ডিনার ফর টু ( ৬ষ্ঠ পর্ব )

অপলার ফোন বাজতেই হাসান চমকে উঠল। একটু ইতস্তত করে সে তাকাল অপলার দিকে। অপলা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল হাসানের মুখ ঠিক তার মুখের সামনে। বেরসিক ফোনটি বেজেই চলেছে। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল অপলা। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে বলল, ‘Hello?’ ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলল। কিছুক্ষণ শুনে অপলা বলল, ‘Oh, I miss you too.’ ওপাশের মানুষটি আবার কিছু বলল। অপলা উত্তর দিল, ‘Okay, I’ll be back in couple of days.’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘I love you too!’ এ পর্যায়ে হাসান তাকাল অপলার দিকে—চিন্তিত ভঙ্গিতে। অপলার মুখে ‘আই লাভ ইউ টু’ শুনে তার মাথায় নতুন চিন্তা শুরু হলো। কার ফোন—কে হতে পারে, যাকে অপলা বলতে পারে আই লাভ ইউ টু? অপলা কথা শেষ করে ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে উপলব্ধি করল—এসময়ে ফোনটা না এলে কী হতো! হঠাৎ করেই একটা অস্বস্তিকর নীরবতায় ছেয়ে গেল ঘরটাতে। হাসান তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। অপলা তাকাল হাসানের দিকে। হাসানের চেহারায় সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখা দিলেও অপলা তা ধরতে পারল না।

অপলা একটু ধাতস্থ হয়ে প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করল, ‘সো হোয়াট’স আওয়ার প্ল্যান ফর টুমরো?’ ‘কাল সারাদিন তোমাকে নিয়ে ঘুরব। বাইরে লাঞ্চ করব, বোট রাইডেও যেতে পারি। তুমিতো মিলেনিয়াম পার্ক দেখনি। নামেই পার্ক, কিন্তু কোন বাগান নেই। হা হা হা…।’ হাসান স্বাভাবিক হয়ে এলো। ‘সাউণ্ডস গ্রেট!’ একটু থেমে অপলা হাসানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর একসময় বলল, ‘সময়টা বেশ কাটছিল তাই না?’ ‘তাহলে, আরেকটু বসো না।’ অপলা চুপ করে রইল। সে স্থির করতে পারছে না—কী করবে। এক মন চাইছে, আরেকটু থেকে যেতে–কী এমন ক্ষতি। আরেক মন বলছে, এত তাড়াহুড়ো কিসের। হাসান ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে এভাবে কাছে পেয়ে আমার যে কী ভাল লাগছে। আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে সারাজীবনের জন্যে তোমাকে কাছে রেখে দিতাম। কোথাও হারিয়ে যেতে দিতাম না।’ ‘তাহলে চেষ্টা করছ না কেন?’ একটা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে অপলা কয়েক পা হেঁটে দরজার কাছে গেল। ঘুরে তাকাল হাসানের দিকে। তারপর বলল, ‘গুড নাইট হাসান।’ হাসান একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে হাত নেড়ে বলল, ‘গুড নাইট অপলা।’ একটু থেমে অপলা চলে গেল ওপরে—তার রুমে। হাসান তাকিয়ে রইল অপলার চলে যাওয়ার দিকে। এবং হঠাৎ করেই প্রচণ্ড মন খারাপ হলো তার। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সারাটা রাত যদি কথা বলা যেত অপলার সাথে। অপলা বলেছিল, কত কথা জমে আছে। তাহলে? হাসানেরও তো কত কথা বলার ছিল। কিছুই তো বলা হলো না। বিষাদে ছেয়ে গেল তার মনটা।

অপলা ড্রেস বদলে স্লিপিং গাউন গায়ে জড়িয়ে নিল। প্রসাধনী তুলে ধীরে ধীরে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ শুয়ে এপাশ ওপাশ করল সে। তার মনে হাজারো প্রশ্ন দেখা দিল। হাসানের এমন পরিবর্তন তাকে অবাক করেছে। হাসানের ব্যবহার এবং কেয়ারিং তাকে অভিভুত করল। হাসান কি তাহলে সত্যি সত্যি তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বিশ্বাসই হচ্ছে না, অপলার জন্য এতটা ভালবাসা সে লালন করে আছে। যেই মানুষটা টাকা আর কাজ ছাড়া অন্য কিছুই বুঝত না, অপলার দিকে ভাল করে তাকাবার একটু সময় যার হতো না, আজ সেই কিনা… অপলা মনে মনে ভীষণ অবাক হলো। অপলার রেখে যাওয়া সবকিছু হাসান এই বাসাটাতে এনে গুছিয়ে রেখেছে। বিশাল বড় বেডরুম, বাথরুম সব কিছু কাস্টম ডিজাইন করে বানিয়েছে—তার জন্যে। ভাবতে অন্যরকম লাগছে।হাসানের জন্যে এখন খুব মায়া হচ্ছে তার। আহা বেচারা, কেমন অসহায় হয়ে গেছে। অপলা এখন কী করবে? ফিরে আসবে? তার কি ফিরে আসা উচিত?অন্যদিকে হাসান তার রুমে বসে বসে ভাবছে, অপলা কি তাহলে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে? নাকি দেখতে এসেছে হাসান এখনো একা আছি কিনা। অপলাকে কী করে বুঝাবে যে, সে তার হৃদয়ের কত বড় একটা অংশ হয়ে আছে। অপলার চলে যাওয়া হাসানকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে—উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। সে এখন এক নতুন মানুষ। হাসানের খুব ইচ্ছে হচ্ছে অপলাকে জড়িয়ে ধরে সারারাত শুয়ে থাকতে। সে কি যাবে তার কাছে? কিন্তু অপলা যদি আবার অন্য কিছু ভাবে? হাসানের মনে আছে, অপলা কিছু নিয়ে রাগ করলে কিছুতেই তার শরীর ছুঁতে দিত না। সে বলত, তোমার ভালবাসা তো শুধু শরীরেই। আমার মন ভাল না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ছোঁবে না তুমি। রাত গভীর হয়ে এলো। দুজন মানুষ একটা দ্বিধার দেয়ালের দু’পাশে অস্থির হয়ে ছটফট করছে। এভাবেই দুজন একান্ত কাছের মানুষ, একে অপরের আরো কাছে এসেও অস্বস্তিকর দীর্ঘ একটি রাত পার করে দিল শুধু সংকোচ আর দ্বিধার কারণে।

পরের দিন রোববার। শিকাগোর দিনটা শুরু হলো রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল দিয়ে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হবে হবে করছে। সকালে তাদের দুজনেরই ঘুম ভেঙেছে একটু দেরীতে। আগের দিনের পরিকল্পনা মোতাবেক আজ তাদের শিকাগো ডাউনটাউনে যাওয়ার কথা। হাসান একটা নীল রঙের জিনস প্যান্ট আর সাদা পোলো টি-শার্ট, মাথায় বেসবল ক্যাপ, চোখে রে-ব্যান সানগ্লাস পড়ে বের হয়ে তার বিএমডব্লিউ এসইউভি স্টার্ট দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে অপলা এসে উঠে বসল হাসানের গাড়িতে। কাকতালীয় ভাবে অপলা পড়েছে সাদা রঙের স্কার্ট, নীল টপস, তার চোখে প্রাডা ব্রাণ্ডের সান-গ্লাস। দুজনকেই অপূর্ব লাগছে। হাসান গাড়ি ছেড়ে দিতেই কোথা থেকে রুবেল এসে হাজির। হাসানদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলল, ‘কাজ তাহলে ঠিকঠাক মতই আগাইতেছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌!’ লেক মিশিগানের তীর ঘেঁষে পথচারীর আর পর্যটকদের হাঁটা চলা চলছে। হাসান আর অপলা পর্যটকদের মতোই ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। নীল রঙা লেকের ব্যাকগ্রাউণ্ডে তাদের দুজনকে পাশাপাশি মনে হচ্ছে হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকা কোনো গানের দৃশ্যে অভিনয় করছে। লেকের পাড়ে আসার আগে হাসান অপলাকে নিয়ে গেল শিকাগোর বিখ্যাত মিলেনিয়াম পার্কে। সেখানে বিভিন্ন আর্ট-গ্যালারির মধ্যে বাংলাদেশের একটি কাজ দেখাল। অপলা অবাক হয়ে দেখল। এবং যারপরনাই অভিভূত হলো। সেখান থেকে দুজনে মিলে বিখ্যাত বাকিংহাম ফাউণ্টেনের কাছে গেল। এই জায়গাটি অপলার খুব প্রিয়। ঝর্ণার পাশে কিছুসময় থেকে তাঁরা গেল নেভি-পিয়ারে। সেখানে লেকের ধারের একটি রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করল। ইতিমধ্যেই দুপুর গড়িয়েছে। লাঞ্চ শেষ করে হাসান আর অপলা এসে বসল লেকের পাড়ের একটি বেঞ্চে। পড়ন্ত বিকেল। ঝিরিঝিরি বাতাস ভেসে আসছে লেক থেকে। ওরা দুজন তাকিয়ে আছে সামনে। একটা ট্যুর বোট ভেপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে ওদের সামনে দিয়ে। ডেক থেকে সবাই হাত নেড়ে তারা শুভেচ্ছা জানাচ্ছে পাড়ের মানুষগুলোকে। পাড় থেকে থেকেও সবাই হাত নেড়ে উত্তর দিচ্ছে। অপলার দিকে ঘুরে হঠাৎ করেই হাসান বলল, ‘অপলা, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল।’ ’বলো।’ অপলা অবাক হয়ে হাসানের দিকে তাকাল। হাসান ইতস্তত করে বলল, ‘আমরা দু’বছরের কিছু বেশি সময় ধরে আলাদা। ইট’স এ বিগ গ্যাপ। এসময়ের মধ্যে তোমার কিংবা আমার অন্য যে কাউকে ভাল লাগতে পারে—কারো সাথে সম্পর্কও হয়ে যেতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। অপলা হেসে দিয়ে বলল, ‘এতো ভূমিকা দেবার দরকার নেই হাসান। সরাসরি বলে ফেলো, যা বলতে চাও।’ ‘আমার ধারণা, তুমি কাউকে ভালবাসো। কারো সাথে তোমার সম্পর্ক হয়েছে।’ অপলা তড়িৎ হাসানের কনফিউশনের ব্যাপারটা ধরে ফেলল। সে দুষ্টমি করে মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার ধারণা ভুল নয়।’ হাসানের চেহারায় খানিকটা অনিশ্চয়তার ছায়া দেখা দিল। সে বলল, ‘But I have to tell you how I feel for you.’ অপলা হাসানের হাঁটুর ওপরে হাত রেখে বলল, ‘I know now how you feel about me.’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘তোমার হয়ত মনে হচ্ছে, আমাকে কিছু বলার এটাই তোমার শেষ সুযোগ, আমি আবার চলে যাবার আগে।’ ‘হ্যা তাই।’ বলেই একটু হাসল হাসান—শুষ্ক হাসি। ‘এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতে চাইনা। তোমার সাথে আর যদি দেখা না হয়, যদি তোমাকে আমার কথা গুলো বলা না হয়, যে তোমাকে আমি…’ ‘কত ভালবাসি?’ হাসান চুপ। ‘First of all, I don’t have a boyfriend—আর কারো সাথেও আমার কোনো সম্পর্কও হয়নি।’ ‘না? তাহলে কাল রাতে তুমি যে ফোনে বললে, I love you, too?’ হাসান ইতস্তত করে বলল। ‘আমি রাইসার সঙ্গে কথা বলছিলাম।’ অপলা আবারো মিটিমিটি হাসছে। ‘রাইসা?’ ‘হ্যাঁ। আমার বান্ধবীর মেয়ে। চার বছর বয়স।’ ‘দেখো দেখি কী কাণ্ড, আর আমি কিনা ভাবলাম—’ হাসান নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিব্রত বোধ করল। ‘আমার বান্ধবী শিল্পী, যার সাথে আমি থাকি—ওর চার বছরের মেয়ে। রাইসাই আমার একমাত্র ভালবাসা। সম্পর্ক যদি কারো সাথে হয়ে থাকে তা ঐ ছোট্ট মেয়েটির সাথে। অমন একটি মেয়েতো আমারো থাকতে পারত!’ এটুকু বলতে বলতে অপলার গলা ধরে এলো। সে তাকিয়ে থাকল লেকের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে। তার চোখ খানিকটা ভিজে গেল। অপলার কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল হাসান। নীরবতায় কেটে গেল আরো কিছুটা সময়। অপলা নিজেকে স্থির করে বলল, ‘হাসান, আজ রাতে আমাকে চলে যেতে হবে।’ ‘চলে যেতে হবে মানে? কোথায় চলে যাবে?’ ‘তোমাকে তো বলা হয়নি, আমি আসলে এসেছিলাম আমার কোম্পানির এনুয়াল কনফারেন্সে। কাল পরশু দু’দিন মিটিং হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে। পরদিন সকালেই আমার ফ্লাইট।’ হাসান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না, অপলা কী বলছে এসব। ওতো ধরেই নিয়েছিল অপলা আবার ফিরে এসেছে তার কাছে। তারমানে অপলা শুধু দেখা করতে এসেছে—সম্ভবত নিজের চোখে দেখে গেল সে কেমন আছে। হাসান তাকিয়ে রইল অপলার মুখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে। ‘যখন জানলাম, শিকাগোতে কনফারেন্স, খুব ইচ্ছে হলো দুটো দিন আগে এসে তোমাকে একটু দেখে যাই। তোমার সঙ্গে একটু সময় কাটাই। তোমাকে মাঝে মাঝে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।’ হাসান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অপলার চোখের দিকে। কী মায়া নিয়ে কথাগুলো বলল অপলা। হাসান নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। সে অপলার হাত চেপে ধরল। ’কেন তোমাকে ফিরে যেতে হবে? না, অপলা। না, আমি তোমাকে আর যেতে দেব না। For god sake, look at me. I’m a different person now!’ ’আমি জানি।’ ‘এটা ঠিক একটা সময় আমি টাকার পিছনে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। তখন মনে হতো জীবনে টাকাই সব। তুমি চলে যাবার আগের দিন পর্যন্ত মনে হয়েছিল, জীবনে টাকার চেয়ে ইম্পোরট্যান্ট কোন কিছু নেই। Now I know, money can only solve money problem. Nothing else. Money cannot buy happiness. Money can give freedom not life. I don’t want money any more. I want to have a life!’

হাসানের মুখে এমন কথা শুনে অপলা বেশ অবাক হলো। মনে হলো অপলার বলে যাওয়া কথাগুলোই আবার বলল হাসান। অপলা একসময় এই কথাগুলোই হাসানকে বলত। অপলার হাত ঝাঁকি দিয়ে হাসান আবারো বলল, ‘প্লিজ, তুমি চলে যেও না। চলো, আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি।’ অপলা কোনো জবাব দিল না। সে চুপ করে রইল। হাসান অপলার হাত ধরে অপক্ষা করছে—তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অপলা বলল, ‘চলো ফেরা যাক। আমার হোটেল চেক-ইনের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।’

(চলবে…)

ফরহাদ হোসেন
লেখক-নির্মাতা
ডালাস,টেক্সাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *