ধ্রুবতারা (৬ষ্ঠ এবং শেষ পর্ব)

ডিমলা সদর হাসপাতালে মিনুর ভর্তি হওয়ার আজ দ্বিতীয় দিন। সকালবেলায় হাসপাতালের জেনারেল বেডে মিনুর বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায় জমির। তাকে দেখতে পেয়েই মিনুর মা এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মিনুর মাথার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। জমির কাছে এগিয়ে আসতেই মিনুর মা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মিনুর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে জমির বলে উঠে ,

” আইজ তুই ক্যাঁকা আচোন ? শইল ভালা আচেন ? এ্যাইজ কিচু খ্যায়াচিন ? ”

মিনু মুখে কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। জমির খেয়াল করে মিনুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । মিনুর কান্না দেখে তার বুক চিরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। জমির এক মুহূর্ত থেমে খুক করে একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে আবারও বলে উঠে ,
” ভুলটা হামার হইচ বৌ। মুই বনের পাখিরে খাঁচায় ব্যান্দিত রাখচিন। এলায় কি পাখি পুশ মানেরে বৌ! তারে যদি পশ্যন নোয়ায় দিবার পাত্তেম তয় জোর করি ক্যান কাপাট দিয়া রাকচিলিম। যদি একবার ট্যার পাইত্তেম তাইনি মুই খাঁচা থ্যাক্যাত পাখিটা আসমানে উড়ায়ি দিতিম ! নাই দেকিতাম পাখিটা কাঁই যায় ! ”

এক মুহূর্ত থেমে জমির আবারও বলে উঠে ,
” তুই সকলারত ডরে নোয়ায় কহিতে পারিচিলিন , হামাক তো একটি বার সাহস করি কহিতিন ! মাঝত মাঝত হামার সাথোত তোমরা আও করিনে মুই ট্যার পাইতেম। ক্যান তুই বৌ নিজত স্যাদ্ধ্যা জীবন দিবার গ্যাছিন ? আইজ পাউঁছাবার যায়া মুই পাগারোত পননু। তাই একনা মোক নজ্জা লাগছে। হামি টেটিয়া মানুষ নই। তো উদিনকা তর মুন বুঝিবার পারি তরে বাপের বাড়িত প্যাঠায়ে দিয়াছিম। তয় তুই ক্যান ফিরা আসলিন ? ”

‘ হামি না বুঝিবার পারি তর জীবনটা নষ্ট করি দিচিরে বৌ ! তুই মোক ক্ষমা করি দিসিন। আর একটা কতা শুনি আক , অ্যাজ থিক্যা তরে হামি মুক্ত করি দিয়া গ্যালাম। যদি কুনদিন হামাক দিয়া তর কুনো উপকার নাগিবার পারে তয় তুই হামাক এট্টুক খবর দিস বৌ। আর হামার জন্নি তুই নোয়ায় কিচু ভাবিস। এ্যাত দিনত মুই একনাই ছিনু। বাকি জীবনটা মোর সারা আইত ক্যানেলর তন মাচ ম্যারা এলায় ক্যাট্যাত যাবিন ! ” কথাগুলো বলেই জমির চোখ মুছতে মুছতে শুকনো মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই প্রথমবার মিনু একরাশ বিস্ময় নিয়ে জমিরের গমন পথের দিকে চেয়ে রইল।

রাতে বাড়ি ফিরে জমির তার মাকে বললো , ” মা , হামি ক্যাল বিয়ানত ট্রেনত চড়ি ঢাকা যাইম। তুই হামাক ভাত আন্না করি দিস। ”

জমিরের মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে , ” ক্যারে বা , হঠাৎ করি কির নাগি ঢাকা যাবার চান ? ”

” ব্যবসার কাজে এট্টুক ঢাকা যাবার নাগিচ। তুই কুনো চিন্তা করিস নারে মা। ক্যাল দিন পর হামি ফিরা আসিম। ”

পরের দিন জমির ট্রেন ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। ট্রেনখানা জয়দেবপুর রেলস্টেশনে এসে পৌঁছাতেই জমির ট্রেন থেকে নেমে পড়লো। তারপর স্টেশন থেকে বের হয়ে এসে পকেট থেকে গাজীপুরে রাজন যে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে সেই খানের ঠিকানাটা বের করে রাস্তার একজন ট্র্যাফিক পুলিশ দেখাতেই সে রাজনকে একটা রিক্সায় তুলে দিলো। কিছুক্ষণ পর রিক্সাওয়ালা তাকে রাজনের ফ্যাক্টরীর গেটের সামনে পৌঁছে দিয়ে রিক্সা ভাড়া নিয়ে চলে গেল।

সন্ধ্যার পার হওয়ার বেশ খানিকটা সময় পর কারখানার গেট দিয়ে রাজন বের হয়ে আসতেই গেটম্যান জমিরকে ইশারায় তাকে দেখিয়ে দিলো। রাজনকে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে জমির একটা সালাম দিয়ে বলে উঠে , ” ভালা আছুন বাহে ! হামাক আপনে চিনিবার নোয়ায় পারেন। মুই কিন্তুক আপনেরে চিনছি। মুই জমির , ডিমলা থিক্যা আইজ ট্রেনত করি অ্যাইচি। হামার নামটা আপনে আগে শুনিচেন বাহে ? ‘

” জ্বি বাহে , একনা মুই আপনারে চিনিবার পারিচ ! খাওয়া কিচু কি করিচেন বাহে ? আগত চলিন হামাকেরে মেসেত। আরাম করি চাইরটি ভাত খিলি তারপর দুই ভাই মিলি গুয়া দিয়া পান খিলি সারা আইত গল্প করিম। ”

জমির একটু খানি হেসে উঠে বললো , ” আপনেরে অনেক ধন্যবাদ বাহে ! মুই আইজ আর নোয়া যাই। আপনের সাথত এট্টু জরুলি কতা আচে। কতা শ্যাষ হলি মুই আবার আইতের টেরেনত ধরি বাড়ি যাইম। ”

রাজন বেশ হতাশ হয়ে বললো , ‘ এগলা কি কতা। আপনে হামার দেশের নোক। হামাকেরে সাথত নোয়া থাকি কাই যাইবেন ? ”

জমির তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে রাজনের হাত ধরে বললো , ‘ আপনে খুব ভালা মানুষ বাই। কিন্তু দ্যাশত কাম ফেলি আইচি। তাই মোক যাইতিই হবি। আসল যে কামে আপনের কাচত আইচিন তয় শুনেন। মিনু কিচুদিন আগে বিষ খায়িচেন , একনা মেডিকেলত আচে। আপনে কি এই খবর শুনিচেন ? ‘

রাজন বেশ চমকে উঠে বললো , ” আপনে এগলা কি কহিচেন বাহে ? মিনু মরতি যাবি ক্যা ? ওঁর কি হচে ? মিনু একনা ক্যাংকা আঁচে ? ”

‘ মিনু ভালা আঁচে , বাঁচি আচেন! একনা শুনিচ কাইল মায়ের বাড়িত যাবিন। সে আপনের নাগি বিষ খাচে। একনা আপনে কি করিবার চান ? ”

রাজন খুব অবাক হয়ে জমিরের দিকে তাকিয়ে বলে ,
” হামি আবার কি করিম ? কাঁই যাইম ? মোর তিন কূলে কেহ নাই বাহে ! ”

জমির স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে উঠে ,
” এ আপনে কি কন বাহে ? সে আপনের কাছত মন দিয়া রাখিচ ? জোর করি কি ভালাবাসা যায় গো বাহে ! মুই তারে মুক্তি দিবার চাই ! এলায় তারে খাঁচায় আওজা দিয়ি লাভ কি বাহে ! মাইয়াটা খুবই ভালা , মুনটাও তুলোর ল্যায় লরম। আপনে তারে ঘরে তুলি ন্যান। ”

” এ আপনে কি কহিছেন ? আপনের মাতা টিক আচে ? সে একনা আপনের পরিবার ! এটি ঠিক যে , তারে মুই ছুটু থিন ভালা বাসিতম। কিন্তুক এগল্যা একনা পুরান কতা। তারে ভালাবাসি বলি কহিছি , সে যেখানত আচিন ভালা আচিন , ত্যালে মুই শান্তি পাইম। ধর্মত সে একনা পরস্ত্রী। তারে নিয়া স্বপ্ন দেকাও পাপ। এলায় বুঝিবার পারিচ আপনে ফেরেশতার নান মানুষ। সে আপনের কাঁচেত সুখে থাকিব। তারে নিয়া হামার মুনে আর কুনো দুঃখ নাই। হামি আপনের সাথত দ্যাশত যায়া তারে বুঝাইম। হামি তার হয়া আপনের কাছত ক্ষমা চাই। ” কথাগুলো বলতে বলতে রাজন দুই হাত জড়ো করে জমিরের দিকে তুলে ধরতেই জমির তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

সকালবেলায় হামিদ বেপারীর মেয়ে কুলসুম মিনুর কাছে এসে বলে , ” ক্যাংকা আচো বু ? একনা শইল ভালা ? ”

মিনু উত্তর দেয় , ” ভালা আচিন ? তর কি খবর ? ”

” খবর ভালাই । তয় তুমার সাথত হামার কিচু কতা আঁচে ? চলো বু পুকুর ঘাটে গিয়া নাহয় বসি । ”

পুকুর পাড়ে বসে কুলসুম বললো , ” ঢাকা থিকা আইতের টেরেনত কাশেম বাই বাড়িত আসিচে। বাইওর মুকে একটা কতা শুনিবার পায়াম। বুঝিবার পারিচিনা মুই তোমাক কতাটা কিয়াম কই ? ”

” কি কহিচেন ? জলদি ক দিকি ? ”

” কাশেম বাইওর কাচে শুনি , রাজন বাই যেখানত কাজ করিচে সেখানত কোন এক সেয়ানা চ্যাংড়ির কাছত নাকি রাজন বাই মন দিচে ! বাই নাকি সেই চ্যাংড়িরে নিকা করিবে ! এ কতা শুনি হামি তুমার কাচত ছুটি আসিচি। তুমি একি ভুল করল্যা বু ! যার জন্নি জীবন দিবার গেইছিলে সে কিনা আরেক চ্যাংড়ির সাথত রঙ্গ করোছে ! কিচু মুনে করিও না বু , জমির বাই নুকটা কিন্তুক অনেক ভালা আচিন ! সে অইজ অন্য মানুষ দিয়া তুমার খুঁজ লয়। মানুষটা একনাও তুমার পথ চায়া আচে। তুমার সবকিচু জানিয়াও সে তুমার দিক থন মুক ফিরি নোয়ায়। সে একনা তুমায় ঘরে নিবার আউস করে। ভালা না বাসিলে এলায় তুমার খুঁজ নিবি ক্যা ? কও তুমি ! তুমি আসলেই ভাগ্যবতী বু। হামার কতা গুল্যা এট্টু ভ্যাবা দেকিও। ” কথাগুলো বলেই কুলসুম পুকুর ঘাট থেকে এক দৌড়ে চলে গেল ।

গতকাল কুলসুমের কথাগুলো শোনার পর থেকেই সারাদিন রাত ধরেই মিনু অনেক কিছুই ভাবলো। এর সাথে সাথে হাসপাতালে থাকার সময় জমিরের শেষ কথাগুলো বারবার তার মনে হতে লাগলো। রাতেও জমিরের কথা ভাবতে ভাবতে সারারাত এক প্রকার জেগেই কাটালো। আজ সকাল থেকে জমিরের মুখটা যতবারই মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগলো ততবারই জমিরের জন্য মিনুর বুকটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। মনের ভিতর কি এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে যেতে লাগলো। বেলা যত গড়াতে লাগলো ততোই তার মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। দুই চোখ বন্ধ করলেই জমিরের হাসি হাসি মুখ খানা ভেসে উঠতে লাগলো। একটা সময় পর থেকে সে নিজেকে আর কিছুতেই স্থির রাখতে পারলো না। দুপুরেও ঠিকমতো তার খাওয়া হলোনা। না বুঝে লোকটাকে না জানি কত আঘাত দিয়েছে সে , এই কথাটা ভাবলেই তার দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে আপনাআপনিই পানি পড়তে লাগলো। দুপুর থেকে বিছানায় শুয়ে জমিরের জন্য মিনু নিঃশব্দে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলো। পড়ন্ত বিকালের দিকে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলনা। এক লাফে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পুকুর ঘাটে গিয়ে ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে ব্যাগ থেকে সাজ গোজের সবকিছু বের করে খুব যত্ন করে নিজেকে সাজালো। হাত ভর্তি করে কাঁচের চুড়ি গুলো পড়ে ফেললো। সবশেষে সদর থেকে জমিরের কিনে দেওয়া নতুন শাড়িটা এক পাল্লা করে পড়ে মাথায় শাড়ির আঁচল দ্বারা ঘোমটা দিয়ে শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতেই বাবাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু কি এক অমোঘ শক্তি মিনুর বুকে এসে ভর করতেই বাবার হতভম্ব মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

মিনুর বাবা তাকে পিছন থেকে ডাক দিতে দিতে মিনুর পিছু পিছু ছুটে যেতেই মিনুর মা রান্নাঘর থেকে এক ছুটে এসে মিনুর বাবার পথ রোধ করে বলে উঠল ,
” হামি জানি সে কোই যাচ্চিন । ছাওয়ারে আপনে বাঁধা নোয়ায় দিয়েন। তারে তার ঘরে য্যাতি দ্যান । ”

প্রতিদিনের মতো আজও জমির বিকেলের পর দোকান থেকে বাড়িতে ফিরে ভাত খেয়ে সন্ধ্যার দিকে ছিপ নিয়ে ক্যানেলের পাড়ে মাছ মারতে গেল। পাড়ে বসে নিবিষ্ট মনে সে বিড়ি টানতে টানতে বড়শির দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকলো। হঠাৎ পিছনে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে জমির চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাতেই চাঁদের আলোতে মিনুকে দেখে বিড়িটাতে একটান দিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ,
” খোলুয়ের মধ্যিখানত তাকিয়ে দেকত বৌ মুই কি মাচ ধরিচি । ”

মিনু এগিয়ে এসে খোলুয়টা হাতে নিয়ে একটু হেসে বলে উঠে , ” অনেক মাচ ধরিচেন , অ্যাইজ আর মাছ নোয়ায় মারেন ! আইত অনেক হচে , নিওরও পড়িচে। আর এট্টুক থ্যাকনিন আপনের হিয়াল ল্যাগি যাবিন। ঘরত চলেন। হামাক আবার এই মাচগুলান বাইগুন দিয়া আন্না করা নাগবে। হামার কিন্তুক খুব ক্ষিদ্যা নাগিচে। দুপুর থন ভাত না খায়া আচিন। ”

জমির হেসে উঠে ছিপ খানা এক হাতে নিয়ে আর এক হাত দিয়ে মিনুর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এক গাল হেসে বলে , ” সত্যিই রে বৌ অনেক আইত হচে , চল বাড়িত দিকত যাই॥ ”

( সমাপ্ত)

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *