দ্বিতীয় মৃত্যু

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে পায়চারি করছে নিবারণ। দরজার উপরে লাল বাতি জ্বলছে। ভেতর থেকে ডাক্তার বা নার্স কেউ বেরিয়ে এলেই ছুটে গিয়ে জানতে চাচ্ছে কোনো খবর আছে কি না। একজন নার্স বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি বসুন। কোনো খবর হলে আমরাই আপনাকে ডেকে নেব। তবুও চিন্তাগ্রস্ত নিবারণ একবার মার কাছে গিয়ে বসছে আবার কিছুক্ষণ পরই অপারেশন থিয়েটারের দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছে। এরমধ্যে এক নারীকে তার সামনে দিয়েই ট্রলিতে করে নিয়ে গেল পোস্ট অপারেটিভ রুমে। নারীর আত্মীয়স্বজনরা ট্রলি ঘিরে এগিয়ে যাচ্ছে। তার জমজ সন্তান হয়েছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। আহা! কী আনন্দ সবার মধ্যে।

নিবারণ মাকে বলল,
-শেফালীকেও এখান দিয়ে নিয়ে যাবে।

নিবারণের মা আশালতা একথার কোনো সাড়া না দিয়ে কৌটা থেকে একটা পান বের করে মুখে দিল।

নিবারণ বলল,
-তোমাকে তো ডাক্তার পান খেতে বারণ করেছে। তারপরও তুমি পান খেয়ে যাচ্ছ ? ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলে আমি কিন্তু মিথ্যা বলতে পারব না।

আশালতা এবারও কোনো কথা বলল না। আপন মনে পান চিবুতে থাকল।

নিবারণের মতো আরও অনেকেই এখানে, এই অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, অপেক্ষা করছে। উদ্বেগ সবার চোখে-মুখে। কিন্তু তারা নিবারণের মতো অস্থির নয়।

নিবারণ লক্ষ করল অপারেশন থিয়েটার থেকে যারা বের হচ্ছে, ডাক্তার-নার্স এমনকি ওয়ার্ড বয়, সবার পরনে সবুজ পোশাক। তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল কিছুদিন আগে ক্লাসে এক ছাত্র তাকে প্রশ্ন করেছিল, অপারেশন থিয়েটারে সবাই কেন সবুজ বা নীল পোশাক পরে ? উত্তরটা নিবারণের জানা ছিল না বলে লজ্জা পেয়েছিল। পরে অবশ্য কারণটা সে জেনেছে।

অপারেশন থিয়েটারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাছেঁড়া আর রক্ত নিয়ে কাজ করতে হয়। দীর্ঘ সময় একটানা রক্ত দেখার ফলে সেখানকার চিকিৎসক-নার্সদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তারা সবকিছুতেই ছোপ ছোপ লাল রং দেখতে পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর জন্য অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম দায়ী। এর ফলে অস্ত্রোপচার চালিয়ে যেতে সমস্যা হয়। আর তাই এ সময় চারপাশের পরিবেশ অথবা পোশাকে সবুজ বা নীল রঙের উপস্থিতি চোখকে আরাম দেয় এবং দৃষ্টিভ্রমের প্রভাব কমিয়ে দেয়।


নিবারণের স্ত্রী শেফালী ঘোষের তৃতীয় সন্তান হবে আজ। প্রথম দুই কন্যাসন্তানের পর পুত্র আসছে ঘরে। তাই নিবারণের যেন আর তর সইছে না। শেফালীর সন্তান প্রসবের তারিখ ছিল আগামী মাসের ১৮ তারিখ। এক মাস আগেই সার্জারি করতে হচ্ছে। আজ দুপুর থেকে বাচ্চার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। শেফালীর মাথাখারাপের মতো অবস্থা। নিবারণ বাড়িতে নাই। শাশুড়ির কাছে দৌড়ে যায় শেফালী। শাশুড়ি বলে, বাচ্চা কি সারাক্ষণ পেটের মধ্যে লাফালাফি করবে নাকি ? দুই বাচ্চা পয়দা করছ, এখনো এইসব বোঝো না।

শাশুড়ির কথায় শেফালী শান্ত হতে পারে না। নিবারণের মোবাইল ফোন বন্ধ। সে ছুটে যায় পাশের বাড়ির কল্পনা মাসির কাছে। মাসি সব শুনে বলে, এখনই ডাক্তারের কাছে যা শেফালী। ভুল করিস না। ভগবান তোর মুখের দিকে চাইয়া পুত্রসন্তান দিছে। মা দুর্গা, মা দুর্গা!

শেফালী আকুল স্বরে বলে, ওনার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। আমি এখন কী করি ? তুমি আমারে নিয়ে যাবা মাসি ?

শেফালীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে কল্পনা মাসি। সঙ্গে তার শাশুড়ি আশালতাও আসে। আশালতা অবশ্য প্রথমে আসতে রাজি হয় নি। কল্পনার জোরাজুরিতে মত বদলায়। এরমধ্যে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসে নিবারণ। ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আরও আগে আসেননি কেন ? বাচ্চার মুভমেন্ট তো মনে হচ্ছে সকাল থেকেই বন্ধ। এখনই একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হবে।

ডাক্তারের কথা শুনে শেফালী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। নিবারণের চোখে-মুখে আতঙ্ক। ডাক্তারের লেখা কাগজ নিয়ে শেফালীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছুটে যায় আল্ট্রাসনোগ্রামের জন্য। সেখানে দীর্ঘ লাইন। ডাক্তারের আর্জেন্ট লেখা কাগজ দেখালে অবশ্য দ্রুত আল্ট্রাসনোগ্রাম হয়ে যায়। রিপোর্ট নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাক্তারের কাছে ছুটে আসে নিবারণ। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলে, এখনই সার্জারি করতে হবে। নিবারণ সঙ্গে সঙ্গে পূজা মানত করে।

দুই কন্যাসন্তানের পর ভগবান মুখ তুলে তাকিয়েছেন। পর পর দুই কন্যা জন্ম দেওয়ায় শেফালীকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। আশালতা তো উঠতে বসতে গালমন্দ করে শেফালীকে। নিবারণ শোনে অনেক কথা, দেখেও কিছু কিছু। মাকে সে বোঝানোর চেষ্টা করে, এটা শেফালীর দোষ না। সন্তান পুত্র না কন্যা হবে সেটা মেয়েদের ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু মা কিছুতেই ওসব বুঝতে রাজি না। নিবারণের পক্ষে এর থেকে বেশি কিছু মাকে বলা সম্ভব হয় না। অল্প বয়সে বাবা মারা গেলে অনেক কষ্টে মা তাকে এবং তার ছোট বোনকে বড় করেছে। অভাবের সংসারে বাবা ঋণ ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। নিবারণ কোনো রকমে বিএ পাস করে প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। তাও চাকরি নিতে হয়েছে মায়ের বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি বিক্রির টাকা ঘুষ দিয়ে। ছোট বোনের বিয়েও দিয়েছে মা।

আশালতার বিয়ের পর নিবারণের বাবা তাঁকে একটা সেলাইমেশিন কিনে দিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর সেটাই ছিল একমাত্র ভরসা । আশালতা মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় এনে সেলাই করে সংসার চালানো শুরু করে। একপর্যায়ে তার খুব সুনাম হয়ে যায়। তখন তাকে আর কাজের জন্য মানুষের বাড়িতে যেতে হতো না। সবাই বাড়িতে এসে কাজ দিয়ে যায়। রাত জেগে আশালতা সেসব কাপড় সেলাই করে। নিবারণ দেখেছে কী অমানসিক কষ্ট করে তার মা সংসারটাকে আগলে রেখেছে! এরমধ্যে নিবারণের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে মা। নিবারণ মাত্র চাকরিটা শুরু করেছে। এখনই সে বিয়ে করতে চায় না। মা একদিন বলল, পুরুষ মানুষের সময়মতো বিয়া করতে হয়। তা ছাড়া ঘরে আমি একা থাকি। আমার তো একটা কথা বলার মানুষ দরকার।

মায়ের পছন্দেই বিয়ে করে নিবারণ। শেফালীর গায়ের রঙটা একটু ময়লা বলে নিবারণের খুব একটা পছন্দ ছিলো না। মা বলল, শোন বাবা, মেয়েদের পরিচয় হলো গুণে। রং দিয়া কী করবি ? নিবারণ আর টুঁ শব্দটা না করে মাথায় টোপর পরে সাতপাক ঘুরে শেফালীকে ঘরে নিয়ে আসে। মার সঙ্গে শেফালীর সে কী খাতির! ছুটির দিনে কিংবা স্কুল থেকে ফিরে অলস বিকেলে শেফালীকে নিজ ঘরে পায় না নিবারণ। মা তাঁর ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। রাজ্যের গল্প করে শেফালীর সঙ্গে। চুলে বেণি করে দেয়, সিঁথির সিঁদুর ঠিক করে দেয়। মার এসব বাড়াবাড়িতে মাঝে মাঝে নিবারণ খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু মা কষ্ট পাবে ভেবে কিছু বলে না।

এক বছরের মাথায় শেফালীর কোলে এল কন্যাসন্তান। নিবারণের মা বলল, আশা করছিলাম প্রথম সন্তানই বংশের বাতি জ্বালাবে। কী আর করা! আমার কপালে নাই।

কথাটা শুনে শেফালী কষ্ট পেলেও শ্বাশুড়িকে বুঝতে দেয় না। নিবারণ মাকে বলল, চিন্তা কইরো না, তোমার আশা পূরণ হবে। কথাটা বলেই নিবারণ একটু লজ্জা পেলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, এখন নাতনির একটা নাম রাখো।

নাতনির বিষয়ে মার তেমন আগ্রহ নেই। তিন মাস পর নিবারণ নিজেই নাম রাখল কন্যার, শাওনি দত্ত। মার এধরনের আচরণে নিবারণ কষ্ট পেলেও কাউকে কিছু বুঝতে দিল না।

এরপর দুই বছরের মাথায় শেফালী আবার পোয়াতি হলো। আশালতা অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগল, এবার নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে। এবারও শেফালীর কোলে এল কন্যাসন্তান। আশালতা রাতারাতি বদলে গেল। শেফালীকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না সে। একদিন রাগ করে বলল, তুমি একটা অপয়া। একটা পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পার না।

দূর থেকে কথাগুলো শুনে নিবারণের খুব রাগ হলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল। মাকে সে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চায় না।

শেফালী খুব কান্নাকাটি করল। নিবারণ তাকে বোঝায়, মা পুরোনো দিনের মানুষ। তুমি কিছু মনে রাইখো না। কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

কোনো কিছুই ঠিক হয় না। উঠতে বসতে শেফালীকে শ্বাশুড়ির খোটা শুনতে হয়। দুই নাতনির দিকে ফিরেও তাকায় না আশালতা। নিবারণ বুঝতে পারে না তার মা কেন এতটা একরোখা, অবুঝ!

পাঁচ বছরের মধ্যে শেফালী আবার সন্তানসম্ভবা হলো। আতঙ্ক ঘিরে ধরলো তাকে। বিষয়টা বোঝার পর নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেল সে। কদিন চুপচাপ থাকার পর অনন্যোপায় হয়ে স্বামীকে জানাল। নিবারণ অভয় দিল শেফালীকে। তবে শ্বাশুড়ি শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, আবার ?

নিবারণের ইচ্ছাতেই সন্তান নেয় তারা। শেফালী কোনোভাবেই চায় নি। সে বলেছিল, এবারও যে মেয়ে হবে না তার কি কোনো ঠিক আছে ? কিন্তু নিবারণ শোনে নি সেকথা। একরকম জোর করেই…।

আগের দুবার আলট্রাসনোগ্রাম করার সময় ডাক্তার বলতে চেয়েছিল শেফালীর গর্ভে পুত্র না কন্যা। নিবারণ জানতে চায়নি। সে একবারেই জানতে চায়। তাঁর কাছে পুত্র-কন্যা একই ব্যাপার। নিবারণ জানে এক্ষেত্রে শেফালীর কোনো দোষ নাই। পুত্র-কন্যা নির্ভর করে পুরুষের ক্রমোজোমের ওপর। এবার শেফালীর মতো সেও খানিকটা চিন্তিত। বিশেষ করে তার চিন্তা হলো মাকে নিয়ে। তাই আলট্রাসনোগ্রামের সময় ডাক্তারকে বলল, দিদি, এবারও কি…? ডাক্তার একগাল হেসে বলল, মিষ্টি খাওয়ান। এবার রাজপুত্র আসছে। ডাক্তারের কথা যেন বিশ্বাস হতে চায় না। আনন্দে নিবারণের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে মাকে খবরটা বলতে গিয়েও বলে নি নিবারণ। থাক না মার জন্য একটা সারপ্রাইজ!

অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে শেফালী বলছিল, ডাক্তারের কথা যদি সত্যি না হয় ?

নিবারণ লক্ষ করল কথাটা বলতে গিয়ে শেফালীর চোখ দুটো টলমল করছে। শেফালীর হাতটা শক্ত করে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে নিবারণ বলল,
-ধুর পাগলি! আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট কখনো ভুল হয় ?
শেফালী বলল,
-সত্যি তাহলে আমাদের একটা রাজপুত্র আসছে ?

নিবারণ কিছু একটা বলার আগেই নার্স ভেতরে নিয়ে গেল শেফালীকে।

অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষা করতে করতে এসব কথা মনে পড়ছে নিবারণের।

এরমধ্যে একজন নার্স এসে নিবারণকে ভেতরে যাওয়ার কথা বলল। নিবারণ ভেবেছে বাচ্চা দেখার জন্য ডাকছে। সে বলল,
-আমার মা বসে আছে। তাকে নিয়ে আসি ?
নার্স বলল,
-ডাক্তার আপনাকে একা আসতে বলেছে।

নিবারণ মাকে হাতের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল। মূল অপারেশন থিয়েটারের আগে ডাক্তারের বসার একটা জায়গা আছে। নিবারণকে দেখে ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল,
-আপনার পুত্রসন্তান হয়েছে। কিছুটা ইমম্যাচিউরড বেবি। তাই দুই-তিন দিন ইনকিউবেটরে রাখতে হবে। কিন্তু…
নিবারণ বলল, কিন্তু কী ? শেফালী কেমন আছে ?

ডাক্তার বলল,
-প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল আপনার স্ত্রীর। গত কয়েকদিন মনে হয় অ্যাজমার ওষুধ ঠিকমতো খাননি তিনি।

নিবারণ অস্থির হয়ে বলল,
-শেফালীর কী হয়েছে ?

-আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওনাকে বাঁচাতে পারলাম না।

নিবারণের মাথায় যেন বিশাল এক বাজ পড়ল। সে বলল,
-কী বলছেন ? শেফালী নাই ? আমার শেফালী নাই ?

তারপর বিকট এক চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল নিবারণ। আশালতা ছেলের চিৎকারে দৌঁড়ে এল। নিবারণ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-শেফালী তোমার বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেলো মা। শেফালী চলে গেলো।

আশালতা নিবারণকে জড়িয়ে ধরে বলছে,
-বংশের প্রদীপ আমার দরকার নাই। ডাক্তার-নার্সদের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বলছে, আমার বউমাকে আপনেরা ফিরায়া দেন। ও নিবারণ, কী হইয়া গেল রে বাবা। বংশের প্রদীপ দিয়া কী হইব আমার ?

মা-ছেলের মাতমে অপারেশন থিয়েটার যেন কান্নাপুরীতে পরিণত হলো। একসময় আশালতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।


তুলশীগাছের তলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছে। বাড়িভর্তি মানুষ। সবারই অশ্রুসজল চোখ। খবর পেয়ে শেফালীর মা অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে এসেছে। মেয়ের মুখ দেখে বলল, তুই বড় সৌভাগ্যবানরে মা। শাখা-সিঁদুর নিয়ে ভগবানের কাছে যাওয়া তো ভাগ্যির ব্যাপার। এরপর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে আর কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারায়।

শেফালীকে খাটিয়ায় তোলা হয়েছে। চোখে মোটা করে কাজল, কপালে চন্দনের ফোঁটা ও চুল বেণি করা। পায়ে লাল টকটকে আলতা দেওয়া হয়েছে। নিবারণের ছোট বোন মনের মতো করে বৌঠানকে সাজিয়েছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। জোছনার আলোয় শেফালীকে যেন রাজরানির মতো লাগছে। আশালতা উঠোনের এক কোনায় বসে কিছুক্ষণ পর পর শুধু প্রলাপ বকছে।

নিবারণের চোখে কোনো জল নেই। পাথরের মতো শক্ত হয়ে খাটিয়ার সামনে বসে আছে। সাদা ফুল দিয়ে সাজানো খাটিয়া। এক মুহূর্ত সে শেফালীর কাছ থেকে দূরে সরছে না। পুরোহিত চলে এসেছে। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। নিবারণ হঠাৎ লক্ষ্য করল, শেফালীর শরীরটা মনে হয় একটু নড়ে উঠলো। পরমুহূর্তেই মনে হলো খাটিয়ায় হয়তো কারও ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু না, আবারও নড়লো শেফালীর শরীর। নিবারণের শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠল। শেফালী মিট মিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে। নিবারণ কি স্বপ্ন দেখছে ? ‘শেফালী!’ বলে নিবারণের চিৎকারে সবাই দৌঁড়ে এল। শেফালীর মুখে পানির ঝাপটা দেওয়া হলো। সে আবার হালকা চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছে। পুরোহিত জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে। কে একজন দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে এল। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো শেফালীকে। নিবারণ মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা, শেফালী মরে নাই। শেফালী বেঁচে আছে।

সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলেছে। নিবারণ শেফালীর ডান হাত ধরে বসে আছে। শেফালী অস্পষ্ট স্বরে জানতে চাইল তাদের সন্তান কেমন আছে। নিবারণ বলল, আমাদের রাজপুত্র ভালো আছে। তুমি এসব নিয়ে এখন চিন্তা কইরো না। ভগবানরে ডাকো। ভগবানের দয়ায় সব ঠিক হয়ে যাবে।

শেফালী আরও কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কথা জড়ানো ও অস্পষ্ট হওয়ায় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিবারণ তাকে কথা বলতে নিষেধ করছে। তারপরও শেফালী কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। নিবারণ লক্ষ্য করল শেফালীর দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

নিবারণের বাড়ি থেকে হাসপাতাল প্রায় নয় কিলোমিটার। অর্ধেক রাস্তা আসার পর শেফালীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন সিলিন্ডার কাজ করছে না। নিবারণ অ্যাম্বুলেন্সের লোকদের বকাঝকা করছে। শেফালীর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকলো। সে চেষ্টা করছে বুকভরে শ্বাস নিতে। কিন্তু পারছে না। হাঁপাতে লাগল শেফালী। বুক ক্রমাগত ওঠানামা করছে। নিবারণ বলল,
-জোরে শ্বাস নাও শেফালী। আর একটু কষ্ট করো। এই তো আমরা প্রায় চলে এসেছি। মনে হলো শেফালী বলছে,
-আমি আর পারছি না নিবারণ। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো।

নিবারণ শেফালীকে পরাজিত হতে দেবে না। এবার চিৎকার করে সে বলল, শেফালী, জোরে শ্বাস নাও। আরও জোরে। আমরা হাসপাতালের কাছে চলে এসেছি। দয়া করো ভগবান। তুমি দয়া করো।

হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই শেফালীর দেহটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এল। নিবারণ চিৎকার করে কাঁদছে। হাসপাতালে পৌঁছানোমাত্র নিবারণ পাঁজাকোলা করে শেফালীকে দ্রুতগতিতে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। ইমার্জেন্সির ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলল, সি ইজ ডেড।

নির্বাক নিবারণ প্রস্তরমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একই হাসপাতাল দ্বিতীয়বার শেফালীর ডেথ সার্টিফিকেট লিখল।

পরিশিষ্ট : সন্তান প্রসবের পর ভুলভাবে শেফালীকে মৃত ঘোষণা করায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার মামলা করেছিল নিবারণ। মামলার রায়ে ওই চিকিৎসকের দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড,দশ লক্ষ টাকা জরিমানা ও তাঁর চিকিৎসা সনদ বাতিল করা হয়।

মাজহারুল ইসলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *