দায়মুক্তি ( ২য় এবং শেষ পর্ব)

অতি বিস্মিত হয়ে নিলু চিঠির ভাঁজ খুলল।

“খন্দকার সাহেব ”
সালাম জানবেন। মোসাঃ রেহনুমা আক্তার যে আপনাদের কন্যা নয়, ইহা আমরা জানিতে পারিয়াছি। আপনাকে অতি সজ্জন ও ভদ্রলোক বলিয়াই জানিতাম। এতবড় একটা সত্য গোপন করিয়া আপনারা মেয়েটাকে আমাদের ঘাড়ে উঠাইয়া দিতে চাহিলেন। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে শেষমুহূর্তে হইলেও আমরা সত্যটা জানিতে পারিয়াছি। তার চেয়েও জঘন্য বিষয় হইল এই মেয়ে আপনাদের বাড়ীর কাজের লোক রহমতের মেয়ে।একজন কাজের লোকের মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধূ হিসাবে কখনওই মানিয়া লইবনা। আমার মতই আমার ছেলের মত।নূন্যতম ভদ্রতা থাকিলে আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করিবেন না। আল্লাহ মেহেরবান।
“জয়নাল আহমেদ”

নিলু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইফতেখার দূর থেকে চিৎকার দিল ” এই আম্মা কি হইছে?” নিলুর চোখ ঝাপসা হতে লাগল দ্রুত। কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা সে। পড়ে যাওয়ার শেষ মূহুর্তে সে টের পেল শক্ত হাতে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

চোখ খুলল নিলু। নিস্তব্ধ চারপাশ। ইফতেখার কে দেখতে পেল গা ঘেঁষে বসে আছে চিন্তিত মুখে। দরজার কাছে রানু দাঁড়িয়ে, গায়ে বিয়ের বেনারসি, চোখে তার বিস্ময়। নিলু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল– ” ক’টা বাজে?
ইফতেখার ঘড়ি দেখল- ” প্রায় বারোটা মা।
” সবাই জেনে গেছে?
“হ্যাঁ আম্মা”।
“মেহমানরা সব চলে গেছে ইফতি?”
জ্বী আম্মা”।
আর রানু?
” রানু ও জেনে গেছে আম্মা”।
“বড় আপা, দুলাভাই কই?
” খালুর শরীর খারাপ করেছে, ঘুমের ওষুধ দিয়েছি, ঘুমাচ্ছে এখন। খালা সেই ঘরেই আছে।
রানুকে চোখের ইশারায় ডাকল নিলু, ” এদিকে আয় বোস আমার কাছে।”
রানু যন্ত্রের মত হেটে এল, নিলুর মাথার কাছে বসল।
জাহানারা ছুটে এল, নিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
” বড় আপা তোমরা কেউ কখনো আমারে জানাইলানা যে রানু রহমত ভাইয়ের মেয়ে, কেউ বললা না! জানানো উচিৎ ছিল আপা। অনেক বড় ভুল করছ,দীর্ঘ শ্বাস ফেলল নিলু।”
” নিলুরে রানু আমার মেয়ে,কোন পরিচয় লাগবেনা, ও আমার মেয়ে এইটাই পরিচয়। সন্ধ্যা থেকে মেয়েটা পাথর হয়ে আছে। কথা কয় না, কান্দেও না। তুই একটু ওরে কানতে বল। এমন হইয়া থাকলে ওতো মইরা যাবে। জাহানারা রানু কে জড়িয়ে ধরল—-” রানু রে…।

নিলু ধীরে ধীরে উঠে বসল,রানুর মাথায় হাত দিয়ে বলল “কাছে আয় তোরে একটা গল্প বলি শোন—- “৭১ এ যখন যুদ্ধ শুরু হল বড় আপার বয়স তখন ১৫ বছর। আমাদের গ্রামে পাকিস্তানী আর্মি আসল।বড় আপারে আব্বা রাতের অন্ধকারে আমাদের নানাবাড়ি পাঠাই দিল। আমার বয়স ১২। আব্বা আম্মা আর আমি বাড়ীতে। রহমত ভাই তখন ২০/২২ বছরের যুবক, আমাদের বাড়ীতে কাজ করত। সে আব্বারে বলল — ” চাচা অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি ছোট আপা আর চাচী রে নিয়া কিছুদিনের জন্য অন্যখানে চলে যান।” সে যাওয়ার সব ব্যবস্থা ও করে ফেলল। যেদিন রাতে আমরা বাড়ী ছাড়ব সেদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানী আর্মি আমাদের পুরা বাড়ী ঘিরে ফেলল। দরজা ধাক্কাই ভেংগে ফেলতেছে ওরা। আব্বা দরজা খুলল। আমি আড়াল থেকে লুকাই সব দেখতেছি। ওরা ঘরে ঢুকেই আব্বা আর আম্মারে গুলি কইরা মাইরা ফেলল আমার চোখের সামনে। আমি চিৎকার দিয়া খাটের নিচে লুকাইলাম। ওরা ভেতরে ঢুকল। খাটের নিচ থেকে আমারে টাইনা বের করল। তিনজন ছিল বুঝলি!! একজন আমার ফ্রক টা টেনে ছিঁড়ে ফেলল।তারপর তিনটা শয়তান আমার উপর কুকুরের মত ঝাপাই পড়ল।”
ইফতেখার চিৎকার দিল ” আম্মা চুপ করেন!! কি বলেন এইসব????
” সত্যি বলি বাবা, নির্মম সত্যি!!
ইফতেখার ছুটে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
” তুই শোন রানু– তারপর ওরা আমারে পুরা বিবস্ত্র করে দিল। ১২ বছরের নিলু আমি। চোখের সামনে বাবা মা মরে পরে আছে, শোকে পাথর আমি। ওরা আমার নগ্ন শরীর টা নিয়া খেলতে শুরু করল, কুৎসিত খেলা !!! আমারে দাঁড় করাই রাখল হাত পা সোজা করে। নড়াচড়া করলেই বন্দুক দিয়ে বারি দিচ্ছে। তারপর একজন একজন করে আমার ছোট্ট শরীর টারে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত করে ফেলতে লাগল।
আমি মেঝেতে পরে আছি নিস্তেজ হয়ে। চোখ দুইটা খোলা আমার। তাকাই দেখতেছি সামনের বারান্দায় আব্বা আর আম্মার লাশ। মেঝে থেকে রক্ত গড়াই চলে গেছে দরজার দিকে। সেই দিকে হাত টা বাড়াই দিলাম আমি, অস্পষ্ট গলায় ডাকলাম ” বাবা, ও বাবা” । বাবাতো আমার হাত টা ধরতে পারেনা!!!!
নিজের শরীর টা ক্ষতবিক্ষত হইতেছে, কিছুই করতে পারতেছি না আমি। অনেক্ষন পর কুকুর গুলা উঠে দাড়াল, পা দিয়া লাত্থি দিয়া সরাই দিল আমারে………….

এই পর্যন্ত বলে থামল নিলু। তারপর হঠাৎ ঝুকে বমি করে দিল মেঝেতে। জাহানারা “নিলু” বলে আর্তনাদ করে উঠল। ইফতেখার ছুটে এসে দরজায় দাঁড়াল। রানু দুহাত দিয়ে ধরে রাখল নিলুকে। নিলু হাত সরিয়ে দিল — “ছাড় আমাকে, ঠিক আছি আমি, একদম ঠিক। ” খাটের পেছন দিক টায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। তার পরের ঘটনা শোন——

” কুকুর গুলা চলে গেল। রহমত ভাই দৌড়াই আসল তারপর ই। তার সমস্ত গা ভেজা, গায়ে কচুরিপানা লাইগা আছে।বোধহয় পুকুরে ডুবে লুকাই ছিল। সে একটা চটের বস্তা দিয়া আমারে ঢাইকা দিল। ছোট আপা ছোট আপা বলে কাঁদতে লাগল। কতক্ষণ পর একটা পুরানো চাদর দিয়া আমারে পেঁচাইয়া কাঁধে উঠাইয়া হাটা শুরু করল। কতক্ষণ যে সে হাটল!!! আমি মাঝখানে জ্ঞান হারাইলাম, আবার হুশে আসলাম। দেখি সে হাটতেছে। শেষরাতে সে আমারে নিয়া একটা বাড়ীতে পৌছল। মাঝ বয়সী একজন মহিলা আমারে একটা চকিতে শোয়াই দিল। ওই টা রহমত ভাইয়ের মা ছিল। কি যে যত্ন করল সে আমারে !!! সারাদিন কাছে বইসা রইল। নামাজ পড়ত আমার কাছে বসে আর শুধু কানত।
একদিন পর রহমত ভাই আসল।সে তাদের গরু টা বিক্রি করে টাকা নিয়া আসছে। আমার সামনে বসে বলল – “ছোট আপা টাকার ব্যবস্থা হইছে, আজ রাইতেই আমি আপনারে নিয়া রওনা হমু”।
আমি এত মানসিক আঘাত পাইছি যে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে আমার, কিছু বলতে পারিনা।
রহমতভাই সেই রাতে আমারে কাঁধে নিয়া আবার রওনা হলো। কত পথ পার হইয়া আমরা একটা ক্যাম্পে পৌছলাম। সেই ক্যাম্পে ভাল ডাক্তার ছিল। তারা আমার চিকিৎসা করল।দীর্ঘ দিন ওখানে থাকলাম আমি। মাঝেমধ্যে এসে দেখা করত আমার সাথে আর বলত “সব ঠিক হইয়া যাইবে ছোট আপা, এমন দিন থাকবে না”। আমি ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। তারপর একদিন হঠাৎ রহমত ভাই মেঝমামারে নিয়া আসল ক্যাম্পে। মামা বলল ” রহমত বলছে তুই এইখানে আছিস, ক্যামনে আসলি এত দূর?? ”
আমি রহমতভাইয়ের দিকে তাকালাম। সে হাসল, বলল “যান বাড়ী ফিরা যান।দেশ স্বাধীন হইছে।””

আমরা ফিরে এলাম নিজেদের বাড়ীতে। তারপর অনেকটা সময় চলে গেল। বড় আপার বিয়ে দিল মামারা। তারও বেশ কয়েক বছর পর ইফতির বাবার সাথে আমার বিয়ে হল। কেউ জানলনা সেই ভয়ংকর ঘটনা।
রহমত ভাইয়ের একটা গানের দল ছিল।সারাদিন সেই দলের সাথে ঘুইরা বেড়াইত। আমি তারে শেষ কবে দেখছি বলতে পারব না।মনেমনে কত যে খুঁজছি তারে,,,,,,

জাহানারা বেগম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কাঁদতে ও ভুলে গেছেন তিনি। নিলু ক্যাম্পে আছে এই খবর রহমতই দিয়েছিল তাদের। বলছিল অনেকের সাথে পালিয়ে ওখানে গিয়ে পৌঁছেছে নিলু। নিলুর মাথায় হাত রাখল জাহানারা, শান্ত ভাবে বলল — ” কাউরে কোনদিন কিচ্ছু বলেনাই রহমত। ” তোর বিয়ের পর তুই তো চলে গেলি, রহমত মাঝেমধ্যে আসত আমার কাছে খোঁজখবর নিতে, তোর কথাও জিজ্ঞেস করত। তারপর একদিন রাতে কাঁথায় জড়াইয়া সদ্য হওয়া একটা বাচ্চা নিয়া আসল।রহমত খুব কাঁদতে ছিল সেদিন। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল– ” বাচ্চাটা হওয়ার সময় বউ টা মরে গেছে বড় আপা! বাচ্চাটা খালি কান্দে, ওরে তুমি রাইখা দাও বড় আপা।””
আমার বিয়ের বয়স তখন ৬ বছর, কোন বাচ্চাকাচ্চা হইল না। আমি রহমতের বাচ্চাটারে বুকে জড়াই নিলাম। আদর করে নাম রাখলাম “রেহনুমা”।
রানু শব্দ করে কেঁদে উঠল। জাহানারা কে জড়িয়ে ধরল সে—-” আম্মা আমার বাবা এখন কই?”
“জানিনারে মা” তোরে আমার কাছে দিয়া সেই যে চলে গেছে, আর কোনদিন আসে নাই মা!!!

রানু চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উঠানের মাঝখানে হাটু গেড়ে বসে পড়ল সে — ” আমার বাবা কই? কই আমার বাবা? কেউ তো বল আমারে !!! কেউ তো বল !!! রানুর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস……

নিলু ধীর পায়ে বাইরে এল। জ্যোৎস্নায় পুরা উঠান ঝকঝক করতেছে। কি মায়াময় জ্যোৎস্না!!! ইফতেখার কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি নিলু, গভীর আবেগ নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল সে।
” ইফতিরে,, একটা অনুরোধ করব তোরে? মেয়েটার মাথায় একটু হাত রাখবি? ওর বুকের মধ্যে হাহাকার রে বাবা!! ভালবেসে পারবিনা মাথায় হাত রাখতে??
ইফতেখার চুপ করে রইল!!!
নিলু ছেলের দিকে তাকাল ” অন্য কাউরে মাথায় হাত রাখার কথা দিয়ে ফেলছিস?? ”
হাসল ইফতেখার ” রানুর চুল গুলো কি সুন্দর, দেখছেন আম্মা!!! দেখেন, মাটি ছুয়ে আছে!””

নিলু বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এ নিঃশ্বাস স্বস্তির, এ নিঃশ্বাস আত্মতৃপ্তির, দীর্ঘ দিনের একটা দায়মুক্তির। আকাশের দিকে তাকাল নিলু,  এত সুন্দর মায়াময় জ্যোৎস্না বহুকাল দেখেনি সে……।

নিলুকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ইফতেখার, গভীর ভালবাসায় কাউকে সিক্ত করতে, জড়িয়ে নিতে……….।

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *