমিতো একটা মানুষ, হাসান। এই ঘরটার মধ্যে একা একা আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’

হাসান কী বলবে ভেবে পেল না।

কথা বলতে বলতে অপলা চলে গেল ওদের ছোট্ট কিচেন কাম ডাইনিং রুমটাতে। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করতে করতে সে গজগজ করছে। হাসান তার পেছনে এসে বসল ডাইনিং টেবিলে। অপলা প্লেটে ভাত তুলে এগিয়ে দিল হাসানের দিকে।

হাসান লক্ষ্য করল, এত রাগ ক্ষোভ আর অভিমান নিয়েও অপলা তার জন্য খাবার গরম করে দিচ্ছে ঠিকই—প্লেটেও তুলে দিচ্ছে।

‘জেলখানায় মানুষও এর চেয়ে বেশী ভাল থাকে। অন্তত কথা বলার সঙ্গী পায়। এখানে আমার কে আছে যার সঙ্গে কথা বলে দু’দণ্ড সময় কাটাব?’ অভিমানী কণ্ঠে অপলা বলল।

‘আহা তোমাকে না বললাম, এখানে কত বাঙালি ভাবী আছে—তাদের কারো সঙ্গে পরিচয় করো। বন্ধু বানাও। কথা বলো। সময় কেটে যাবে।’

‘পরিচয়টা হবে কীভাবে? ঘরে বসে থেকে? বাঙালিদের কোন অনুষ্ঠানে তুমি আমাকে নিয়ে যাও, না সে সময় তোমার আছে? তাছাড়া কোন বাঙালি ভাবীর সঙ্গে পরিচয় হয়ে অন্য আরেক ভাবীর সমালোচনা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার চাই তোমার সময়, অন্য কারো নয়।’

‘তাহলে টিভি দেখো। তোমার জন্যেই তো সব হিন্দি আর বাংলা চ্যানেলগুলো নিলাম।’

অপলা আহত চোখে তাকাল হাসানের দিকে। এসব বিনোদনে সাময়িক সময় কাটে—কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান নয়। হাসান এই কথাটা কেন বুঝতে পারছে না।

হাসান এবার বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি কি চাওনা আমাদের একটা সুন্দর বাড়ি হোক, ভাল গাড়ি থাক। দেখো, তাকিয়ে দেখো আমরা কোথায় থাকি। দু’কামরার ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট। যেখানে একটা গেস্ট আসলে থাকতে দেবার জন্যে আলাদা একটা রুম নেই। এক চিলতে রুমের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে সব কিছু ভরা। ডাইনিং টেবিলটা বসাতে হয় কিচেনের মধ্যে। তোমার ইচ্ছে হয় না, আমাদের একটা স্বপ্নের বাড়ি হোক! এগুলো আমি কার জন্যে করছি, অপলা? তোমার জন্যে, আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে। সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্যে।’

‘এখানে আসার পর থেকেই তোমার কাছে একটা বাচ্চা চেয়েছি। সেখানেও তোমার আপত্তি। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি, বলে এড়িয়ে গেছো। আর ভবিষ্যতের কথা বলছো? হাহ, আমার তো বর্তমানই নেই, আর ভবিষ্যত!’

হাসান মুখ নিচু করে ফেলল। সে কোনো উত্তর দিতে পারল না।

‘তুমি শুধু তোমার স্বপ্নের কথাই ভাবছো, হাসান। অন্য কারো নয়। একদিন তোমার অনেক টাকা হবে। স্বপ্নের বাড়ি হবে, গাড়ি হবে ঠিকই—কিন্তু যার বা যাদের কথা ভেবে এগুলো করছ, তারা হয়ত কেউ থাকবে না তোমার পাশে। একদিন কাজ থেকে ফিরে এসে দেখবে আমি নেই।’

হাসান মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে শুনছে অপলার কথা।

‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট মানি, হাসান। আই ডোন্ট নিড মানি। আই নিড এ লাইফ!’

হাসান বুঝতে পারছে না কী বলবে। অপলাকে কখনোই এতটা উতলা হতে দেখেনি সে এর আগে। হাসানের হঠাৎ একটু একটু খারাপ লাগতে লাগল। আহারে, বিকেল থেকে মেয়েটা সেজে গুজে বসে ছিল—বিয়ে বার্ষিকীর দিনটিতে ওকে তার প্রিয় রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবার কথা ছিল। সেটা বড় কথা নয়—অপেক্ষায় থেকে মেয়েটা অভিমানের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছে। রাতে বাইরে খাবে বলে সে হয়ত কিছু রান্নাও করেনি। তাই পুরনো যা ছিল তাই গরম করে সামনে দিয়েছে।

অপলা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল বেডরুমে। এবং কাপড় বদলে শুয়ে পড়ল। তার এখন আর কান্না পাচ্ছে না। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবার পর যখন সে বুঝতে পেরেছে—হাসানের আসতে আজকেও দেরি হবে, তখন থেকেই ক্ষণে ক্ষণে সে কেঁদেছে অনেক।

পেছনের কথাগুলো ভেবে চোখ ভিজে এলো অপলার। সে চোখ মুছে তাকাল বাইরে আর ঠিক তখনই তার ক্যাব হাইওয়ে থেকে বের হয়ে ছবির মত দেখতে একটি আবাসিক এলাকায় ঢুকল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাব ড্রাইভার ঠিকানা মিলিয়ে হাসানের প্রাসদোপম বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। অপলা ফিরে এলো বাস্তবে।

ক্যাব থেকে নেমে অপলা তাকাল বাড়িটার দিকে। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। দাঁড়াল সদর দরজার সামনে।

হঠাৎ অপলার কী হলো কে জানে। ডোর বেলে চাপ দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। একবার রাস্তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখল ক্যাব ড্রাইভার তাকিয়ে আছে তার দিকে । কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে ফিরে গেল ক্যাবের কাছে।

(চলবে…

ফরহাদ হোসেন। লেখক,নির্মাতা। ডালাস,টেক্সাস।

Share this:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *